মনোবীণা চক্রবর্তী, লেখিকা ও ইনক্লুসিভ এডুকেশন কনসালট্যান্ট, গান্ধীনগর, গুজরাত:

এ বছরের এপ্রিল মাস পড়ার আগে থেকেই এমন "এপ্রিল ফুল" হয়ে গেছি আমরা সবাই পৃথিবী জুড়ে, যে এ মাসে আরও যা যা করার কথা ছিল, এখনও সে ভাবে করাই হয়নি।

  পশ্চিমবঙ্গ-সহ  ভারতবর্ষের বেশ কটি রাজ্যে এই মাসেই নতুন বছর পালন করা হয়। আমরা বাঙালীরা আমাদের আদরের পয়লা বৈশাখকে বড়ই অনাদরে বরণ করেছি এ বার। আর একটা কাজ আমার মতো কিছু মানুষের করার কথা ছিল, কিন্তু সে ভাবে কিছুই করা হয়নি এ বছর।

 অনেকেই হয়তো জানেন না যে, এপ্রিল মাস বিশ্ব অটিজম সচেতনতা মাস হিসেবেও পরিচিত।
কাদের কাছে?
আমার মতো কতিপয় মানুষ যাঁরা অটিজম নিয়ে কাজ করেন, কিংবা যাঁরা নিজে বা যাঁদের পরিবারের কেউ অটিজম নামের অবস্থাটির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, মূলত তাঁদের কাছে।
কার জন্য এই সচেতনতার প্রয়োজন?
আপামর জনসাধারণ। যাঁরা অটিজম নামের অবস্থাটির সঙ্গে মানসিক অসুখের বা পাগলামির কোনও প্রভেদ রাখার ব্যাপারে এখনও সচেতন হননি।

অবস্থা বললাম কেন?
কারণ, অটিজম কোনও অসুখ নয়। কোনও মানসিক ব্যাধি নয়। এটি একটি স্নায়বিক বিকাশজনিত অবস্থা বা সমস্যা।

বাংলা ভাষায় এই বিষয়ে যে কটি লেখা আমার চোখে পড়েছে আজ অবধি, তার প্রায় সব কটিতেই অটিজমকে একটি অসুখ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোনও কোনও বড় বড় লেখায় তো "ভয়ঙ্কর মানসিক অসুখ" , শব্দবন্ধটিও চোখে পড়েছে। কোথা থেকে শ্রদ্ধেয় লেখকেরা এই তথ্য পেয়েছেন আমি জানি না। তবে আমার যৎসামান্য শিক্ষা ও বছর পনেরোর একটানা কাজের অভিজ্ঞতার নিরিখে আমি এই তথ্যের প্রতি আস্থা রাখতে পারছি না।

অটিজম  বা "অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার" রামধনুর মতোই নানান রঙের বা নানান ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার সংমিশ্রণ। এই অবস্থার প্রত্যেকটি মানুষ এক জন আরেক জনের চাইতে একটু হলেও আলাদা।

অটিস্টিক বাচ্চারা উপযুক্ত  সামাজিক আচরণ বা যোগাযোগে কম সক্ষম হয়।  বয়সোচিত কথাবার্তায় অক্ষমতা,  একই কাজ বারবার করার প্রবণতা, চোখে চোখ না রাখা ইত্যাদি থেকে এদের শনাক্ত করা যায় বছর তিন বয়স হওয়ার আগে থেকেই। ক্ষমতার রকমফের থাকে। সমস্যার গভীরতারও তারতম্য থাকে।
অসুখ নয়, তাই ওষুধ খাইয়ে বা অস্ত্রোপচার করে চিকিৎসাও সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, নির্দিষ্ট থেরাপির মাধ্যমে এই অবস্থার উন্নতি করা নিশ্চয়ই সম্ভব।
এমন বেশ কিছু অটিস্টিক মানুষ আছেন, যাঁদের নিজের নিজের পেশায় খুবই নামডাক। যাঁরা অটিজম নিয়ে কাজ করছেন দেশে-বিদেশে, তাঁদের সবাই একডাকে এমনই একজন মানুষকে চেনেন। আমেরিকার নিউ ইয়র্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন শোর। সারা পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে অটিজম নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে চলেছেন স্টিফেন। আমাদের দেশেও এসেছেন কয়েকবার।
তাঁর সঙ্গে ব্যাক্তিগত পরিচিতির সুবাদে এ
টুকু বলতে পারি, তাঁর মতো সফল এবং গুণী মানুষ কম হয়। তিনি কিন্তু তাঁর অটিজম কে অস্বীকার করেননি। এখনও বেশিক্ষণের জন্য কারও চোখে চোখ রেখে কথা তিনি বলেন না। টুপি পরে থাকেন, বেশি আলোয় অসুবিধে হয় বলে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন আমার-আপনার চাইতে বেশি। কিন্তু তাঁর কাজের জগতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

আমি এটুকুই বলতে চাই। অটিস্টিক মানুষের স্নায়ুতন্ত্রটি আমার বা আপনার থেকে আলাদা, আর এই সত্যটি মেনে নিলেই অনেক সমস্যার এমনিই সমাধান হয়ে যায়।
নানান রং ও গন্ধের ফুল যেমন একটা ফুলবাগান কে আরও সুন্দর করে, সমৃদ্ধ করে, আমার মনে হয় আমাদের সমাজে, সংসারে নানান ক্ষমতার মানুষ একসঙ্গে একে অন্যকে মেনে নিয়ে যদি থাকতে পারে, তাহলে আমাদের সমাজ-সংসারও ততটাই সুন্দর হবে।

রাস্তা-ঘাটে শপিং মলে হয়তো আপনি দেখেছেন একটি বাচ্চা চিৎকার করছে, বা বাবা-মাকে আঁচড়ে-কামড়ে দিচ্ছে। আপনি শুনেছেন, বাচ্চাটি অটিস্টিক। কিন্তু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছেন, বাচ্চাটি পাগল।
না, বাচ্চাটি পাগল নয়। আপনি নিজে একটু ভেবে দেখুন। কদিন লকডাউন হয়েছে কি হয়নি, বাড়ি বসে আপনার প্রাণ হাঁফিয়ে উঠেছে। বাইরে বেরোতে পারছেন না, কারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, কথা-বার্তা হচ্ছে না সে ভাবে। আপনার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে প্রায়ই। আপনি বাড়ির লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। তাঁদের আপনার মনের কথা, দুঃখ, দুশ্চিন্তা সব বোঝাতেও পারছেন। তবু অসুবিধে হচ্ছে আপনার।
আর ওই বাচ্চাটি, যাকে আপনি পাগল ভাবলেন, তার তো কোনও বন্ধুও নেই। হয়তো সে বাড়িতেই থাকে সব সময়, বাইরে বেরোলেই যে লোকজন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। অজাচিত উপদেশ দিয়ে যায় তার বাবা-মাকে।  হয়তো তার জিভেও জড়তা, কথা অস্পষ্ট। অনেক চেষ্টা করেও কী চাইছে বোঝাতে পারে না কাছের মানুষদের। এই অবস্থায় হতাশায় হয়তো সে চিৎকার করে। আঁচড়ে -কামড়ে বাবা-মার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে বা রাগ-দুঃখ প্রকাশ করে।
তার অবস্থায় আপনি থাকলে, আপনিও কি তাই করতেন না?

নির্দিষ্ট রুটিনের বাইরে কাজ করতে এদের অসুবিধে হয়। আমার এক ছাত্র রোজ পঁচিশ কিলোমিটার সাইকেল চালায়। এই লকডাউন-এ সেটা পারছে না বলে, সে ভাল নেই। ওর মা আমার সহকর্মী। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কিছু বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছি ঠিকই, তবু সে সাইকেলের কথা ভুলতে পারছে না। তার হতাশা বারবার ফুটে বেরোচ্ছে তার ব্যবহারে।
খবরে পড়লাম, বিলেতে না কি লকডাউনের মধ্যেও অটিস্টিক মানুষদের জন্য কিছু শিথিলতা আনা হয়েছে। যেমন তাঁরা শরীরচর্চার জন্য দিনে দুবার বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবেন বা গাড়িতে করে একটু ঘুরেও আসতে পারবেন।

বিলেতে কিছু বছর থাকার সুবাদে বুঝেছি যে, ওখানকার সমাজের গ্রহণক্ষমতা আমাদের সমাজের চাইতে অনেক বেশি। আমরা তো অনেক এগিয়ে গেছি বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যদি মন থেকে চাই তাহলে কি অটিজম কে ভালবেসে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে এগোতে পারব না?

অটিস্টিক বাচ্চাদের ভালোবাসার কথা শুনবেন?

বছর চার আগের কথা। দেশের পশ্চিমের এক রাজধানী শহরে আমাদের বিশেষ স্কুলটিতে বছর দশেকের দুটি ছেলে ভর্তি হল। তারা পূর্ব পরিচিত নয়। দুজনেই অটিস্টিক। একজন একটা দুটো শব্দ বলে গুজরাতি ভাষায়। অন্যজন কথা বলে না; তবে কানে শুনতে পায়। তার বাবা মা হিন্দী ভাষী, তাই হিন্দী অল্প-স্বল্প বুঝতে পারে।
ছেলে দুটি স্বভাবে একে অপরের ঠিক বিপরীত। দ্বিতীয় ছেলেটি যতটা শান্ত, প্রথম ছেলেটি ঠিক ততোটাই দুরন্ত, জেদী। যখন যা চাইবে, তাই দিতে হবে। না দিলেই ভাংচুর, মারধোর আরও অনেক কিছু।

আমরা যারা এই বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করি, সবাই অভিজ্ঞ, কিন্তু ওই ছেলেটি যখন তুলকালাম কাণ্ড শুরু করতো, আমাদের নানান চেষ্টাতেও কোনও কাজ হতো না।  এই রকমই একদিন, ছেলেটি একটা বল ভরা চৌবাচ্চায় ঢুকে বসে পড়েছে। কিছুতেই তাকে ওঠানো যাচ্ছে না। ওঠাতে গেলে আঁচড়ে-কামড়ে একসা। ঠিক সেই সময় আমাদের শান্ত ছেলেটি শান্ত ভাবে এসে ওই চৌবাচ্চায় বসলো। সে কিন্তু কথা বলতে পারে না।

দেখলাম বন্ধুর হাত ধরে চোখে চোখে তাদের মধ্যে যেন কত কথাই হচ্ছে! যার কিছুই আমরা বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, আমাদের দুরন্ত ছেলেটির চোখে জল; আর আমাদের শান্ত ছেলেটি বন্ধুর মাথা টেনে নিয়েছে বুকে।

একটু পরে সে হাত ধরে বন্ধুকে তুলে নিয়ে এলো আমাদের কাছে। দুজনেই শান্ত। সেদিন থেকে শুরু হল তাদের অনুচ্চারিত সংলাপ। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম তাদের বন্ধুত্ব। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে যখন সেই দুরন্ত ছেলেটি সবাইকে পেছনে ফেলে প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে, হঠাৎই সে বুঝতে পারলো, বন্ধু পিছিয়ে পড়েছে অনেকটা। অমনি দাঁড়িয়ে পড়লো বন্ধুর অপেক্ষায়। আমাদের হাজার চেষ্টাতে নড়লো না একটুও। বন্ধুর হাত ধরে যতক্ষণে সে শেষ সীমা স্পর্ষ করলো, ততক্ষণে তাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে আরও চার জন। স্বর্ণপদক পাওয়া হলো না তার, কিন্তু বন্ধুত্বের জয় হলো।

প্রতিদিন এই ছেলেমেয়েগুলোকে দেখি, আর অবাক হয়ে ভাবি, কী অসীম এদের ক্ষমতা!  কী বিশাল এদের মন! হিংসে কী, ওরা জানে না। কারও খারাপ করার কথা ভাবা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়।

ওদের পরিচিত, অপরিচিত সবাই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, ওরা কী পারে না, সেই আলোচনায়। ওরা যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, সেই সত্য চোখ এড়িয়ে যায় অনেকেরই।

ওরা কী পারে না, তা নিয়ে ভাবনা ছেড়ে আমরা কি পারি না, ওরা কী পারে সেটা দেখার একটু চেষ্টা করতে? আমাদের আসলে বড্ড দয়ার শরীর। অন্যের বাচ্চা একটু অন্যরকম দেখলেই আহা-উহু করে মনে বড় শান্তি পাই।
গত পনেরো বছর ধরে এই বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করে উপলব্ধি করেছি, দয়া, সমবেদনার প্রয়োজন ওদের নেই।

আপনাদের অনুরোধ, রাস্তায়-ঘাটে বা দোকানে-বাজারে বাবা মা-এর সঙ্গে একটু অন্যরকম শিশুকে দেখলে বারবার ফিরে ফিরে তাকাবেন না; তাদের আচরণে অসহিষ্ণু হবেন না; তাদের দয়া করবেন না। বরং নিজের মতো করে চেষ্টা করুন, ওদের সমাজের মূলস্রোতে ঢোকাতে। সেদিনই হয়তো আমরা সত্যিকারের মানুষ হবো! সহনশীল হবো! সুন্দর হবে, স্বার্থক হবে আমাদের সমাজ!

আসুন, এই লক ডাউনের এপ্রিল কে আমরা প্রকৃত অর্থেই অটিজম সচেতনতা মাস হিসেবে উদযাপন করি।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: