রুদ্র সান্যাল, লেখক, শিলিগুড়ি:

লকডাউনের মাঝে ফেসবুকে একটা ভিডিও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। করোনা বিধ্বস্ত ইতালিতে একজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্যাক্সোফোনে 'বেলা চাও' এর সুরেলা সংগীত বাজিয়ে চলেছেন, আর আশে পাশে বাড়িগুলো থেকে মানুষেরা বাইরে বারান্দায় বা ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে সেই সুরেলা সুরে করতালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন নিজেদের এবং একই সাথে সেই সংগীত শিল্পীকে।
আসলে এই বেলা চাও এর ইতিহাস অনেক দিন আগের। যদিও নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় সিরিজ 'মানিহেস্ট' এ এই গানটি ব্যবহৃত হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্বজুড়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

বেলা চাও হচ্ছে একটি ইতালীয় লোকসংগীত। মূলত ধানক্ষেতে কাজ করা চাষী তথা শ্রমিকরা এই গানটি গাইতো। ইতালিয়ান ভাষায় 'বেলা' শব্দের অর্থ সুন্দরী। আর 'চাও' শব্দের অর্থ বিদায়। তাই 'বেলাচাও' এর অর্থ বিদায় সুন্দরী। গানটি প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। সে সময় ইতালির পো উপত্যকার 'মোন্দিনা' নারীরা প্রতিবাদের অংশ হিসেবে গানটি গাইতেন। এরা ছিলেন মূলত ইতালির নারী চাষী। এদের কে মালিকরা দীর্ঘ সময় ধরে কম মজুরিতে অমানুষিক খাটাতেন। তার প্রতিবাদ হিসেবে তারা দল বেঁধে গানটি গাইতেন। এই গানটির মোন্দিনা সংস্করণটি সেই প্রায় ১৯০৬ সাল থেকেই পরিচিত। এই গান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিয়ান পার্টিজানেরা গাইতেন। মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসনে অতিষ্ঠ হিয়ে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ইতালি এবং জার্মানির নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলনকে বলা হত পার্টিজান আন্দোলন। এই পার্টিজান আন্দোলনেই 'বেলা চাও' গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
 'বেলা চাও' এর মোন্দিনা সংস্করণ আর পার্টিজান সংস্করণের মধ্যে প্রধান মিল হলো উভয় সংস্করণে 'বেলা চাও, বেলা চাও' শব্দগুলো আছে। কিন্তু পার্টিজান সংস্করণে বেলা তথা সুন্দরী বলতে নিজের মাত্রভুমিকে বোঝানো হয়। কিন্তু মোন্দিনা সংস্করণে শব্দটি ব্যবহার করা হতো ধানক্ষেতে কর্মরত নারীদের সৌন্দর্য্য এবং যৌবন বোঝাতে। যেখানে তারা কঠোর পরিশ্রমের কারণে নিজেদের সৌন্দর্যকেই বিদায় জানাচ্ছেন। 
আবার কেউ কেউ মনে করেন এই গানটির মূল সুর উঠে এসেছে ইহুদীদের একটি লোক সংগীতের সুর থেকে। হয়তো এই সুরটি ইহুদীদের মধ্যে আগেই প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে তা ইতালি আমেরিকায় প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে, সেখানে জনপ্রিয়তা লাভ করে। যাই হোক বিশ্বজুড়ে এই গানটি ফ্যাসিস্ট বিরোধী গান হিসেবেই বেশি পরিচিত। স্প্যানিশ গৃহ যুদ্ধের সময়েও এই গানটির অনুবাদ ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই 'মানিহেস্ট' সিরিজে এই গানটির ব্যবহার দেখে নতুন করে আকৃষ্ট হয়েছেন।

সংগীত শিল্পী এবং সংগীত বিষয়ক লেখক তথা গবেষক জেরি সিলভারম্যান দাবি করেছেন গানটি বিশ্বের ইতিহাস সৃষ্টিকারী গান গুলোর মধ্যে অন্যতম।

গানটির কথা মনে পড়লেই মনে হয় 'মানি হেস্ট' ওয়েব সিরিজে প্রফেসর এবং বার্লিন নামের দুই চরিত্র রাতে ডাইনিং টেবিলে হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে যে গানটি গায় সেই দৃশ্যটি। গানের একটি স্তবকের বাংলা অনুবাদ হলো:-

"এটা হচ্ছে সেই পার্টিজানের ফুল,
বেলা চাও, বেলা চাও...(বিদায় সুন্দরী)
এটা হচ্ছে সেই পার্টিজানের ফুল,
যে মারা গিয়েছিল স্বাধীনতার জন্য!"

তথ্য সূত্র: (১) উইকিপিডিয়া
                (২) roar বাংলা মিডিয়া

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: