মৌসুমী মন্ডল, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

"বর্তমানে প্রকৃত কাজ হচ্ছে, সর্বপ্রকার তাৎপর্য ও অর্থবোধের সঙ্গে ভারতের সর্বত্র 'জাতীয়তা' শব্দটি প্রচার করা। এই বিরাট চেতনা যেন সবসময় ভারতের সম্পূর্ণভাবে অধিকার করে থাকে। এই জাতীয়তার দ্বারাই হিন্দু ও মুসলমান দেশের প্রতি এক গভীর অনুরাগে একত্র হবে।"
        বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের সত্যিই এক মনীষীর দরকার। এমন এক মনীষী যাঁর প্রাণ থাকবে ভারতের কাজে সর্বদা নিবেদিত। ভারত পেয়েওছিল এমনই একজনকে। তৎকালীন ভারতের অশান্ত পরিবেশকে শান্ত করতে তিনি এসেছিলেন আয়ারল্যান্ড থেকে এক ভারতীয়রই হাত ধরে।
             সালটা ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ। এই বছরের নভেম্বর মাসে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল এক পারিবারিক আসরে স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যা শোনেন। স্বামীজি-র ধর্মব্যাখ্যা ও বেদান্ত জ্ঞানে তিনি অভিভূত ও মুগ্ধ হয়ে যান। সিদ্ধান্ত নেন বিবেকানন্দের সান্নিধ্য লাভ করার। ১৮৯৮ সালের ২৮শে জানুয়ারি স্বদেশ ও পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে মার্গারেট চলে আসেন ভারতে। এই সময়ই তিনি স্বামীজি-র কাছে থেকে ভারতের ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, জনজীবন, ভারতের মহাপুরুষদের জীবনগাঁথা শুনে ভারতকে জানতে শুরু করেন। ভারতে আসার কয়েকদিন পরেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় মা সারদার সাথে। ম্লেচ্ছ জ্ঞান করে বাংলার সমাজ প্রথমে তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সারদা মা তাঁকে কাছে  টেনে নেন। এরপর আসে সেইদিন। অর্থাৎ ২৫শে মার্চ। বিবেকানন্দ তাঁকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেন। মার্গারেট হয়ে ওঠেন নিবেদিতা।
      ভারতে যখন ব্রিটিশদের বুটের চাপে হাজার হাজার প্রাণ অতিষ্ঠ, হাজার তরুণের রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে ঠিক সেই সময়ে বাংলার ঘরে ঘরে নিভে যাওয়া প্রদীপকে নতুন করে তিনি প্রজ্জ্বলিত করতে এগিয়ে এলেন। এক আধুনিক দেশের আধুনিক জীবন যাপন  ছেড়ে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে চলে এলেন এক জ্বরা-ব্যাধি জর্জরিত দেশে। জাত-পাতের শিকার তাঁকেও হতে হয়েছে। একবিংশ শতকের মতো যখন ঊনবিংশ শতকও পরাধীনতার আগুনে, ধর্মের আগুনে, ক্ষিদের আগুনে জ্বলছে ঠিক সেই সময়ে হাজার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে নিবেদিতা ভারতবাসীকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তাঁর উপরেও উঠেছিল লক্ষ লক্ষ আঙুল। তাঁর ধর্ম নিয়ে, তাঁর জাত নিয়ে, এমনকি নাগরিকত্ব নিয়েও তাঁকে বহুকথা শুনতে হয়। তাও তিনি ভারতের হিন্দু-মুসলিমের একাত্মতা নিয়েই ভেবেছেন। ভেবেছেন ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে।
       শুধু সময়টা বদলেছে। একই পরিস্থিতি এসেছে নতুনের মোড়কে। শাসক বদলেছে কিন্তু রক্তচক্ষু তার একই আছে। সে ঊনবিংশ শতক হোক বা একবিংশ শতক। জারি আছে ধর্মান্ধতাও, ধর্মযুদ্ধও। নেই শুধু এক নিবেদিতা, ভারতের জন্য এক নিবেদিত প্রাণ। তিনি ছিলেন আগন্তুক। এক বিদেশিনী। যিনি প্রথম বিশ্বের এক প্রথম জীবনকে পিছনে ফেলে রেখে এক বিদেশী রাষ্ট্রের উপনিবেশে এসে ধর্মান্ধতার মাঝে ধর্ম শেখাতে এসেছিলেন। তিনিই তো আসল ভারতীয়। যে দেশের মূল কথাই হল 'বসুধৈব কুটুম্বকম্' সে দেশে হাজারো নরেনের হাত ধরে আসুক মার্গারেটরা। শুধু ২৫ শে মার্চ না, প্রত্যেকটা দিন মার্গারেটদের ভিতর নিবেদিতার জন্ম হোক। যাদের কাছে নাগরিকত্বের প্রমাণ, ধর্মের প্রমাণ, জাতের প্রমাণ চাইতে গিয়ে যেন আবারও এক ইতিহাস সৃষ্টি  হয়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours