শ্বেতা ঘোষ, ফিচার রাইটার, নৈহাটি, উ: ২৪ পরগনা:

কোনও কোনও জীবন নিজেই হয়ে ওঠে একটা আলোকবর্তিকা। এমনই এক আলোকময় রাজনৈতিক আদর্শগত জীবন দৃষ্টান্তের কর্ণধার সদ্য প্রয়াত অবণীকুমার সাহা। তিনি কংগ্রেসি ঘরনার মানুষ হলেও আক্ষরিক অর্থেই গোটা বাঁকুড়া জেলার দলমত নির্বিশেষে ছিলেন আবালবৃদ্ধবনিতার অভিভাবক।
এহেন আদ্যান্ত মানুষ অবনীকুমার সাহার জন্ম ১০ ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৭ সালে। বাঁকুড়ার সোনামুখী গ্রামে এক দরিদ্র তপশিলি পরিবারের মাটির একতলা গৃহে।  তাঁর পিতা গোবর্ধন সাহার ইচ্ছা ছিল, তাঁর এই একমাত্র পুত্র শিক্ষায়, দীক্ষায়, শারীরিক, মানসিক দৃঢ়তায় আদর্শ মানুষ হয়ে উঠুক। দেশের ও দশের সেবায় নিয়োজিত হোক পুত্রের গোটা জীবন।
শুরু হল নিজেকে তৈরি করার পটভূমি। সোনামুখী বি. জে. হাইস্কুল হতে ম্যাট্রকুলেশন পাশ করেন ১৯৫৮ সালে। বিষ্ণুপুর শহরের রামানন্দ কলেজ থেকে হন স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি শরীরচর্চা, খেলাধূলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং নিজে এলাকার কিশোর যুবক ও সহপাঠিদের এই বিষয়ে অনুপ্রাণিত করতেন। বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ আকর্ষণ। বিষ্ণুপুরের রামশরণ  কলেজ অফ মিউজিকে, ওপেন ফোরামে বিনা বাদ্যযন্ত্রে গান গেয়ে পুরষ্কৃত হন একদা। শুধুই কি তাই? তদানীন্তন দেহসৌষ্টব প্রতিযোগিতায় ও ১০০ মিটার দৌড়ে প্রথম স্থান অধিকার ছিলো তাঁর এক সহজাত অভ্যাস। ভলিবলে তাঁর স্ম্যাশ ছিল প্রতিপক্ষের আতঙ্ক। শটপাটে তিনি যে দূরত্বে লোহার বল ছুঁড়তেন, তা দেখে অন্যরা মুখ লুকাতেন৷
ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় অবণীবাবু ছিলেন এক আকর্ষণীয় পন্ডিত ব্যক্তিত্ব। স্থানীয় বা জেলার স্তরে যেকোনও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় এমনভাবে তিনি অকাট্য যুক্তি উপস্থাপনা করতেন, সেটাকে খন্ডন করা অনেকের কাছেই ছিল স্বপ্নাতীত। যথারীতি তিনিই সেরা নির্বাচিত হতেন৷ আসলে তিনি আজন্ম সেরা হতেই জন্মেছিলেন।
সময়টা ১৯৬৫-৬৬ সাল। সারা বাংলা তখন উত্তাল খাদ্য আন্দোলনের অগ্নিশিখায় উদ্বুদ্ধ। প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি "তাম্রলিপ্ত স্বাধীন রাষ্ট্র" ঘোষণা করেছিলেন ও ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করেছিলেন সেই গান্ধীবাদী অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীল ধারার সঙ্গে আজকের প্রণব মুখোপাধ্যায় তথা দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি "বাংলা কংগ্রেস" গঠন করেন। মানীয় অবনীবাবুও ওই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে
সোনামুখী ( তপঃ) কেন্দ্র হতে পরাজিত হলেও সোনামুখী শহর ও পাশ্ববর্তী গ্রামের মানুষের মুখে খাদ্য যোগাতে এলাকায় এলাকায় তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযোগিতার লঙ্গরখানা চালু করেন। ১৯৬৯ সালে বাঁকুড়ার ইন্দাস তফশিলি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন ও সেই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্রতী হলেন একনিষ্ঠ পর্যায়ে।
এরই মধ্যে "বাংলা কংগ্রেস" দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যায়, এটাই ইতিহাস। তিনি আজীবন গান্ধীবাদে ও জহরলাল সামাজিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী, নির্ভিক দৃঢ়চেতা অন্যদিকে তাঁর অনন্য ঋজুচরিত্র, সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিল সর্বজন আদরনীয়। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে বাঁকুড়া-রায়না ( বর্ধমান) বি ডি আর রেললাইনকে ব্রড গেজে করার জন্য যে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল অবনীবাবুও ছিলেন পুরভাগে। ২০০৬ সালের ১জুলাই ওই আন্দোলনের ফলস্বরূপ ছোটরেল বি ডি আর (দঃ পুঃ রেলওয়ে) ব্রড গেজে ডিজেল ইঞ্জিন রেল চালু হয়েছিল। ১৯৭৭-২০১১ সময়কালের বাম সরকারের নানা অপশাসনের বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়েছিলেন ধারাবাহিক পর্যায়ে। ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি করা তৃণমূল কংগ্রেসের সোনামুখী ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। তারপর শারীরিক অসুস্থতার কারণে সক্রিয়ভাবে আর রাজনীতিতে অংশ নিতেন না ২০১১ সালের পরবর্তী সময়ে৷
তিন দশক যাবৎ সোনামুখী বিন্দুবাসিনী হাইস্কুলে শিক্ষকতা করা কালীন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গিয়ে অবণীবাবু ছাত্রদের দৈহিক, মানসিক, চারিত্রিক গঠনের দিকে সবিশেষ নজর দিতেন। তিনি পড়ুয়াদের উপদেশ দিতেন, স্বামী বিবেকানন্দ পড়তে হবে; মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি জানতে হবে; নেতাজী সুভাষের মতো স্বাধীনতাকামী হতে হবে; রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রবীন্দ্র নজরুলকে জানতে হবে। আরো একটা কথা তাঁর ছাত্রদের এখনও মনে পড়ায়, ওরে মহানায়ক উত্তমকুমারের মতো হেয়ার স্টাইল করেছিস ভালোকথা, কিন্তু তার মতো ঘাড়টা তৈরি করছিস না কেন?  তিনি ছাত্রদের বলতেন, পড়াশোনার সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম বিশেষত ফ্রি হ্যাণ্ড, যোগ ও নানাবিধ খেলাধুলা করতে হবে। বহুছাত্র তার অনুপ্রেরণায় নিজের জীবন গঠন করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছেন। আর্থিক অভাব উপেক্ষা করে নিজ ভ্রাতা তথা চিকিৎসক পুলকেশ সাহার পুত্র কল্লোল সাহাকেও ডাক্তারি পড়িয়েছেন। কল্লোলবাবুর জানান, অবণীবাবুর জীবন ছিল আদর্শে মোড়া। তাঁর বিধায়কের ভূমিকা আজও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।
চলতি মাসের ১২ তারিখ তিনি মারা যান। প্রাকৃতিক নিয়মে তিনি চলে গেলেন ঠিকই কিন্তু রেখে গেলেন একটা গোটা মানবসত্ত্বার রাজনৈতিক সহাবস্থান। যে অবস্থান আজও এলাকার মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয় আর আপোষহীনতায় বাঁচতে শেখায়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: