প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

প্রাণহীন, উৎসবহীন, অনাড়ম্বর যাত্রায় কি কুন্তীর বিবাহের আশা ছিলো!  তবুও তো বিয়ের সুর থেকে বিদায়ের দৃশ্য পর্যন্ত কোনো রাজকীয় আড়ম্বর ছিলো না৷ এতো যন্ত্রণায় ছিন্ন আশাভঙ্গের নিঃসঙ্গ অভিযাত্রীর বিদায়ী বিষাদ৷ পথে নৈঃশব্দ ভেঙেছে বহুবার, কিন্তু আশঙ্কা বার বার মনটা মুষড়ে দিয়েছিল। কুন্তীর বুকে কেবল উৎকীর্ণ সংশয়, তারপরই নাছোড় নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। উদাস অন্যমনস্কতা, কেবল চোখে অপমানের লজ্জা। কূট সন্দেহের বুকে কেবলই অস্বস্তি ভোগ। কুন্তীর কেবল স্বগোতক্তি,  না, খেলার পুতুল তিনি নন। বারে বারে ষড়যন্ত্র চলবে আর অপ্রস্তুত হয়ে শিকার হবেন কুন্তী, আর নয়। রহস্য সৃষ্টিতে সন্দেহের বীজ বাতাসে ছড়িয়ে থাকে। বিবাহের পরেও স্বামীর মুখে সেই অপ্রকৃতিস্থ অনুভব। স্বামী যখন বলেন যে, দ্বৈপায়নের কথায় তিনি বিবাহ করে মহাপাপ করে ফেলেছেন, তখন একবার দিঃখ তো  যুক্তির ঊর্ধে চিৎকার করে বলবেই, "তবে আমায় বিবাহ করলে কেন! "

সত্যবতীকে ঘটনার উপজীব্যতা দিয়ে পাণ্ডু বলেছিলেন বিয়েটা তাঁর নাকি দ্বৈপায়নের পছন্দ মেনেই হবে৷ আসলে মমতার ভিতর তো কোনো স্বার্থ কিংবা কৃত্রিমতা থাকে না৷ অভিষেকের পথ সুগম করতেই তো দ্বৈপায়নের আর্তি, তাই বিশ্বাসঘাতকতা যে ভীষ্মের সঙ্গে, এ যেন পাণ্ডু মানতেই পারছেন না।

দ্বৈপায়নের মতে ধৃতরাষ্ট্র যে অন্ধ হলেও বীর্যবান, চতুর, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ক্ষমতালোভী ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। কিন্তু পাণ্ডু পরমুখাপেক্ষী ; তাই তো অসামান্য বহুরূপ ধারী কুন্তীকেই তিনি নিয়ে এলেন। কুন্তী তো সেই নারী যে পান্ডুর মধ্যে অন্তর বিকাশের পথ দেবে৷ প্রতিকূলে ধৈর্য ধরে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষমতা সে রাখে৷ এ কথাগুলো কুন্তীকে সাফল্যের গৌরবতৃপ্তি দিয়েছে, আবার দুর্ভাগ্যের লজ্জা দিয়েছে৷ তবু দ্বৈপায়ন দেখেছেন উত্তরণের পথ৷
তবে কুন্তি তো নিরাপরাধ। হস্তিনাপুরের রাজবধূর প্রতি কি তাঁদের কোনো দায়িত্ব নেই। জেনেশুনে পাণ্ডুই বা তাঁকে প্রতারিত করলেন কেন! মিছিমিছি জীবনের আদলে সর্বনাশা রাগ, অভিমানগুলো তো তাঁর প্রাপ্য নয়। বিপর্যয়ের মুখে স্বামী যে পাশে দাঁড়াবে, তাতেও সমস্যা। নির্ভয়ে প্রেমের বদলে ভরসা নিতে কুন্তীকেই আঁকড়ে ধরছেন স্বামী, এ কেমন  নির্ভরতা আশ্রয়! তর্ক কি নতুন বউয়ের ধর্ম! তাই বলে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া  লড়াই নাকি ধর্ম! শান্তির বাতাবরণ প্রতিকূলতার জয়ই কি মেনে নিতে হবে,  কি বলেন পাণ্ডু!  হস্তিনাপুর কি তাঁর টানাপোড়েনের ভূমি!  বিদুর আর সত্যবতী ছাড়া কেই বা আছে তাঁর। নিজের সাথে নিজের আত্মরক্ষার সংঘর্ষ।  ঘূণ পোকার মতো শিকড়ে শিকড়ে জীর্ণদশা কুন্তীর জীবন। যতোদিন যায় রেষারেষি, সংঘর্ষ এক স্থায়ী দাগ কেটে যায়। কুন্তীর জীবনে দ্বিতীয় সত্তা জীবন বিপন্নের কারণ। একদিন স্বপ্নাদেশে মহাকাল জানিয়ে দেন, স্রোতের মুখে মোহিত হওয়ার জন্য চোরাবালিতে পূর্ণচ্ছেদ টানা, এ যেন এক অদৃষ্টের শিকার।

মনে আসে স্বপ্নের শিকড় কোথায়!  বাস্তবের মাটি কি তাই!  কল্পনার ফানুসে থাকলে আবেগের দাম থাকে না৷ ফানুস ফেটে গেলে ফানুসের কোনো মূল্য থাকে না৷তবে যে স্বপ্নহীন ; সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে কাল জীর্ণ হয় ; অনুভূতি আর উপলব্ধি তেই কালের সৃষ্টি। জানাটাও জীবনের দাবানলে পুড়ে গেছে। উপলব্ধিতে তার ছাপ পড়েছে৷ আকুল প্রত্যাশাই হয়তো হাঁক দিয়েছে বারে বারে, মুক্তি চায় সে, মুক্তি,কেবলই  মুক্তি। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: