প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

মাধব তো জীবনরসিক। সেই জীবনে আগুন আছে, জলও আছে। মৃত্যু যে অনিবার্য, তাকে নিয়ে সংশয় কই!!  পার্থিব ভোগ তো পথ নয়, আবিষ্টমন প্রভাবের অনুকরণ। এই জীবন অনুরাগ তো থাকবেই। পৃথিবীর বুকে প্রশ্নাতীত আনুগত্য মাধব মেনে নেন নি। সত্যভামার মধ্যে প্রশ্নাতীত সমর্পণ ছিলো না, তাই তো প্রিয় ভার্যা হয়েছিলেন। সচেতনে প্রেমিক সন্ন্যাস যদি আনুগত্যের সমর্পণ হতেন, তবে বুঝতে হবে তিনি রুক্ষ্মিণী প্রাণা হতেন। প্রিয় ভার্যা সুখ নিঃসংশয়ের আনুগত্যের কাম্য নয়। সখা কৃষ্ণকে তো এইভাবেই আনুগত্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন দ্রৌপদী। অপমানের জ্বালাকে নারী হৃদয়ে মনোলোকে বহন করতেন। নিভে যায় নি হৃদয়, সাথে আরো প্রকট হয়েছে আগুন।ধর্মপালনের নামে আয়োজনের মনোনিবেশকেও তিনি প্রশ্রয়দান করেন নি। দ্রৌপদী স্মৃতিমুখী। যুক্তিস্রোতে বইছে তাঁর জিহ্বা। অতীতচারণা যে প্রেমালিঙ্গণের মতো চন্দন সম সৌরভ দেয় না, তাই নীরবতার অনলে স্তব্ধ আকাশেই আশ্রয় তাঁর৷ তিনি যে পতিব্রতা বীরপত্নী, ক্ষাত্রনাশী অগ্নি প্রজ্জ্বলনের প্রতীকী অবয়ব৷

যুধিষ্টির ক্ষত্রিয় ক্রোধের অভিপ্রেত অবয়ব হয়ে গড়ে ওঠেন নি৷ কিন্তু সময় বুঝে মৃদু কঠোর তো হতেই হয়৷ প্রহ্লাদের কথায় নির্বিকল্প আস্থাজ্ঞাপন অভিপ্রেত নয়৷ " কালো মৃদুর্যো ভবতি কালে ভবতি দারুণঃ"।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মুহুর্তে জল ওঠার সময়। প্রহারে ক্ষমা নয়, আগুনের জ্বালানি ছুঁয়েই তো প্রতিশোধ। কিন্তু তেজ সেতো ক্রোধের বুকে হাত পেতে থাকা সাধারণীর নাম৷ তবে কি দ্রৌপদী নাস্তিক!  কি বলছেন যুধিষ্ঠির!! যিনি শত্রুবিনাশের জন্য বারো বছর যজ্ঞের  আগুনের পাশে মাটিতে বিছানা করে শুয়ে ছিলেন,  সেই তপোব্রতা নারী কিনা "নাস্তিক!"
দ্রৌপদী বললেন মানুষ নিষ্ক্রিয় হলে অলক্ষ্মী তাঁকে আশ্রয় করে৷ মানুষ দেবলোকের পুত্তলিকা। প্রশংসার যোগ্য তো তিনি, যিনি কর্মের উপর নির্ভর করেন৷ দৈব কেন,  বিপদমুক্তিই একমাত্র পুরুষাকার অবলম্বন। কৃষ্ণ বললেন, অকর্মণ্যের মতো সংসার - ঔদাসীন্য নয়, ক্লীবের মতো অস্ত্র পরিহার নয়, কর্মই ধর্ম।

ভক্তি মানে আনুগত্যের আত্মুঅবিশ্বাস নয়। তিনি কৃষ্ণকে ভগবত পুরুষ বলেন নি। আলোকসামান্য সম্পর্কের রসায়নে তাঁরা অভিন্ন বেদীতে আসীন। কৃষ্ণ তো তাই চেয়েছিলেন। অযৌক্তিক আবেগে নয় আগে নিজেকে বিশ্বাস করো। সমর্পণ করো, কিন্তু নিজেকে ভুলে আত্মবিলীন নয়। তবে কৃষ্ণ তাঁকেই বিয়ে করলেন না কেন!! আসলে একদারনিষ্ট পুরুষ তো শ্রীকৃষ্ণ নন। হরিবংশ বলছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে তিনি বিশ্বাসী নন। তাই তো সেরা সুন্দরী রুক্ষ্মিনী তাঁর স্ত্রী। সেখানে রুক্ষ্মিণী বললেন, "তোমার মতো বীরের যা প্রাপ্য, যা সিংহের শিকার, তা যেন শেয়ালে না চুরি করে। " কোথাও তিনি বুঝিয়ে দিলেন, রুক্ষ্মিণী তাঁরই প্রাপ্য৷ তাঁর ছিল অখন্ড আনুগত্য, কিন্তু বৈদগ্ধ্য বা বিলাসিনীর চাপল্যে ছিলো না। 

আর জাম্ববানকে হারিয়ে তাঁর দুহিতাকে বিবাহ করেন মাধব৷ কিন্তু জাম্ববান রামের যুগেও আবার কৃষ্ণের যুগেও। এও কি সম্ভব!! আসলে জাম্ববান পদ। সত্যভামার বাবা সত্রাজিৎ সূর্যের উপাসক। সত্রাজক সূর্যের কাছ থেকে স্যমন্তক মণি পেয়েছিলেন। কৃষ্ণ তাকে যেভাবেই হোক পেতে চাইলেন। এতো উগ্রসেনের উপযুক্ত। সেই মণি চলে যায় প্রসেনের কাছে। প্রসেন মৃগয়াতে গেলে সিংহের কবলে নিহত হলে তার দায়ভার কৃষ্ণের উপর এসে পড়ে৷ তিনি মণি উদ্ধারে জাম্ববানের সাথে লড়াই করেন৷ ঋক্ষবান পর্বতের জাম্ববতী গুহায় কৃষ্ণ বহুদিন লুকিয়ে থাকেন, এবং জাম্ববানকে হারিয়ে সস্ত্রীক ফিরে আসেন। তবে এখানেই শেষ নয়, তালিকায় ছিলেন নাগ্নজিতী, কালিন্দী, মিত্রবৃন্দা, ভদ্রা, লক্ষ্মণা।

কৃষ্ণার সময় তো মাধব  যৌবনাবস্থায় ছিলেন। কিন্তু গৌরক্ষা বাণিজ্যজীবী বৈশ্যরা উচ্চবর্গীয় চোখে স্থান পায় নি। দ্রৌপদী কোথাও তাঁকে ভগবান বলে পুজা করেন নি। কৃষ্ণ নিজের সামর্থ্য এবং দূর্বলতা অবগত ছিলেন৷ আর এই কুন্ঠা তাঁকে সখা করে রেখেছিল, স্বামী হয়ে দেয়নি। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours