জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা, দুর্গাপুর:

আগামী বিশ্বের অভিষ্যতের অনেকটা নির্ভর করবে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বুনিয়াদী প্রযুক্তির কতটুকু, উৎপাদন কাঠামোর মধ্য কিংবা নিম্নভাগে হস্তান্তর করে, বিশ্বশিল্প কাঠামোকে সন্তুলিত সামাজিক সম্পর্কে নির্মানের দিকে এগুবে।অথবা প্রযুক্তিকে আরো উন্নত স্তরে নিয়ে গিয়ে, পুরো উৎপাদন কাঠামোটাকেই রোবোটাইজ করবে। তবে যে পথই নিক না কেন, সে চিনের উপরে আমেরিকার নির্ভরতা যেমন কমাবে, তেমনি বিশ্বের অনেক দেশকেই চিন থেকে বিচ্ছিন্ন করে, বিশ্ব রাজনীতি এবং সামরিক মেরুকরনে  নতুন সন্তুলনে নিয়ে আসার প্রানপণ চেষ্টা করবে।
উল্লেখিত সুত্র ধরেই, আমেরিকা-ভারত এবং চিনের সম্পর্কেও যেমন নতুন সম্পর্ক নিয়ে আসার চেষ্টা হবে, তেমনি নব সন্তুলনের দোলাচলে, বিশ্বের বহুদেশেই
ওলট পালট যেমন চলতে থাকবে, তেমনি ‘মেহনত’ এবং ‘কেন্দ্রিভূত’ পুজির সম্পর্ক
নতুন ভাবে নির্ধারিত হবে। তবে আমেরিকা যে পথ ধরেই এগুক না কেন, বুনিয়াদী বিশ্ব দ্বন্দ্ব হিসেবে ‘মেহনত’ এবং উল্লেখিত পুজির সম্পর্কটি ‘তীভ্র’ থেকে ‘তীভ্রতর’ হতে থাকবে। আমেরিকা নিচুতলায় কিছু না ছেড়ে যদি, রোবোটাইজেসনের পথে
বিশ্ব সামাজিক সন্তুলন ঠিক করতে চায়, এবং দেশে দেশের জাতীয় পুঁজি তা মেনেও নয়, পূর্বে যেমন উল্লেখ করেছিলাম, দাসের উপর আধিপত্ত কায়েমের প্রশ্নেই, একপ্রান্তে আমেরিকার সাথে অন্যান্য দেশ, অন্যপ্রান্ত আন্তপুজিতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যেও দ্বন্দ্বের তীভ্রতা বাড়িয়ে দেবে।
করোনা উত্তরকালে বিশ্ব যে পথেই চলুক না কেন, তাকে গ্লোবালাইজেসনের কালের পর থেকে যেভাবে প্রযুক্তি এবং শিল্প নির্মানের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিলও, তার
পূনঃ নির্ধারন করেই করতে হবে। বিভাজন রেখাটি ২০ বছর পূর্বেও যেখানে এসে
দাড়িয়েছিলো, সে সম্পর্কে দুটি অভিজ্ঞতা বলে দিলে হয়তো, বাকিটুকু জুড়ে নিতে পাঠকদের সুবিধা হবে।
বিশ্ব শিল্প বানিজ্যের উপর একটা সম্মেলনে, সি আই টি ইউ এর প্রতিনিধী হিসেবে এই লেখক উপস্থিত ছিলেন। দিল্লীর সেই সম্মেলনে ইউরোপের উন্নত দেশগুলির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ের অনে জ্ঞানী-গুনি ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। অনেকটা জল-মাপার মতোই জিজ্ঞেস করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, ইউরোপের উন্নত দেশগুলি কী
প্রযুক্তির প্রাণভোমরাটি, সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ে রেখে, সাম্রাজ্যের হালত কি অনেকটা ভেঙ্গেপড়া সোভিয়েতের অবস্থাতেই নিয়ে যাচ্ছেন না তো? আমেরিকা সারা বিশ্বে প্রযুক্তির সওদা করছেন, দেশগুলিতে বনেদিয়ানার মান দন্ডে, প্রযুক্তির বন্ঠন হলেও চাবিকাঠি হিসেবে, প্রাথমিক ‘চিপ্স’ কিন্ত আমেরিকান ব্যবসাদারদের হাতেই। সেখানে নিজস্ব গবেষনায়, মূলচাবিকাঠির তখনো বড়জোড় ৪/৫% ইউরোপের দেশগুলির হাতে, চিন ইতিমধ্যে অনুরুপ অনুপাত প্রযুক্তি চুক্তির সর্ত হিসেবেই পেয়েগিয়েছিলো। ভারতের ঘরে তখনো ‘শূণ্য’।
--- লেখকে বিশ্ময়াভূত করে ফ্রান্সের যে প্রযুক্তিবিদ উপস্থিত ছিলেন, তিনি জীবন রায়ের কথারই প্রতিধ্বনী তুলে বল্লেন – এটা ঠিক যে প্রযুক্তির বিপুল ব্যবহার হলেও,
স্বয়ংসম্পুর্ণতা বলতে যা বোঝায় তা তারা নামমাত্র। তিনি কিন্তু জানিয়েদিয়েছিলেন, তারা এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার আপ্রান চেষ্টা করছেন।
বিগত বিশ বছরে ইউরোপ যে কতটুকু,অতীতের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পেরেছে, করোনাউত্তরকালের, বিশ্ব উৎপাদন কাঠামোর পূনঃর্গঠনের কালেই বোঝা যাবে।তবে, চিন যে আমেরিকা থেকে যতটুকু পেয়েছে, বিগত চারদশকে, তাকে ভেঙ্গে দিয়ে যে প্রযুক্তি স্বয়ং সম্পূর্নতার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে, তা নিশ্চিত।
--- আজ বোঝাযাচ্ছে, যদিও ভারতের তুল্যমূল্যে কিছুকাল পূর্বেই  চিন বিশ্ব অর্থনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করেছে, ভারত ও চিনের সাথে প্রকৃ্ত পার্থক্যটা নির্নয় করে দিয়েছে, চিনে প্রযুক্তির রিসার্চ এবং উন্নয়নে, যখন বাজেটের ২০/২৫ ভাগ বিনিয়োগ করেছে এবং একটা সময়ের পর -  প্রযুক্তি হস্তান্তর, বানিজ্যের সর্ত হিসেবে মেনেছেন, ভারত প্রথম থেকেই দু’হাত তুলেই রেখেছিলো।
এইভাবেই দু’ দেশের দুটি পরিনাম ঠিক করে দিয়েছে। ভারত যখন প্রযুক্তির যৎকিঞ্চিত যতটুকু অর্জন করেছিলো, নেহেরু-স্তালিন চুক্তি অনুযায়ী, সেটার প্রায় সবটাই খুইয়ে দিয়েছে, যে চিনে স্বাধীনতার সময় এক ছটাক ইস্পাত উৎপাদনের যোগ্যতা ছিলো না, সেই দেশ এখন ‘মেসিন’শিল্পে বিশ্ব হাব। বাধ্য হয়ে ভারতকে বিশ্ববানিজ্যের তাড়নায়
----- চিন থেকেই মেসিন আনতে হচ্ছে। সেতাই এখন ভারত সরকারের গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। সরকারের রাজনৈ্তিক লাইন যখন চিন বিরোধীতা এবং আমেরিকার সাথে সখ্যতা বৃদ্ধি, তখন চিনের কাছ থেকে ক্যাপিট্যাল গুডস আমদানী করে ভারতের শিল্পের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে। আমেরিকার বিশ্ব বানিজ্য নীতির এখন অন্যতম লক্ষ হবে, করোনাকে উপলক্ষ করে ভারতকে চিন বানিজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
সম্প্রতি চ্যানেল ১৮ এর সাথে এক সাক্ষতকারে, অটল বিহারী বাজপায়ীর ব্যক্তিগত সহায়ক এবং প্রাক্তন নেহেরু মিউজিয়ামের ডিরেকটার শ্রী শক্তি সিনহা মহাশয়, সম্প্রতি, নিউস ১৮ কে দেওয়া  এক সাঁক্ষাতকারে, রাজনীতি এবং বানিজ্যকে, এক লাইনে নিয়ে আসাত তত্বটিকেই সামনে এনেছেন। সাম্প্রতিক কালে, বাংলাদেশ ওঃ পাকিস্থানের সাথে চিনকে, ভারতে বিনিয়োগ রোধ করার যে সিদ্ধান্ত ভারত সরকারের প্রতিবন্ধ করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে, বলেছেনঃ  “the restrictions clearly reflect the mood in New Delhi: “with China, economics cannot be kept separate from politics.” তিনি আরো বলেছেন, “while China will remain an important supplier of machinery, India needs to cut down on dependency in key sectors like pharmaceuticals, fintech and e-commerce as the next step and deepen ties with ASEAN and European countries like France and Germany.”
লেনিনয় নির্দেশ অনুযায়ী খবরটাকে প্রধান না মেনে, পুজিকেন্দ্রিকতার কালে যারা চালচিত্রটাকে (কায়াকে) আসল খবর ধরে নিয়ে ‘খবর’কে ‘চালচিত্র’ মেনে চলবেন, তারাই সত্যকে খুজে পাবেন। উল্লেখিত বিজেপীর নেতা নির্ধারকের কথায়, শেষের অংশটাই খবর। প্রথম অংশ স্বতঃসিদ্ধ, ভারত যদি এখন চিন বিরোধী সামরিক বাধ্যবাধকতার সাথে সাথে (শ্রী সিনহার কথায় ‘পলিটিক্স) চিনের সাথে বানিজ্যিক অসুন্তলন (কিছু শিল্পে চিনের উপর নির্ভরশীলতা)ভেংগে না দেয়, তবে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সাথে গলা মিলানোও বন্ধকরতে হবে।
---- একে স্বতঃসিদ্ধ মেনে নেওয়া যেতো, যদি না বিকল্প হিসেবে, তিনি ফ্রান্স, জার্মানী এবং আসিয়ান দেশের নাম না করে, তিনি ঘোষনা করতেন – মনমোহন-বাজপায়ী আমল থেকে বরবাদ করে দেওয়া, ভারতের যে উদিয়মান মেসিন নির্মান ব্যবস্থাকে ভেংগে দেওয়া হয়েছে তাকে পুনঃ নির্মান করা হবে।
পুর্বেই উল্লেখ করেছিলাম, গ্লোবালাইজেশন উত্তর কালে, শিল্পায়নের প্রশ্নে
 এটাই আমেরিকা ঠিক করে দিয়েছিলো – সেই সব দেশ যারা,
 ফিনান্স এবং অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে থেকে
 আমেরিকার অভিবাবকত্ব মেনেছে, তাদের কিছুতেই ক্যাপিটাল গুডস শিল্পে       
     বিনিয়োগ কিংবা প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নির্মান বা আমদানি করতে দেওয়া হবে
     না।
প্রসংগত নতুন প্রজন্মের সমাজ বিজ্ঞানীদের জানা থাকা দরকার একটি বিষয় –
আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতের স্বাধীনতার সর্তই ছিলো, ভারত কিছুতেই মেসিন বিল্ডইং শিল্পে যেতে পারবে না। তাকে মূলতঃ কৃ্ষিতেই থাকতে হবে। দ্বিতীয় যুদ্ধে ফ্রান্সের সাথে ইংল্যান্ড কার্য্যতঃ বিনাশ হয়ে যাওয়া এবং ভারতের সঞ্চিত স্টারলিং ব্যালন্স ইংল্যান্ডের আত্মস্মাৎ করায়, আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পন প্রায় বাধ্যতামুলক হয়ে উঠেছিলো। নেহেরু-স্তালিন শিল্পায়ন চুক্তি সেই বাধ্যবাধকতা থেকে ভারতকে বেড় করে আনে।
কিছু পূর্বে করোনা উত্তর সম্ভাব্য ভারতীয় স্ট্রেটিজি হিসেবে, যে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে, তাতেই প্রযুক্তির দিক থেকে ‘রোবোটের’ দিকে ঝুকে পরা এবং ভারতকে পুনরায় মেসিন বিল্ডিং শিল্পে ফিরে না আসার ইংগিতটাই স্পষ্ট। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: