প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

মহাভারতকারের কথায় বায়ু দেবতা মৃগতে চেপে কুন্তীর কাছে এলেন, আচ্ছা সম্ভব!  বৈদিক যুগে যজ্ঞে মূর্তি ব্যবহার ছিল না। তবে কি যাস্কের নিরুক্তে যে দেবতার আকার নিয়ে প্রশ্ন, সেখানে কি ঈশ্বরকে নির্মাণ করা হলো মনুষ্যরূপে!! যাস্ক মানলে মেনে নিতে হয় যে, দেবতারাও মানুষের মতো একটি সুসংহত সমাজ রাষ্ট্রে বাস করেন। কিন্তু, সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, পর্জন্যরা সেই রাষ্ট্রের বাসিন্দার নন। বিপদ থেকে প্রাণের প্রার্থনার তাগিদ নিয়েই এই বিগ্রহধারীর প্রতিষ্ঠা। " A crucial ingrediant in folk religion is the immediate presence of and access to a god or a goddess....  Which may be iconic or aniconic."

বলতে দ্বিধা নেই, যে ধর্মকে সংগমে  আলিঙ্গনে নিয়েছিলেন কুন্তী, সেখানে বায়ুদেবতা, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নেই কেন?  আসলে তিনি যে মৃগচর্মাবৃত ব্যক্তি।  বায়ু ও মৃগ অন্বিত ব্যক্তি যে পূর্ণপ্রাণে জড়াতে পারেন নি তাঁকে। দুর্বাসার সাথে মিলনে জাতক যে কানীনপুত্র কর্ণ,তাই অসুখকর ; তাকে স্মরণ করেই তো নিষ্ঠার অনুরাগ কাঁদে। কুন্তীকে উদাস দেখা গেছে বহুবার৷ এই ঔদাসীন্যের জন্যই কি মহাভারত পর্বে ভীমের মাতৃকোল থেকে স্খলন ; অর্জুন,  ইন্দ্র সাধনার ফসল৷ কিন্তু কে এই ইন্দ্র!  প্রতিষ্ঠা আছে তাঁর! নেম ভার্গব মনে করিয়ে দিলেন সংশয় যে ঘটনার বুকে পরজীবীর মতো আঁকড়ে অস্তিত্ব বহন করতে চায়!  ঋষি গৃৎসমদ মনে করিয়ে দিলেন, এই ইন্দ্র তো আর্যদের সেনাপতি। তিনি বললেন, যে পুষ্টি থেকে শত্রুসম্পত্তি সব দিয়েছে, সেই ইন্দ্র। ইন্দ্র তবে কি একটা পদ! আনাতোলিয়ার বোঘাজ - কো-ঈ শিলালেখতে ইন্দ্র পরাক্রান্ত সেনাপতি। ঋষি  ভার্গব ইন্দ্রের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন।  ঠিক তখনই বার বার প্রায় ১৪ বার বলেছেন, স জনাস ইন্দ্রঃ। 
শেষপর্বে দেখা যায়, পাণ্ডুর রক্ত যে ব্যক্তির ধমনিতে প্রাবাহিত সেই পাণ্ডবদের উত্তরাধিকারিত্ব অর্জন করে৷ পাণ্ডুর পুত্র অর্জুন।  অর্জুন পুত্র অভিমন্যু।  অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিৎ। পরীক্ষিৎ এর পুত্র জন্মেজয়৷ যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠির যখন মহাপ্রস্থানের পথে গেলেন তখন অভিষিক্ত হয়েছিলেন পরীক্ষিৎ।
কিন্তু আদিপর্বে ১০৬ তম অধ্যায়ের ১০ নং শ্লোকে মহাভারতকার পাণ্ডুকে ইন্দ্রের সঙ্গে উপমিত করেছেন৷ তিনি ১১৭ তম অধ্যায়ের ১০ নং শ্লোকে লেখেন "অথাজগাম দেবেন্দ্রো জনয়ামাস চার্জ্জুনম, অর্থাৎ ইন্দ্র এলেন এবং কুন্তীর গর্ভ উৎপাদন করে অর্জুনের জন্ম দিলেন। এবার নিশ্চয় বুঝতে অসুবিধা নেই ওই " দেবেন্দ্রো" আসলে পাণ্ডু। মাদ্রীর উপর কুন্তীর ক্ষোভ চিরকালের৷ কুন্তিভোজকে যেদিন অনেক অলংকার যৌতুকে দিতে হয়েছিল, আর মাদ্রীকে?  বিচিত্র সব অলংকার দিয়ে মাদ্রীকে ঘরে আনেন ভীষ্ম।কুন্তী বলেছিলেন, "মাদ্রী তুমি তো ভাগ্যবতী ; তুমি হৃষ্টচিত্ত রাজার মুখ দেখেছ, আমার তো সেই সৌভাগ্য হয়নি। "
এই দুঃখ কুন্তীর চিরকালের ; বাবার কাছেও আদর পান নি, আর শ্বশুর বাড়িতেও না।

কুন্তীর বাবা যাদব বংশীয় আর্যক শূর৷ কৌটিল্যের "অর্থশাস্ত্র " বলছে, তাঁর অঞ্চল ছোট ছোট সংঘে গড়ে উঠেছিল৷ তিনি ছিলেন সংঘাধিপতি৷ আর এই সংঘের অধিপতি ছিলেন কুন্তীভোজ।  আর্যক শূরের প্রথম কন্যা পৃথা। কিন্তু হরিবংশ বলে, কুন্তিভোজের বয়স বেড়েছিল। তিনি প্রিয় বন্ধু আর্যক শূরের কাছে একটি সন্তান চান। আবেগতাড়িত শূর প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, বললেন প্রথম সন্তান যা হবে তাই তিনি দান করবেন। প্রথম সন্তান হলেন মেয়ে। তাই পৃথা কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা। পৃথা তো প্র‍থম সন্তান, তাও বাবা দিয়ে দিলেন অন্যের হাতে!  তবে কি মেয়ে বলে!!  তাই তো পিতাকেই দুষেছেন তিনি। জন্মদাতা পিতা তো স্নেহ ডোরে তাঁকে বাঁধেন নি, আবার পালিত পিতাও তেমন ভাবে মেনে নেননি। পিতৃত্বের মাধূর্য তিনি কোনোদিন পান নি, তাই পিতা বলে আহ্লাদ - আদিখ্যেতা দেখাননি। বরং তাঁকে "রাজন", "রাজেন্দ্র", "নরোত্ম", " নরেন্দ্র" প্রভৃতি সম্ভ্রমসূচক সম্বোধন করেছেন।

শৈশব পেরিয়ে কৈশোর তখনও আসেনি৷ অন্তঃপুরের রাশ ধরিয়ে দিয়েছিলেন কুন্তীর কাঁধে। না কোনো অনুযোগ নেই। তবুও পুনঃপুনঃ মনে করিয়ে দিয়েছেন কুন্তীর বংশ পরিচয়। দত্তক নিয়েছিলেন, কিন্তু আত্মজাজ্ঞানে নিজের বলে গায়ে মাখেন নি। অন্তঃপুরের অতিথিবর্গের পরিচর্যা করেছেন৷ স্বভাবতঃ যেদিন দুর্বাসা মুনি অতিথি হয়ে এলেন, তুষ্টির গুরু দায়িত্ব পড়ল কুন্তীর উপর। দুর্বাসা তো রাগী কোপনস্বভাব মুনি। উগ্রতপস্বী দুর্বাসার সেবায় সবটুকু দিলেও মুনি তাঁকে বকাঝকা করতে লাগলেন৷ কিন্তু কোথাও কুন্তীর প্রতি প্রীতি ভালোবাসার অঙ্কুর দেখা দিয়েছিল৷ তারপরেই বলেছেন, " তিনি ওই সময় এমন কার্য করিয়াছিলেন, যাহাতে আমার কোপ হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা ; কিন্তু স্বীয় বিশুদ্ধচিত্তপ্রভাবে কিছুতেই রোষাবিষ্ট হই নাই। " যদি তাই হয়, তবে কি হয়েছিল!  না উত্তর দেয় না মহাভারত। এক বছর কুন্তীর সেবাকর্মে দুর্বাসা কোনো  ত্রুটি খুঁজে পাননি। ততদিনে দুর্বাসা বুঝে গেছিলেন, কুন্তীর সন্তান প্রজননের সমস্যা আছে। সমস্যা মেটানোর আগ্রহ দেখান৷ কুন্তী না বললেই তিনি পুরুষাকর্ষক মন্ত্র দিলেন। আচমকা উধাও হলেন। এরপর বালিকা কিশোরী হয়েছেন ; ঋতুমতী হয়েছেন, রজস্বলা অবস্থাতেই দুর্বাসার বর তাঁর জীবনে বিপত্তি ডেকে আনে। এইভাবেই ঘটনাবৃত্তে অলৌকিকতার মোড়কে প্রাণ পায় কল্পনারা। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours