আবীরা গঙ্গোপাধ্যায়, লেখিকা, কলকাতা:

বাংলা নববর্ষের সূচনা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে সব মতের সঙ্গেই এই সময়ে ফসল ওঠার বিষয়টি জড়িয়ে আছে কোনো না কোনো একটা সূত্র ধরে। গনেশ পুজো করে ,হালখাতার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সূচনার বিষয়টি কোনো সময়ে শুরু হয়েছিল জানা না গেলেও  কালের নিয়মে,  গ্রহন বর্জনের কাটাকুটি খেলায়, এই বিষয়টা আমাদের জীবনে জড়িয়ে গেছে ওতপ্রোতভাবে। এমন কোনো বাঙালী ব্যবসায়ী নেই যে বাংলা বছরের প্রথমদিন একটু বিশেষ ভাবে গনেশ পুজো করেন না। আবেদন নিবেদনের এই ভীড় এড়াতে কয়েকজন অবশ্য বেছে নিয়েছেন  কিছু দিন পরে আসা অক্ষয় তৃতীয়া তিথিটিকে।
  কয়েক দশক আগে ইংরেজী নতুন বছরের শেষ রাতটিকে ঘিরে এত পাগল পাগল উদ্মাদনা দেখা যেত না বাঙালীদের মধ্যে, কলকাতাবাসীদের মধ্যে  তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষজনের মধ্যে । আর ইংরেজী নতুন বছরের প্রথমদিন দুরন্তভাবে কাটাতে হবে, আলাদা রকম ভাবে খাওয়াদাওয়া করতে হবে হোটেল ,রেস্তরায় গিয়ে  এমনটাও ভাবত না কেউ।
  কয়েক দশক আগেও বছর শুরুর উন্মাদনা যা কিছু ছিল সবই বাংলা নববর্ষকে ঘিরে। বেশি ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারে তখন অকারনে জামা কাপড় কেনার চল ছিল না। তবে দুর্গাপুজো ছাড়া বছরের আর একটা সময়ই বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বিশেষত ছোটোরা নতুন জামা পেত পরার জন্য...সেটাএই বাংলা নববর্ষের দিনটায়। সাধ্য অনুযায়ী , খাওয়ার তালিকাতেও একটু বিশেষত্বর ছোঁয়া থাকত প্রায় সব পরিবারেই। বাড়িতে বড়রা ছোটদের বলত বছরের প্রথম দিনটা ভালো কাটলে সারাটা বছরও ভালো কাটবে। ছোটোরা তখনও সহজ সরল ছোটোই ছিল, যুক্তিবাগিশ হয়ে ওঠে নি। তাই কথাটা মাথায় রেখে চেষ্টা করত, দিনটাকে যেন তেন প্রকারে ভালো ভাবে পার করতে.. বকা না খেয়ে আর বুড়ি ছোঁয়া করে হলেও বই খাতা খুলে  বসে খানিক লেখাপড়া করে নিয়ে।
    যাদের বাবা কাকাদের ব্যবসা বা দোকান ছিল তাদের প্রতি কেমন একটা ঈর্ষা জাগত মনে। লক্ষ্মী , সরস্বতী ছাড়া গনেশদাদাও আসে ওদের বাড়ি ! নিজের অত্তবড় ভুঁড়ি আর ছোট্ট ইঁদুরটাতে সঙ্গে নিয়ে। কত ফল ,মিষ্টি দিয়ে পুজো দেওয়া হয়, পেটুক তো। দুই দিদির থেকে আদরও বেশি, খাওয়াদাওয়ার আয়োজনও।
হালখাতা বিষয়টি চিরকালই রহস্যে মোড়া থেকে গেছে। বাকির খাতা খোলা নেই, তবু বছরের পর বছর চিঠি আসে সোনার দোকান থেকে, মুদির দোকান থেকে । দাদু কিংবা বাবা কাকা কারোর হাত ধরে কখনো যাওয়া হয় নি হালখাতা করতে। চিরকাল যাওয়া আসার পথে কৌতুহলী দৃষ্টি মন ফেরাতে পারে নি ওই দিন দোকানগুলোতে আপ্যায়ন করে দেওয়া কোল্ড ড্রিংসের গ্লাসগুলোর থেকে। বছরে একদিন খদ্দেরকে ভগবান ভাবা ব্যবসায়ীদের খাওয়ানো বিনে পয়সার ওই কোল্ড ড্রিংসের না জানি কত স্বাদ! তবে গোটা পাঁচেক বাংলা ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির বাক্স বাড়ির পুরুষ সদস্যদের হাত ধরে ঠিক চলে আসত সন্ধের পর। কোনো কোনো দোকান থেকে আবার বাড়িতেও পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
   যতই আমরা ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনে চলি, বাংলা ক্যালেন্ডারকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে চাঁদের দিকে চোখ পড়তেই যেই মনে হয়..পূর্নিমা কি চলে গেল? বাব্বা চাঁদের কি ছিড়ি! কি তিথি আজ কে জানে...। বাড়ি এসেই টুক করে বাংলা ক্যালেন্ডারে চোখ বুলিয়ে নেওয়া..। কোনো বিশেষ তিথি , পুজোর তারিখ জানতে ভরসা কোনো না কোনো ঠাকুর দেবতার ছবি দিয়ে সাজানো ওই বাংলা ক্যালেন্ডারটি। আজকাল ছবির মত সাজানো বাড়ির খরচ করে রঙ করা দারুন দারুন দেওয়ালে কেউ ক্যালেন্ডার ঝোলায় না। ছোটবেলায় মা কে দেখতাম রান্নাঘরের দরজার পেছনে বাংলা ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে রাখতে।ওটা মা র একান্ত ব্যক্তিগত জায়গা। রান্নাঘরের দরজা , তার আবার পেছন দিক। সেই ট্রাডিশন মেনে এখনো রান্নাঘরের দরজায় মা আর মা র মেয়ে দু জনেই ঝোলায় বাংলা ক্যালেন্ডার । রান্না করতে করতে হাত ব্যাথাটা বেশি মনে হলেই টুক করে দেখে নেওয়া আজ অমবস্যা না কি? তারপর হুংকার ছাড়া আজ একপদ রান্না কম হবে..অমবস্যায় বাতের ব্যাথা বেড়েছে আমার। বউ হয়ে আসার পর কে যেন গল্প শুনিয়েছিল এরকমটাই বলতেন দিদিশাশুড়ি।
  সেল শব্দটা চিরকালই কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে। জীবনে আজ অবধি এমন কোনো পুরুষ মানুষ দেখলাম না, যে চৈত্র সেলের নিন্দা করে নি। ওদের সবার একমত মহিলাদের লোভী, হ্যাংলা, যত পাই যা পাই  সব কিনি সব চাই মনোবৃত্তির কথা মাথায় রেখেই নাকি এই চৈত্র সেলের উৎপত্তি। যত পচা রদ্দি জিনিস তৈরি হয় এ সময়ে বিক্রির জন্য। আমি দরিদ্র ব্রাক্ষ্মণী, ততোধিক দরিদ্র , বাংলা সাহিত্য জগতে সূচাগ্র মেদেনীর জন্য বর্তমানে লড়াইক্ষেপা এক লেখিকা। আমার কি দরকার দামী দামী টেকসই জামাকাপড়, বিছানার চাদর , বালিশ কভার আর পর্দার কাপড়ে?  সেলের বাজার দারুন লাগে। আগে এটা উপভোগ করতে যেতে হত গড়িয়াহাট। এখন অার তত কষ্টও করতে হয় না। শ্বশুর বাড়ির রাস্তার মোড়ে সেলে র বাজারে দু হাতে লোক সরিয়ে যেতে হয়।  এ সময় প্রতি বছর সন্ধেবেলা বেড়ানোটা এমনই বেড়ে যায়। ঘুরি ফিরি , উপভোগ করি সবার কেনাকাটা, সবার আনন্দ।ব্যাগে পয়সা থাকলে কিনেও ফেলি টুকটাক এটা সেটা।
   বাড়িতে প্রতিবার পঞ্জিকা আসে এই সময়। বেনীমাধব শীলের হাফ নয় ফুল পঞ্জিকা। পাতা উল্টেই বাবা চলে যায় দুর্গাপুজার তিথি দেখতে।  তারপরেই মা মেয়েতে শুরু হয়   আলোচনা এবার কী ভাবে পুজোর আয়োজন ম্যানেজ করতে হবে।  বাবার ভরসা মা।মা র ভরসা ছেলে আর মেয়ে। পঞ্জিকা হাতে পেয়েই বাবা একদিন চলে যায় কুমোরের বাড়ি মা দুর্গার মূর্তির বায়না করে আসতে।
   এবার পঞ্জিকা আসে নি, আসবে না নতুন বাংলা ক্যালেন্ডারও। কোনো দোকানের থেকে আমন্ত্রনও আসে নি হালখাতার আনন্দে যোগ দেওয়ার জন্য । নতুন জামা কেনা হয়নি কারোর। যে সব ছোটো ছোটো জামা  কাপড়ের ব্যবসায়ীরা মাল তুলেছিল, যারা অপেক্ষায় থাকে বছরের এই সময়ের ব্যবসাটার জন্য...তারা হয়ত মাথা ঠুকছে দেওয়ালে। কারন করোনা এসেছে। চীন উৎপন্ন হওয়া এই চীনা ভাইরাসের দাপটে তটস্থ আজ মানব জীবন। মেড ইন চায়না কথাগুলোর সঙ্গে যে বিদ্রুপ জড়িয়ে ছিল এতকাল তার বিরুদ্ধে বুঝি বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে এই ভাইরাস। দেখিয়ে দিচ্ছে কত টেকসই সে।  আজকে যে নতুন বছর শুরু হবে , তাকে আনন্দ উৎসবে বরণ করে নেওয়ার জন্য একদম তৈরি নই আমরা। দোকানগুলো আজ আলো দিয়ে সাজবে না, নতুন জামাপড়া মানুষের ঢল নামবে না রাস্তায় , হোটেল রেস্তোরা তাদের বাঙালীয়ানার প্রমান দিতে বিশেষ বিশেষ বাঙালী রান্নার বিজ্ঞপ্তি করবে না মেনুকার্ড। শোনা যাবে শঙ্খ আর উলু ধ্বনি। পুরুতমশাইকে নিয়ে টানাটানিও হয়ত চোখে পড়বে না।  জমজমাট জলসার আয়োজনও হবে না কোথাও। তবুও চোদ্দশো সাতাশ সাল শুরু হয়ে যাবে আজ থেকে , কালের নিয়মে। কিছু লোক আজকে লড়বে,  কালকেও লড়বে, তার পরের কিংবা পরের পরের দিন, নিজেদের জীবন বাজি রেখে...আমাদের বাঁচানোর জন্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী আরো অন্যান্য দায়িত্বশীল  ওয়াকীবহাল ব্যক্তিরা আমাদের সাবধান করবেন, হাত জোর করে আবেদন করবেন, নিয়ম মেনে চলার। আর আমরা যা আজ করতে পারলাম না তার হিসাব করতে করতে , নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতি উপেক্ষা করে... খালি অপেক্ষা করব আবার সেই পুরোনো জীবন ফিরে পাওয়ার।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: