প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

সম্বন্ধ যখন পরিণতিতে পা দেয়, তখন আত্মীয় বোধ যেন খুনসুটি করে কালের সাথে। মনে বলে, এই তো এবার প্রাপ্তি আমার। যেমন করে সত্যভামার  সূর্য উপাসক পিতার প্রাপ্ত মণিতে অধিকার বসাতে স্বয়ং মাধবকেও কিছুদিন অন্তরালে থাকতে হয়; আবার জাম্ববতী গুহায় দিনাতিপাত করতে হয়। তবু প্রাপ্তির কি সংযোগ! এমনটাই কি প্রাপ্তির কোল ভরতে এসেছিলেন ঘনিষ্ঠের সাহচার্যপ্রাপ্ত কুন্তীভোজ। কে তিনি!  কেনই বা এলেন পৃথার জীবনে কুন্তীকে আঁকতে! কুন্তী ভোজ পৃথার পিতার পিসতুতো ভাই।কুন্তী শুনেছিলেন যে তিনি তাঁর বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর পর্যন্ত কোনোদিন দেখেন নি তাঁর উপস্থিতি। আর সেই মানুষটির প্রথম পদার্পণে কুন্তী একটু আশ্চর্য। মানুষটি আমুদে, আলোচনার পাহাড় গড়ে একটু বেশী কাছে টেনে নেয় সকলকে। আসলে রাজপ্রাসাদে  অতিথি এলে, কানাঘুষো কেউ চরিত্র আঁকবে বিভিন্ন রঙে এ আর এমন কি!!  তবে শূরসেনের অপরাধ বোধ আর প্রতিক্রিয়ার আভরণটা যেন নতুন করে এসেছে বলে মনে হলো।কুন্তীর বুকে মাটি ফুঁড়ে বীজ থেকে চারায় প্রত্যাবর্তন, রহস্যভেদ করতে সত্যিই কি সময় লাগবে আরো!!

হ্যাঁ, এমনটাই হলো পিতার বুকে বিসর্জনের বাজনা। মেঝেতে ছায়া পড়লে মনে হয় দ্বিধাগ্রস্থ আজ সে। স্বীকার করে ফেললেন তাঁর অপরাধ বোধের কথা। আচ্ছা!  মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কি পাপ!  ও যে একার সম্পত্তি হয় না!  সম্পত্তি! না, না নারী সম্পত্তি হতে যাবে কেন, ও তো প্রকৃতি। মুক্তির আহ্লাদে কাঁদে রোজ শুধতে চায় ঋণ। তাই তো শূরসেন এবার তিন রাস্তার মোড়ে পথিকের মতো স্থির বেছে নিতে চাইছেন জীবন পথ। পথের তো শেষ হয় না৷ কিন্তু হাতে ঢিল আর চলা কথা কি, কথা শোনে! সংকটের ভূমিতে আছড়ে ফেলে জটিল হয়ে ওঠে অঙ্গীকার । " হ্যাঁ, রে মা!  আমি অপরাধী "!  পৃথা বলে, কি লুকাতে চাইছো তুমি!!  শূরিসেন বললেন তিনি কৃপা, ভিক্ষা, দয়া, করুণা কিছুই তো চান না, লজ্জা করে।  এ যেন মনে করিয়ে দেয় মেহেরের বাবা জিয়াস বাগের কথা। ভাগ্যের সন্ধানে ফিরতে বসে বাবলা গাছের নীচে জন্ম হওয়া শিশুকে ফেলেই এগিয়ে চললেন। না তা কি হয়! বাবার কানে কান্না এসে পৌঁছাতেই আকুল বেদনায় কুলে তুলে নিলেন প্রিয় কন্যাকে। কিন্তু, শূরসেন তা পারবেন না৷ প্রতিশ্রুতির সম্ভ্রম রাখতে স্বীকার করলেন, "কার মন রাখি রে মেয়ে!  " আজ কুন্তীভোজের দিকে তাকালে আবেগের দিনে সেই পূর্ব প্রতিজ্ঞা যে গলায় এসে বাঁধবে বুঝে উঠার আগেই দিন এসে বলছে, " বিদায় দাও "। যদি না দেন!  তবে!!  তবে!!  আছড়ে পড়বেন অকৃতজ্ঞতার  মোহে। শূরসেনকে, কুন্তীভোজ বলবেন ", প্রতারক ";
কুন্তী জানালেন, কুন্তীভোজ বড়ো দুঃখী। বাৎসল্য স্নেহ ধরে বহু বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের কাঠগোড়ায় কেউ একা ছাড়পত্র পায় না। যা কিছু নেই, তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কে কুক্ষিগত করতেই তো আমাদের মধ্যে অদৃষ্ট আগলে নেয় কাল। বলি হই আমরা। অনুভূতির আড়ালে সসহানুভূতিই যে অতৃপ্তির বোধে সারাজীবন তাকে পরিণতিতে পর্যবেসিত করবে, তা কুন্তী সেদিন বুঝতেই পারলেন না৷ কি করেই বা পারবে!  মাথার উপর ছাতা যখন বৃক্ষের মতো জীবনপথ দেখায়, তখন তো আড়াল হয়ে যায় দ্বিধা দ্বন্দ্ব।  অমর্যাদা আর অপমানের ডালি ভরে বুকে কাঁটা ভরর বেঁধে ফেললেন প্রস্তরীভূত বাঁধনে।

 " না, আজ কি তবে সমাদরের কষ্ট পিতা !  কেন তুমি আমাকে বন্ধক দিলে, পিতা!  উত্তরাধিকারীর জন্য লোকে পুত্র সন্তান দত্তক নেয়৷ কিন্তু কুন্তীভোজ !  বেছে বেছে আমাকেই নিলো!  তাঁর ইচ্ছাকে সমাদর করতে আমাকে বলি হতে হবে কেন! আমার কি ব্যক্তিসত্ত্বা থাকতে নেই!  আমি তোমাদের পুতুল হতে পারি না। তুমি আমাকে বললে, আরো এক নতুন পিতা  পাওয়া বড়ো কথা!  না, না,  তা কেন হবে!  আমার তো নতুন পোশাকের মতো নতুন পিতা  - মাতার প্রয়োজন ছিলো না!  বড় রাজ্যের স্থাপনের সংকল্প তোমার মনে ; তুমি তো প্রাধান্যলাভের আশায় বিভোর। মগধের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে, কলহ, বিরোধ মেটাতে তোমার তো কুন্তীভোজকে প্রয়োজন, পিতা! তোমার রাজ্যের তীব্র আর্থিক সংকট দূর করতে আমায় দত্তক দিলেন পিতা!  ছিঃ আমাকে বিক্রি করে দিলে!! আমাকে চাপিয়ে দিলে তুমি, অন্যের হাতে!!  " আর না, সবসত্য বললে যে পিতার কষ্ট হবে৷ কুন্তী না হয় কৌশলী স্নেহে পিতাকে আঁকড়ে নিয়েছিলেন ; পিতা!  তোমাকে ছাড়া এ জগতে আস্থাবান কে আছে, আমার!  পিতা মাতা ই তো সন্তানের একমাত্র আশ্রয়। আসলে নির্ভরশীলতা বড়ো কষ্টের পিতা৷ উদ্দেশ্য যখন অপব্যাখ্যা হয় তখন আর অনুভবের বেদনা আসে না৷ মমতা দিয়ে আভরণের উপশম কি শোধ হয়, তবে আমিও নিজেকে বিক্রি করে তা শোধ করে গেলাম। " জীবন তো বাঁকে বাঁকে শিক্ষা দেয়৷ গোত্রান্তর আজ।। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: