শুভশ্রী সাহা, লেখিকা, বারাসাত, কলকাতা:

সকাল গুলো হঠাৎ করে পালটে গেছে বড়। চেনা বাড়িগুলোর রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা প্রেসার কুকারের হুইশল, বাতাসে মাখানো রাঁধুনির সুঘ্রাণ সব ফিকে দূরে দূরে। রান্নাঘরের জানলায় বসা নোলাদাগী কাকের সংখ্যা অনেক কম। নাকি আকাশের অবাধ প্রশ্রয়ে হাওয়ার নির্মলতায় তারা সেখানেই সবাই ভিড় করে আছে কে জানে! কিন্তু নীলচে আকাশকে বড় একা একা লাগছে। শোর শরাবা না থাকলে জান থাকলেও  কি প্রাণ থাকে!
 আজ নতুন নববর্ষ। কত আনন্দ, নতুন জামা সকাল সকালে স্নান ঠাকুর পুজো,পুজো দিতে যাওয়া, রান্না ঘরে মাংস পরমাণ্ণের গন্ধ,সন্ধ্যা থেকে বাঙালির হালখাতা। এক গ্লাস কমলা রসনা, সিঙাড়া মিষ্টি আসার সময় প্রভুজীর পাইকিরি লাড্ডুর প্যাকেট। দশ টাকা থেকে একশো টাকা পর্যন্ত  খাতায় জমা পড়ছে। আসার সময় হাতে ধরার বায়নায় সত্তর টাকার চিকেন বিরিয়ানি। নতুন জামার মোটা ফাইবারের ঠেলায়, ভিড়ের তপ্ত গরমে টপটপ করে পড়ছে ঘাম, তাও লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা প্যাকেটের জন্য।  আহা এইটুকুই তো আনন্দ! মফস্বল পেরিয়ে শহুরে মজলিসির চিত্র আলাদা। সভা সমিতি,কবিতা গান  পুরাতনী টপ্পা বাবু ইতিহাসের বৃত্তান্ত জেনে নিয়ে সন্ধ্যায় সাহেবী আপ্যায়ন। কলকাতা ভাসে পাঁচতারার প্যাকেজে দেদার পানাহার ড্রিনক ডিনার নাচ গান সব রেডি! চাইলে ধুতি পাঞ্জাবী শাড়িতেও বাহারে আহার। বহু জায়গার থিম থাকে,সঙ্গে বাঙালি খাওয়া দাওয়া,সুক্তো টু ডাব চিংড়ি। শেষপাতে মালপোয়া, পায়েস , ক্ষীর যে যা খাবেন। এই আনন্দ অম্লান। হুজুগে বাঙালী , খাইয়ে বাঙালী আমুদে বাঙালী একই অঙ্গে বহু রুপ। আবার গভীর রাতে অবাধ গতি যানবাহনে বছরের দ্বিতীয় দিন দেখতে পায়নি এমন যুবক ও আছে।
যে সময় কলকাতা এত আধুনিক হয়নি তখোনো ছিল নববর্ষের হুল্লোড়।  ঠনঠনে ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে বাবুদের সেরেস্তা থেকে খাতা এসে পড়তো পুজো হতো বাড়ির গৃহদেবতার। পঞ্জিকা পড়া হত সুর করে পাঁচালীর মত,যেন পঞ্জিকাকেও ঠাকুরের পাঁচালীর মত মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা। ঠাকুরঘর এবং রন্ধন শাল গোলাপ জল দিয়ে সাফ সুতরো করা হত,ঠাকুরের ভোগ হত অন্তত চোদ্দ রকমের। আর নিজেদের রন্ধনশাল ভোগ পেত সেদিন। পরের দিন মাছের এলাহী ব্যবস্থা ছিল। পেট পুরে খাওয়ানো হত গরীব গুর্বোদের।  বাবুরা দান দিতেন মন্দিরে মন্দিরে। হ্যাঁ রাত বাড়লে হাতে জুঁইএর মালা বেঁধে গলায় উড়নি  গিলে করা পাঞ্জাবী পড়ে যেতেন বাবুরা ম্যায়ফিলে। টাকা উড়তো, ছড়িয়ে পড়তো আলিসান মার্বেলের নকশায়। বিদেশী বাবুরা মানে নব্য বাবুরা, প্রিন্স/ রায় বাহাদুর উপাধির আশায় পোর্তুগীজ, বা ফিরিঙ্গি, যাদের কিনা আর্মেনিয়ানও বলা যায় তাদের দিয়ে কালিয়া কোপ্তা কাবাব তৈরী করাতেন। সাথে থাকত বিভিন্ন উপহার সামগ্রী। সেই উপহার সামগ্রীতেও থাকত বাবুয়ানির সুক্ষ রেষারেষি। আসলে মোচ্ছব টা উপলক্ষ মাত্র, আসল কথা, কৌলিন্য দেখানো। এখন দিনকাল পাল্টাতে পাল্টাতে পৃথিবীটা এত ছোট হয়ে গেছে, আপনি কোপনির পর আর জায়গা নেই, ডিনার টেবিলের চারজনের বুকিংই যথেষ্ট!
ফিরি আজকের কথায়, দিনপঞ্জীর পাতায় আগত ১৪২৭ সাল, বিগত বছর গুলির থেকে আলাদা এক সময় যেখানে এক অজানা ভাইরাসের সাথে লড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত,সারা বিশ্ব এখন মরণের আঁতুড় ঘর হয়ে উঠেছে।আনন্দ উৎসব তো দূর প্রাণসংশয় নিয়ে প্রতিটি মানুষ চিন্তিত। কোভিড নাইন্টিনের আক্রমণে লক ডাউন প্রসেসে আমরা চলছি একটু একটু করে বাঁচার আশায়। এ বছর প্রদীপ জ্বলবে না মন্দিরে মন্দিরে নিয়ম করে, সুললিত মন্ত্র উচ্চারণের পুণ্যস্পর্শ আর আমরা পাবো না  অঞ্জলির সময়, ব্যবসায়ীরা তাদের নতুন খাতায় সিঁদুর লাগাতে পারবেন না,  তবুও হৃদয়ের বাঁচার আর্তি থেকেই হয়ত সময়ের হার্ডল রেসকে  টপকে এগিয়ে যেতে পারব আমরা। ঈশ্বর আছেন কি নেই এই বিতর্ক করে বলব পজেটিভ এনার্জির ওয়েভ আমাদের ছুঁয়ে থাকুক প্রতিটি দিন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: