প্রবীর সিকদার, লেখক ও সম্পাদক, দৈনিক বাংলা ৭১, বাংলাদেশ:

শুধু কী ভারত বাংলাদেশ! করোনা আতঙ্কে লকডাউন সারা দুনিয়াজুড়ে! সেই লকডাউনেই কোলকাতার পার্কস্ট্রিটের আহমেদ আলিকে পাওয়া গেল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়! তখন আর তিনি পার্কস্ট্রিটের মাস্টার মশাই আলি হোসেন নন, তিনি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি ও মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন মাজেদ! এ যেন আচমকা জীবনের লকডাউনে চলে গেলেন বঙ্গবন্ধুর ক্যাপ্টেন মাজেদ কিংবা কোলকাতার মাস্টার মশাই আহমেদ আলি! হইচই পড়ে গেল বাংলাদেশে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে! নিশ্চিত করেই জানা গেল, বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ ২০/২২ বছর ধরে কোলকাতায় আসল পরিচয় গোপন রেখে বসবাস করছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তন ছাত্র পরিচয়ে তিনি ইংরেজির প্রাইভেট শিক্ষক ছিলেন। সেখানে তাকে আহমেদ আলি নামেই চিনতেন সবাই। কোলকাতার পার্ক স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের মানুষ তাকে মাস্টার মশাই বলেই জানতেন। খুব শান্ত স্বভাবের লোকটি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, একটি চায়ের দোকানে চা খেতেন ও একটি রেশনের দোকানে এক-আধটু আড্ডা দিতেন।

ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের জেরে কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের BPL-এর একটি তালিকার অংশবিশেষ আমার হাতে এসেছে। পার্কস্ট্রিটের বেডফোর্ড লেন, যেটা কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। ওই তালিকার ২৩ নম্বরে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদের ভিন্ন পরিচয়ের নাম আহমেদ আলি। নিজের নাম পাল্টালেও পাল্টাননি তিনি নিজের বাবার আসল নাম! বাবার নাম লেখা রয়েছে মো.আলি। তিন সদস্যের পরিবার তার, পরিবার প্রধান আহমেদ আলি, অন্য দুইজন নারী! তালিকার সাথে তার সেখানকার পরিবারের সদস্য সংখ্যার মিল রয়েছে; একজন তার স্ত্রী সেলিনা বেগম, অপরজন তার ৬ বছরের কন্যা। বাড়ির ঠিকানার ঘরে লেখা রয়েছে D2/12/H-34 বেডফোর্ড লেন, কোলকাতা ৭০০০১৬। কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের ওই BPL তালিকাটি ২০১৩ সালে তৈরি করা! পার্কস্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের এই বাড়িতেই সে অন্তত ৭ বছর ধরে ছিলেন, ওই তালিকাটি তার প্রমাণ দেয়; হতে পারে তার বেশিও! আমার সূত্রটি জানিয়েছে, ঘন ঘন বাসা পাল্টাতেন মাস্টার মশাই আহমেদ আলি। তখন তিনি থাকতেন একা। ২০১১ সালে উলুবেড়িয়ার সেলিনা বেগমকে বিয়ে করে পার্কস্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের এই ভাড়া বাড়িতে ওঠেন আহমেদ আলি ওরফে বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ। তার ওই ভাড়া বাড়িতে দিনের বেশিরভাগ সময়েই বাইরে থেকে তালা ঝুলানো থাকতো!
কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের BPL Household তালিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ তালিকা। BPL মানে হল Below Proverty Line। BPL Household তালিকায় যাদের নাম থাকে তারা দরিদ্র সীমার নিচে থাকা পরিবার। ওই তালিকাভুক্তদের নিয়মিত বিশেষ ছাড়ের খাদ্যপণ্য ছাড়াও ভারত সরকার ও কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন নানান আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে। সেখানে বলাই হয়, BPL তালিকায় যাদের নাম থাকে তারা সৌভাগ্যবান! আমার কোলকাতার সূত্র এটাও বলেছে, এই তালিকায় নাম ওঠাতে অনেক বড় বড় নেতা/কেউকেটার সুপারিশ দরকার; নইলে এই তালিকায় নাম ওঠে না কারো! এটা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না যে, বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদকে সেখানে বড় কেউ পৃষ্ঠপোষকতা করেছেই! নইলে ২০/২২ বছর ভারতীয় হিসেবেই পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে নির্বিঘ্নে কাটাতে পারেন না বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদ! বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদ নাম পরিচয় গোপন রেখে শুধু কী BPL তালিকায় নাম তুলেছেন, ভারতীয় নাগরিকতা প্রমাণের যা যা কাগজপত্র লাগে সব তার রয়েছে; যেমন আধার কার্ড ভোটার আইডি কার্ড রেশন কার্ড ও ভারতীয় পাসপোর্ট! কোলকাতার একজন তো বিস্ময়ের সাথেই বললেন, বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদ ওরফে আহমেদ আলির কাগজপত্র পাকা! তাকে মোদী সরকারের NRC ও CAA দিয়ে আটকানোও কঠিন হতো! ভাগ্যিস ব্যাটা ধরা পড়েছে, নইলে সে একদিন আমাদেরকেই ঘোল খাইয়ে ছাড়তেন!
এতকিছুর পরও বিস্ময় থেকেই যায়! বিস্মিত কোলকাতার পার্কস্ট্রিটের মানুষ, বিস্মিত বাংলাদেশের মানুষ! পার্কস্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের বাসা থেকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টা ৪ মিনিটে বেরিয়ে যান আহমেদ আলি ওরফে ক্যাপ্টেন মাজেদ! আর ফেরেননি তিনি স্ত্রী সেলিনা ও শিশুকন্যার কাছে। এব্যাপারে ওই দিনই অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধার পর পার্কস্ট্রিট থানায় মিসিং ডায়েরি করেন তার সেখানকার স্ত্রী সেলিনা বেগম। আহমেদ আলি ওরফে ক্যাপ্টেন মাজেদ বাংলাদেশের ঢাকায় গ্রেফতার হন ৭ এপ্রিল। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ এপ্রিল, এই দীর্ঘ ৪৫ দিন এই ক্যাপ্টেন মাজেদ ওরফে আহমেদ আলি কোথায় ছিলেন, জানে না কেউ! তারপর দ্রুততার সাথে আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ কিংবা কোলকাতার পার্কস্ট্রিটের মাস্টার মশাই আহমেদ আলির ফাঁসি কার্যকর করা হয় ঢাকার নতুন কেন্দ্রীয় কারাগারে! পার্কস্ট্রিটের অনেকের কাছেই সেটা এখনো বিস্ময়সূচকই রয়ে গেছে! যদিও সত্য এটাই, এতো সতর্ক ও সাবধানে থেকেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ তথা কোলকাতার পার্কস্ট্রিটের মাস্টার মশাই আহমেদ আলি! এই ঘটনা পুরো ভারতকে যেন চোখে আঙুল দিয়ে বহু কিছু দেখিয়ে দিল! এতো বড় হাই প্রোফাইলের ক্রিমিনাল ২২ বছর শুধু নিজেকে লুকিয়েই রাখেননি; নিজেকে ভারতীয় হিসেবে প্রমাণের সব কাগজপত্র সংগ্রহ করেছেন এবং ভারত সরকারের বিশেষ আর্থিক আনুকূল্যও ভোগ করেছেন! এ যেন অনেকটাই বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেড়োর মতোই! সবশেষে ভারতীয়দের কাছেই প্রশ্ন রেখে যাই, এমন আরও বহু অভারতীয় খুনি মাজেদকে আপনারা আহমেদ আলিদের নামে দুধকলা দিয়ে পুষছেন না তো?

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: