শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

আমি যখন প্রথম নয়া দিল্লী যাই। টুরিষ্ট বাসগুলোর নিদৃষ্ট টুরিস্ট স্পট ব্যাতিত আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিলো না৷ একদিকে প্রথম এসেছি। অন্যদিকে বয়স ছিলো কম।  তখন টুরিষ্ট গাইড বলতো, ঐ যে ওটা, তিন মূর্তিভবন যেখানে একজন প্রধানন্ত্রী থাকতেন। এখন তা মিউজিয়াম । ভাবতাম গান্ধীজীর কোন স্মৃতি জড়িত এই তিন মূর্তি চক।  ব্যাস, এ পর্যন্তই ছিলো জানা শোনা৷ এতটুকুই ভুলভাল জানা শোনা অনেক দিন পর্যন্ত ছিলো।
কিন্তু তিনমূর্তি চকের ব্রোঞ্জের ঐ তিন মূর্তি যে, হায়দারাবাদ, যোধপুর ও মাইসুরের তথা ভারতবর্ষের  বীরত্বের ইতিহাসে স্মারকচিহ্ন তা জানা ছিলো না৷ জানতো না টুরিষ্ট গাইড নিজেও। কি তবে, দিল্লীর এই তিন মূর্তি চকের ইতিহাস? এই ইতিহাসের গভীরে গেলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, তুরস্কের অটোমান শাসক ও  জার্মানির পরাজয় এবং ইহুদীদের চারশত বছরের গোলামীর পর স্বাধীনতা পাওয়ার কথা চলে আসবে। ইতিহাসে অনেকবারই আরব, তুর্কি ও আফগানদের কিছু সৈন্য, তরবারি আর ঘোড়া নিয়ে ভারতবর্ষ দখলের ইতিহাস আমাদের পড়তে হয়, শুনতে হয়। কিন্তু বিস্ময়কর এই যে, ১৯১৮ সালে এই ভারতীয়রাই, কিছু সৈন্য ঘোড়া আর তরবারি দিয়েই, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, তুরস্কের অটোমান ও জার্মানির যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করে আজকের ইসরাইলের তৃতীয় বৃহত্তম "হাইফা" শহরে। এবং ১৯১৮ সালে ২৩ সেপ্টেম্বরে অটোমান ও জার্মান বাহিনীর এই পরাজয়, ইহুদীদের চারশত বছরের তুরস্কের গোলামী থেকে মুক্ত করে। কেন না, এই হাইফা শহরে তুর্কি ও জার্মান বাহিনীর যৌথ পরাজয়ের মধ্যদিয়ে আজকের ইসরাইলের সকল শহর  ছেড়ে আসতে বাধ্য হয় তুরস্ক। আধুনিক  ভারতেও এই ইতিহাস না পড়ানো হলেও। সব ইহুদী ও ইজরাইলি নাগরিক এই ইতিহাস পড়ে এবং জানে। অবশ্য ভারতবর্ষের অসংখ্য  ইতিহাসের তথ্য গায়েব করার অপচেষ্টা নতুন কোন বিষয় নয়।
 ইসরাইলের হাইফা সিটির মেয়র, জনতা ও ইসরায়েলে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস অনেক আগে থেকেই  নিয়মিত ২৩ সেপ্টেম্বর 'হাইফা ডে"  পালন করে আসছে। ইহুদীদের নিকট এই হাইফা দিবস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  কেন না, ২৩ সেপ্টেম্বরের সেই বৃটিশভারতীয় বাহিনীর কাছে তুর্কিদের  পরাজয়ের পরই কেবল ইহুদীরা তাদের ধর্মের সেই  "পবিত্র দেয়াল" এ যাওয়ার সুযোগ পায়। অটোমান শাসক তথা  তুর্কি খলিফারা ইহুদিদের সব চেয়ে পবিত্র স্থান হলি ওয়াল বা পবিত্র দেয়াল,  ইহুদীদের জন্য  পরিদর্শন নিষিদ্ধ করে রেখেছিলো। আরব নয়, তুর্কিরাই তখন "মুসলিম জগতের" খিলাফতের নেতৃত্ব দিতো।
১৯১৮  সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে  হায়দারাবাদ, জোধপুর ও মাইসুর এই তিন রাজ্যের সৈন্যরা মেজর দলপত সিং এর নেতৃত্বে বৃটিশভারতের রাজকীয় বাহিনীর হয়ে  ইসরায়েলের হাইফা শহর তুর্কি জার্মানি অস্ট্রীয়া ও হাঙ্গেরি সম্মিলিত বাহানীকে পরাজিত করে। 
ভারত ১৯৫০ সালে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৬২, ৬৫, সালে ইসরায়েল  ভারতকে  সামরিক সহযোগীতা দেয়। উল্লেখ্য  ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে  ইসরাইল বাংলাদেশকে সমর্থন করে। নেহেরু, মোরার জি দিশাই যুগে ভারত ইসরায়েল গোপনে সম্পর্ক রেখে চলে। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীই ভারতের প্রথম কোন সরকার প্রধান যিনি জাতিসংঘে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন। এল কে আডভানি  প্রথম ভারত সরকারের সর্বোচ্চ ব্যাক্তি যিনি  ইসরাইলে  সফর করেন। তবে নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মূখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ইসরায়েল সফর করেছিলেন। অতপর ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরাইল সফরে যান। যা ঐতিহাসিক কেন না, কোন ভারতীয়  প্রধানমন্ত্রীর এটাই ছিলো প্রথম ইসরাইল যাত্রা।  কংগ্রেস আর বিজেপির  ইসরাইল নীতি  প্রায় একই। তবে কংগ্রেস এ বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতো। তার কারন ভারতীয় মুসলিম নাগরিক ও আরব দেশগুলো যাতে নাখোশ  না  হয়। তবে নরেন্দ্র মোদীর সময়ে ভারত ইসরাইল সম্পর্ক প্রকাশ্যে চলে আসে। যদিও জেরুজালেমে ইসরায়েলের রাজধানী স্থানান্তরের নরেন্দ্র মোদী সরকার সমর্থন দেয়নি। ভারতের সাথে আরব দেশগুলোর  সাথে বিশাল বাণিজ্য সম্পর্ক  রয়েছে। সে হিসেবে ইসরায়েল সাথে ভারতের বাণিজ্য তুলনা মুলক অনেক কম। তবে সামরিক বিষয়টা যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই চিন্তা থেকেই ইসরাইল ভারতের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করা হয়।
প্রথমে দিল্লীতে  তিন মূর্তি চক  নামে স্মৃতি চিহ্ন থালেও। এখন তা নতুন নাম করন করা হয়। তিন মূর্তি চক নামে প্রকৃত ইতিহাস অজানাই থেকে যেতো। এখন "তিন মূর্তি হাইফা চক" নাম পুননির্ধারন করায় ঐতহাসিক বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতীয় মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হবে বলে এতদিন "হাইফা " নাম সংযুক্ত করা হয়নি।
ইসরায়িলী প্রধানমন্ত্রী বেনঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উপস্থিতিতে  ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে ইসরায়েলের " হাইফা " বিদেশি শক্তির কবল মুক্ত হওয়া শতবর্ষ উৎযাপন উপলক্ষে  তিন মূর্তি চক,  "তিন মুর্তি হাইফা চক"  নামে পরিবর্তন ও উদ্বোধন করা হয়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: