শামা আরজু, লেখক, বাংলাদেশ:

চিলে কোঠার সেপাই আর পাক সার জমিন সাদ বাদ মনে পড়ছে খুব।
তোকে ও হীরক।
যখন মনে হতো খুব অসুস্থ  তুই, যখন তোর দমের কষ্ট হতো,তখনই তোর আমাকে লাগতো। বড় অসময়ে বেজে উঠতো তোর ফোন। আমি ঘুম চোখে বিরক্ত হয়েও তোর ফোন ধরতাম। কখনও এমনও হয়েছে বিরক্তি ও মন্দ লাগেনি। যখন বলতিস,
"তুই আমার অক্সিজেন রে।'

তোকে ঈর্ষা করতেই হয়। দমের কষ্ট  আমারও  হয়।কিন্তু ফোন দেয়ার মতো অক্সিজেন আমার নেই রে হীরক। বরং আমার চারপাশের অবশিষ্ট গাছপালা কেটেও ওরা ফ্ল্যাট বাসা বানায়।বারান্দায় বসে মিথ্যে হাসির লুটোপুটি খায়। জলের ধারে বসে থাকার সে কী আকুতি  আমার!  আজ জলাশয় নেই,বাড়ছে মরুভূমির শুষ্কতা।
তুই বলেছিলি, কোথায় নাকি একটা যায়গা আছে,যেখানে গিয়ে ইচ্ছমতো খিস্তি খেউড় করে আসা যায়। নিবি আমায় ওখানে?

কতোটা ক্ষোভ বুকে জমাট বাঁধলে অমন কথাগুলো কলমে প্রাণ পায়, সে আমি এখন অনেক ভালো জানি।

কাঁদতে কাঁদতে লিখি আমি
লিখতে লিখতেই কাঁদি।

আচ্ছা,তুই বলেছিলি আমায় একটা অস্ত্র দিবি।
আসলেই দিবি?
'চাল কিনতে গেলে ওষুধের টাকা থাকে না' টাইপের সংসার আমার বরাবরই। বাবার সংসারেও তেমনই তো ছিলাম।বাবা মারা গেছিলেন দুই যুগ হয়ে গেলো।মৃত্যুর  সপ্তাহেও বাবা পানির মতো মশুর ডাল আর বাটা মরিচ দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন।না, বিত্তশালীদের মতোন শখে নয়,স্রেফ অভাবেই।
আহারে বাপ! দুই যুগ পরেও  সেই পাতলা মসুরের ডাল  আর বাটা মরিচের লাল রং  আমার চোখে ঝাপসা হয় না  যদিও লিখতে বসলেই -হ্যাঁ, চশমা পরে লিখতে গেলেও  চোখ ঝাপসা হয়ে আসে  মস পাতলা মসুর ডালের মতো  জলে। বাবার অপরাধ ছিলো, এই সমাজে সৎ মানুষ হয়ে বাঁচার ঝুঁকি নেয়া। এই সমাজে প্রগতিশীল হয়ে বাঁচার চিন্তা একটা অপরাধই বটে! বাবা সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন আর আমার ভিতরে তাঁর সেই ঝুঁকির বীজটা বপন করে গিয়েছিলেন। জন্ম-জন্মান্তরের দুর্ভোগ টেনে বেড়াচ্ছি।
মাঝে মাঝেই সবকিছু ছাপিয়ে অস্ত্রের অভাবটাই আজকাল বড় বেশিই তাড়া করে।আর তখন মনে হয় আমার চরম সংকটেও তো আমি তোকে মনে করি। তবে কী আমিও তোকে...। না,এ অসম্ভব। তুই আমার বয়সে কতো ছোট! ভাবতেই লজ্জা লাগছে। তবুও আজ আমার বারবার কেবল তোকেই মনে পড়ছে। অবশ্য আরও একটা কারণকে বোধ  করি ছোট করে দেখা যায় না। একটা নাটক দেখলাম। সেখানে বয়সে ছোট ছেলের সাথে কিভাবে ভালোবাসার সম্পর্ক হতে পারে নাট্যকার কিংবা পরিচালক সেটা খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটক দেখতে আমার একটুও নোংরা লাগেনি রে। কিন্তু তোর মুখটা মনে করতে খুব লজ্জা হয়।এই লজ্জার কারনেই অনেকবারই দেখা করার উদ্যোগ নিয়েও দেখা করিনি। আরেকটা কারণ ছিলো, এটা খুব ছোট কারণ বলে মনে করি না আমরা দুজনেই। সেটা হচ্ছে ভয়, এক ধরনের হারানোর। ভয়টা তোর ছিলো যেমন, আমারও ছিলো। আমাদের দেখা হলে দুজনেরই সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবে। আর বুঝি আমাদের কথা বলার ইচ্ছা থাকবেনা। আর বুঝি ফোন করে কান্নাকাটি করা হবে না।  বুঝি খুব গোপনে গল্পগুলি আমরা একজনকে একজন বলবো না র।এটা তোর যেমন ছিল আমারও ছিলো। 'আমরা দুজনই'  কথাটা ব্যবহার করতেও আমার খুব লজ্জা করছে।
তাছাড়া আমার ভালোবাসার মানুষ তো তুই না। অন্য একজন। তুই না জানি তবু কেন বারবার তোকেই মনে পড়ে! আচ্ছা এমন কি হয়, একই সঙ্গে একটা মানুষ অনেক জনকে অনেক রকম ভাবে ভালবাসতে পারে! এই যেমন রবীন্দ্রনাথের প্রেমগুলি! কতো রকমের প্রেমই তো হতে পারে, তাই নারে? আমাদের সমাজে প্রেম বলতে মানুষ কেবল সেই সম্পর্কটাকেই বুঝে, যেটা শেষ পর্যন্ত  টেনে নিতে চায় বিছানায়। অনেকে বলে সেটাই নাকি আসল প্রেম। আমি অবশ্য কখনো সেভাবে ভাবি না। কারণ আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বিছানায় না পেলেও আমি অনেক ভালোবাসি। ওকে আমি বিছানায় পাই না কেন,
এইজন্য কখনোই ওর উপর আমার রাগ হয়নি,হয়না। আমার রাগ হয় অন্য কারনে- যেটা হয়তো আমার সেই ভালোবাসার মানুষটিই বুঝে না। কিংবা হয়তো বুঝে, যেটা আমি বুঝিনা। না বুঝেই শুধু তার উপরে রাগ করি। যেমন তোর উপরেও অনেক রাগ করি। অবশ্য  যতো রাগই করি তুই আমার উপর রাগ করে এখনো থাকতে পারিস না। এখনও তুই আগের মতোই বলিস, তোর যখন খুব খারাপ লাগে, যখন নিজেকে খুব অসুস্থ মনে হয় তখন তোর আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। অথচ আজ প্রায় ২০ বছরের মতো আমি তোর সাথে কথা বলি ইচ্ছে করলেই আমরা ভিডিও কলে কথা বলতে পারি কিন্তু কখনো সেটা তো বলিসনি। আমিও না,তুইও না। মনে করতেও খুব লজ্জা হয়। আমাদের কি শুধুই প্রেম বিষয়ক কথা হয় কিংবা হতো। অবশ্যই না! আমরা কত বিষয় নিয়ে কথা বলতাম! তোর রাজনীতি বেশি পছন্দ ছিলো কিংবা এখনো। আমার অবশ্য সেটা না কিন্তু আমার রাজনৈতিক সচেতনতা
কে তুই অনেক শ্রদ্ধা করিস। অথচ তোর  রাজনৈতিক আদর্শের ধারে কাছেও আমি নেই। এটাও তুই জানিস। তবু আমাদের কখনো ঝামেলা বাঁধেনি এসব নিয়ে। না রে, আজ আর কথা বলবো না তোর সাথে। লেখা লেখা কথা। বড্ডো ঘুম পাচ্ছে। ক্লান্তি  পেয়ে বসেছে। এক জীবনে এতো ক্লান্তি কতটাই বা এড়িয়ে চলা যায়!হ এড়িয়ে চলেছি তোকে, এড়িয়ে চলেছি আমার ভালোবাসার মানুষকে। কেবল ক্লান্তি এড়াতে পারনি। অসুস্থতা এড়াতে পারিনি।আমি তাই অসুস্থতাকেই বানাই আমার লেখার খাতা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: