শামা আরজু, লেখক, বাংলাদেশ:

ভাগিস আমার কোনো আশাই নেই!
হতাশা নাকি পাপ। বাবা বলতেন।আবার সেই তিনিই চরম হতাশা নিয়ে চলে গেলেন, বড় অসময়ে।অভাবের কারণে, স্রেফ  চিকিৎসার অভাবেই চলে গেলেন আমার বাবা। যিনি আমাকে পড়ার জগতে বিচরণ করতে শিখিয়েছিলেন।আমি এখন পড়িনা বললেই চলে।
বাবা একসময় এমনও বলেছিলেন, সামান্য কিছু জানতে হলেও পড়ার জন্য অন্তত হাজার বছর বাঁচা দরকার।হাজারটা দরকারকে পায়ে দলে বাবার চলে যাওয়াই ঠিক হলো।
কি হবে অতো পড়ে! শেষমেশ তিনিই বলতেন। তবু পড়াটা ছাড়েন নি।
নেশাগ্রস্ত ছিলেন বাবা।
চা -কফি,পান- সিগারেট, গাঁজা-বাবা কোনোটাতেই না।না,চাঁদের আলো খাবার মতো বিলাসী নেশাও তাঁর ছিলোনা।
বাবার নেশা ছিলো পড়া আর অন্যের কাজে ব্যবহৃত হয়ে মায়ের বকা খাওয়া।
বাবার বিছানা গুছানো যেতো না।রেগে যেতেন।বিছানার মাথার দিকটা ভরে থাকতো বইয়ে।বই, খবরের কাগজ, ডিকশনারি - কয়েক রকম।
আমার মেয়ে ছোটবলায় দোকান দেখলেই ছাগইল্যা খুঁটি ধরতো।আর কি তাকে হাঁটানোর উপায় আছে! অগত্যা কোলে তুলে নিতাম। আমার ছোট্ট শরীর।ওর নাদুসনুদুস শরীর।কোলে উঠেই দুইহাতে আমার চুল ধরে টানাটানি।বাপরে বাপ,চুল কেন ছিঁড়ে না! মাঝেমাঝে হাতের মুঠো পরখ করে দেখে চুল হাতে উঠে এলো কিনা। নইলে আরো কষে টান।
দোকানে না ঢুকে উপায় নেই।কোল থেকে নেমেই ছুটাছুটি, সিদ্ধান্তহীনতা।
মা, আমি কোনটা নিবো?
মা,আমি কোনটা খাবো?

আমার বাবারও অনেকটা সেরকম অবস্থা ছিলো পড়া নিয়ে।
আমার বইপড়া বাবার পছন্দে।বাবার পড়া বইগুলি পড়ার সাহসই পেতাম না।মার্ক্স -এঙ্গেলস।তার ওপর বেশিরভাগই ইংরেজি।তবু প্রায়ই বলতেন,আমার বইগুলি তুই নিয়ে যা। আমার বাসায় আমারই জায়গা ছিলো না।নেবো নেবো করে আর নেয়া হলো না।বাবার মৃত্যুর পর বই গুলির হদিস কেউ দিতে পারলো না।ভাইবোন সবাই একজন আর একজনকে দেখায়।সম্পদ বলতে বাবার বই ছাড়া কিছুই ছিলোনা।
বাবার পায়ে কখনও চামড়ার জুতা দেখিনি।এ ব্যাপারে কিছু বললে বলতেন- নজর অতো নিচের দিকে দিতে নেই।ঈদ এলে বলতেন- তোদের জাকাত ফিতরার টাকা আমায় দিস, আমি এতিম। তোর মায়ের তো একখান সোয়ামী( স্বামী) আছে।আমার তো তাও নেই।

অফিসে স্টীলের আলমারীর পেছনে চৌকি পাতা ছিলো।শ্বাসকষ্ট খুব বাড়লে স্যালাইন দিয়ে শুয়ে পড়তেন।শোয়া থেকে উঠে আবার অফিস।ডাক্তারের পরামর্শে শেষতক চাকুরীটা ছাড়তেই হলো।
কিন্তু সংসার যে আর চলে না।আমি দানব স্বামীর ঘরে।আমার বেতনের টাকা সব মুঠ করে নিয়ে যায়।মেজোবোনের টাকাই একমাত্র ভরসা।কিছুদিন পর বাড়ির কাছের কলেজের কেরানীগিরিতেই আবার লাগলেন।গরম পানির ফ্লাস্ক হাতে নিয়ে দমের সাথে যুদ্ধ করে পায়ে হেঁটেই বাবা আবার অফিস করেন।সামান্য কয়টা টাকার জন্য চাকুরী ছেড়েও বাবা আবার চাকুরী ধরলেন।
রিকশায় উঠতেন না বাবা।এই নিয়ে ছোট ভাইয়ের সে কি রাগ বাবার ওপর! কিইবা বয়স তখন ওর।কলেজে পড়ে আবার বাবার অফিসের কাজও করে দেয়।সপ্তাহে দুই তিনবার বাবাকে স্যালাইন দেয়া লাগে।দুপুর - রাত, কিংবা ভোররাতে উঠে সেলিম ভাইকে ডেকে তুলে আনতে হয়। শীতের ঘুম।ক' দিন কার সহ্য হয়! বাবার চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করে অবশেষে সেলিম ভাইকে ডেকে এনে বাবার স্যালাইন পুশ করানো।

মাঝেমাঝে আলমারীতে হাত দিয়ে সবাই থ।টাকা নেই।বড়ভাই চুরি করে নিয়ে গেছে।প্রভাতী ক্লাবে সিনেমা দেখবে। কিংবা গাঁজায় নাক ডুবাবে।মা বলতেন,তোদের দাদী জোর করে আল্লাহর কাছ থেকে ওকে কেড়ে এনেছে,তাই ও এমন হয়েছে। বাবা বলতেন আমার এই দু'টো ছেলে হলো কেন,কেন এই দু'টোও মেয়ে হলোনা!
আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তা সব সময়ই তাড়িয়ে বেড়াতো বাবাকে।মাকে বলতেন,তোমার এই মেয়ে হয় আত্মহত্যা করবে নতুবা পাগল হবে। '৯৬ তে বাবা মারা গেলেন।আমি স্বামী দানবের থাবা থেকে নিজকে মুক্ত করি ২০০১ এ।নইলে আমার সংসার ভাঙ্গার দায় বাবাকেই বয়ে বেড়াতে হতো।
 আমিও জানতাম একদিন একা হয়ে যাবো খুব কিন্তু এতটা খারাপ লাগবে বুঝিনি।
পড়তে পারলে হয়তো অনেক ভালো থাকতাম।
সন্ধ্যায় বাবার বাড়ি থেকে আমার বাসায় ফিরছি।মা পেছন থেকে ডাক দিলেন।
তোর বাপকে বলে যা,রাত জেগে যেন বই না পড়ে।
আমি বাবার দিকে তাকাতেই চোরের মতো বই বালিশের নিচে লুকাতে গেলেন।
আপনি এমন কেন করেন? রাত জাগেন,প্রেসার বাড়ে,শ্বাসকষ্ট বাড়ে।নিজে কষ্ট পান,সবাইকেও দেন।
বাবা কোনো কথা বলেন না।
মা ই আবার বলেন-
তুই যাবার পরপরই আবার বই হাতে নিবে।
আমার চলে যেতে হবে। কথা বাড়িয়ে কি আর হবে।বাবা অমনই।
পরদিন ভোরবেলাতেই ইনহেলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাবা মারা গেলেন।ভাইকে তাগিদ দিচ্ছিলেন দৌড়ে গিয়ে সেলিম ভাইকে ডেকে আনতে।
বাবার মৃত্যুর পর মা রাতারাতি ফর্সা আর মোটাসোটা হয়ে গেলেন।বাবার অসুখ মাকে ঘুমাতে দিতো না।আমার মায়ের মতো অতো রাতজেগে সেবা করা মানুষ আছে বলে আমার জানা নেই।
এবার মা অসুস্থ।আসলে মা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন।সেটা দেখার মতো আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
নোয়াখালী থেকে ঢাকায়।মা'র মাথায় অপারেশন করতে হবে।ভালো হবার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি। অপারেশন না করলে ১০০%সম্ভাবনা,মা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবেন।
একমাসে মা" র চারটা বড় অপারেশন হলো।অপারেশন ফেল।আমি একমাস মেডিক্যাল ছুটি নিয়ে মা'র সাথে।আমার বস আমার পাঠানো দাপ্তরিক কাগজ গ্রহন না করে আমাকে অনুপস্থিত দেখালেন। বস ইজ অলওয়েজ রাইট আজও আমায় ছাড়েনা।
আমি এ সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।সে ইচ্ছা আমার কস্মিনকালেও ছিলো না। হবে না।হোক, তাও চাই না।
 আজকাল প্রায় সবই ছেড়ে দিয়েছি।ডানের বিভৎসতা বামের বিকৃতি,ভনিতা আর হজম করতে পারছিনা।প্রেসক্লাবে মাঝেমধ্যে যাওয়া হয়।ওখানে আগে শেখ মুজিবের ছবির বিপরীতে বাঘের একটা ছবি ছিলো।এখন নেই।আমি ওই ছবিটা অনেক মিস করি।
মাধু জ্যাঠার একটা ছবি ঝুলানো আছে। ওটার দিকে তাকালে বাবার অভাবটা...।
কি হবে অতো পড়ে-বলেও বাবা পড়তে পড়তেই মরলেন।আমি কেন অমন হতে পারলাম না? বাবা আমার ভেতরেই তো তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছের বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন। ভাই, যেটা নষ্ট হয়ে গেলো- বাবাকে দেখিয়ে তাকে বলেছিলেন,আমি তোর বাবাকে গুরু মানি আর তুই তাঁকে চিনলিনা! দুলাল ভাইদের এই এলাকার বড় বড় বামনেতাদের চিনিয়েছেন জাহাঙ্গীর বুলবুল।আর তাঁর সাথে বাবাকে নিজের গুরু বলে পরিচয় করিয়ে দেন  মাধুজ্যাঠা।বাবার রাজনৈতিক জীবনের বন্ধুরা বাবাকে মনে রাখেন নি,তাঁর দুঃসময়ে। মাধুজ্যাঠা আর বুলবুল ভাই শেষপর্যন্ত বাবার সংগে ছিলেন।বাবার মৃত্যুর পর বুলবুল ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় কলম নিয়ে বসি। হঠাৎ তিনিও একদিন নাই হয়ে গেলেন।
আমি বিশ্বাস করতে চাইনা ভাইয়া নেই।অপেক্ষায়য় থাকি কোনো একদিন হঠাৎ তাঁর ফোন আসবে।যেখানে মামা কাকা খালুদের হাত থেকে রেহাই পাইনি সেখানে এই মানুষটাই কেবল বুঝিয়েছিলেন আমি নেহায়েৎ এক টুকরা মাংস নই।আমি মানুষ।এটা নির্ধিধায় কেবল তাঁর সামনেই মনে হতো।আমার কাছে তিনি ছিলেন আমার বাবার স্মৃতি।
সবকিছুই আজকাল খুব তুচ্ছ মনে হয়।পড়াও।এমনকি লেখাও।
পড়তে চাইলেও মনোযোগ দিতে পারিনা।পড়া ছাড়া লেখাও ভালো হয় না।
কি হবে অতো পড়ে-বলেও বাবা পড়তে পড়তেই মরলেন।আমি কেন হতে পারলাম না? বাবা আমার ভেতরেই তো তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছের বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন।

মারা যাবার ঠিক দশদিন আগে বুলবুল ভাই আমাকে ফোনে বলেছিলেন,সারাটাজীবন বাইরে থেকে এখন নিজের ঘরকে আর নিজের মনে হয়না।খুব টেনশন হয়- কিভাবে শেষ জীবনটা কাটাবো? আমি বাসে তখন।ভাইয়ার কথায় আগ্রহ না দেখিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।আর কোনোদিন জানতেও চাইলাম না আর কি কথা বাকি ছিলো? কি অদ্ভূত সরল মানুষ ছিলেন! মাঝেমধ্যে বলেছিলেন- আমি শেষজীবনে আমার পিংকীমায়ের কাছেই থাকবো। পিংকীকেও বলিনি কোনোদিন কথাটা।আমি বিশ্বাস করতে চাইনা ভাইয়া নেই।অপেক্ষায়য় থাকি কোনো একদিন হঠাৎ তাঁর ফোন আসবে।যেখানে মামা কাকা খালুদের হাত থেকে রেহাই পাইনি সেখানে এই মানুষটাই কেবল বুঝিয়েছিলেন আমি নেহায়েৎ একটুকরা মাংস নই।আমি মানুষ।এটা নির্ধিধায় কেবল তাঁর সামনেই ৃনে হতো।আমার কাছে তিনি ছিলেন আমার বাবার স্মৃতি।
সবকিছুই আজকাল খুব তুচ্ছ মনে হয়।পড়াও।এমনকি লেখাও।
পড়তে চাইলেও মনোযোগ দিতে পারিনা।পড়া ছাড়া লেখাও ভালো হয় না।
কি হবে অতো পড়ে-বলেও বাবা পড়তে পড়তেই মরলেন।আমি কেন হতে পারল না? বাবা আমার ভেতরেই তো তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছের বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন।

আমার কিন্তু কোনোই ইচ্ছে নেই,স্বপ্ন নেই।স্বপ্ন দেখার সাহস হারিয়েছি সেই কবেই!

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours