কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতাঃ

মেগা হিট রোদ্দুর রায়। এতদিনে।
"অমলকান্তিও রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।"
অজিত পান্ডের গলায় যখনই ওই গান শুনতাম, কেমন যেন এক মনখারাপ পেয়ে বসতো। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই "অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি"।

যুগ বদলেছে। সাইবার দুনিয়া। আপনার কীর্তি আপনি চাইলেই ভাইরাল। উন্নয়নের জোয়ার মননে, সমাজে, রাজ্যে, দেশে। সেই সঙ্গে সময় এসেছে উন্নয়নের ঠ্যালা সামলানোরও। রোদ্দুররা অবশ্য আজ ঝুপ করে মঙ্গল গ্রহ থেকে একলাফে ঋষি বঙ্কিমের শস্য শ্যামলাং, সোনার বাংলায় নেমে এসেছে তা মোটেই নয়।
উন্নয়ন শব্দটা শুনেই 'অমমতাময়ীরা' হাততালি দিয়ে নেচে উঠতেই পারেন। ভাবতে পারেন, বেশ হয়েছে। রাজ্যের উন্নয়নের অনুপ্রেরণাকে এসুযোগে বেশ ঠোকা গেল। কিন্তু বাস্তববাদীরা জানেন, বাংলায় উন্নয়ন চাষের ইতিহাসটা। আর সংস্কৃতির ফলনটাও কেমন ছিল, তাও অজানা নয়। সমরেশ বসুর উপন্যাস বিবর অশ্লীল। অশ্লীল উষা উত্থুপের গান। তাহলে কী আজকের রোদ্দুর অতীতের সেই সমরেশ বসু, উষা উত্থুপের আধুনিকতম সংস্করণ? মোটেই না। বরং উল্টোটাই। তিনি উষা উত্থুপ বা সমরেশ বসুর কোনটাই হতে পারেননি বলেই 'রোদ্দুর' হয়েছেন।

উন্নয়ন মানেই মমতাময়ীর খুশবু তা মোটেই নয়।
এই স্বাধীন বিভক্ত বাংলার উন্নয়ন, সংস্কৃতিচর্চায় খুশবু না বদবু তা আপনারাই বলবেন। আজ যে এত রবীন্দ্রপ্রেম, এই সেদিনও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বুর্জোয়া কবি। যাঁরা কবিগুরুকে ওই উপাধি দিয়েছিলেন, বাঙালি তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাহলে এই বাঙালি রোদ্দুরের পাশেই বা দাঁড়াবে না কেন? আজ যে রোদ্দুর রায়কে নিয়ে এত খিস্তাখিস্তি, ইউ টিউবে তাঁর ষাটলক্ষ লাইক। অবধারিত ভাবেই তাঁরা কেউ বাংলাপক্ষের চাড্ডি, গুটকাখোড় নয়। সংস্কৃতিবান বাঙালি।

সোশাল মেডিয়ায় রোদ্দুরের ষাট লক্ষ লাইক, খুব একটা কম কথা নয়। রোদ্দুর রায়কে আগে থেকেই বিখ্যাত করে দিয়েছে বাংলা বাঙালি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'খিস্তিরিমেক'- এই বাজিমাত রোদ্দুরের। আসলে চুপিসারে বাঙালির মনের ডাস্টবিনের ঢাকনাটা সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর সেই ডাস্টবিনে রাখা ছিলো, ভণ্ড সাবধানী বাঙালি মননের খিস্তির ওপচানো স্টক। কিন্তু মুখে কাস্তে হাতুড়ি, ঘাসফুল। এখন আবার কমলফুলও। তবে স্টকরুমেও বিস্ফোরণ আচমকাই হয়। প্রয়াত তাপস পালের সেই বিখ্যাত অনর্গল আনএডিটেড খিস্তি। মনে আছে তো?
নায়ক তাপস পাল না, সাংসদ তাপস পালের কথা বলছি। কবি শ্রীজাত। ত্রিশূলে কন্ডোম পরানোর কথা বলে ঝড় তুলেছিলেন।

একটু অতীতে ফিরে চান। সে সময়েও রবীন্দ্রসুরে চরম অশ্লীল, যৌনতায় ভরা গানবাঁধা হতো। মনের আনন্দে আমরা তা গাইতামও। তবে গোপনে। সেসব গানের ভাইরাল হয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাও ছিলো না। কারণ সাইবারবিদ্যা তখনও অধরা। সোজাকথায়, আজ রোদ্দুর যা করে দেখালেন, আমরাও সেই কাজটাই করেছি একসময়ে। তবে রোদ্দুর করেছেন বুকফুলিয়ে। গত প্রজন্মের সেই বুকের পাটা ছিল না। কারণ মানসিকতায় তফাত ছিলো বৈকি।
সেই বয়সেও জ্ঞানের নাড়ি ছিল টনটনে। বুঝতাম, ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। আজ সেসবের বালাই নেই। আধুনিক, উদার বাঙালি। রবীন্দ্রনাথের কাছা ধরে টান মারা যায়, বহুদিন আগেই তা শেখা হয়ে গেছিল। এবার তার হাতেকলমে প্রয়োগ। আর তাই রোদ্দুর হোক, বা তাঁর নবরবীন্দ্র গানের গায়ক গায়িকারা। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর লোকজনের অভাব নেই। পাশাপাশি নানারকম প্রসঙ্গ তুলে এই লোকজনেরা চাইছেন, মূল ব্যাপারটিকে গুলিয়ে দিতে। অনেকে আবার দোহাই দিচ্ছেন খোদ কবিগুরুর কাঁধে চেপেই।
"আমরা নতুন যৌবনেরই দূত।"
তাই বলছি, উন্নয়নের ঠ্যালা সামলানোরও দায় আছে।
"গোপন কথাটি রবে না গোপনে!"

নামেও বেশ একটা মিল আছে। রবী রোদ্দুর। রবী থাকলে রোদ্দুর থাকবেই। আলো থাকবে আঁধার থাকবে না, তাও আবার হয় নাকি? তাই রবীও আছেন, রোদ্দুরও আছেন। রবীপ্রেমীরা আছেন, রোদ্দুরপ্রেমীরাও আছেন। আর সবমিলিয়ে মিলেমিশে, তালগোল পাকিয়ে আছেন রবী, রোদ্দুর অনুরাগীরা। রবীন্দ্র ভারতীর বসন্ত উৎসবে "চাঁদ উঠেছিল গগনে"র অশ্লীল রিমেক যাঁরা গাইলেন, তাঁরা মনের আনন্দে, প্রকাশ্যেই গাইলেন। মেয়েদের উৎসাহটা সম্ভবত কিঞ্চিত বেশি। ছেলেরাও ছিলেন। তবে সংখ্যায় কম। সবার বুকেপিঠে রঙিন হরফে লেখা হয়েছিল, গীতিকার রোদ্দুরের কলিগুলিও।
মালদার সেই কিশোরীদের কথাই ধরুন না কেন। বেশ ফূর্তিতে তাঁরা চারসখী ওই একই গান ধরেছিলেন। নির্বিকার ছিলেন সেই স্কুলছাত্রীরাও।
মন্দের ভালো। রবীন্দ্র ভারতী হোক বা মালদার স্কুলছাত্রীরা, তাঁরা সবাই হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু ভয়ের ব্যাপার কিছু প্রখ্যাত, অপ্রখ্যাত বিদ্বজ্জন, কলাকুশলীর ভূমিকা। সোশাল মেডিয়া ঘাঁটলেই দেখবেন, অতীতে বা আজও এঁদের অনেকেরই ভূমিকা উসকানিদাতার।

এছাড়াও আছেন বাংলার বেশকিছু সংস্কৃতীপ্রেমী মানুষজন। প্রকাশ্যে তাঁরাও রবীন্দ্রভক্ত। কিন্তু তাঁরাও সুযোগ পেলে দলবেঁধে রোদ্দুরের "___ চাঁদ উঠেছিল গগনে" গান। মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে আর এক মুখ। এরকমই এক কীর্তিমান কলকাতা বইমেলায় গন্ডগোল পাকানোর হোতা সেই ছেলেটি। যার বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছিল পায়ে গীতা মাড়িয়ে সিএএ বিরোধিতার। গত জানুয়ারিতে তাঁকে দেখা গেছিলো রোদ্দুর রায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে। প্রকাশ্যে রাস্তায় পাঁচ ছেলেবন্ধু, দুই বান্ধবীর সঙ্গে তাঁকেও দেখা গেছিল রোদ্দুর ভার্সান "চাঁদ উঠেছিল গগনে" গাইতে। এই ছেলেটিকেই কেন টার্গেট করলাম? কারণ এই উঠতি ছেলেটাই আবার বাংলাপক্ষের কড়া সমর্থক। তবে সেদিন রোদ্দুর রায়ের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে, বাংলাপক্ষের কিছু কর্মকর্তারাও হাজির ছিলেন বলে শোনা গেছিলো। বিপদের কথা, এই বাংলাপক্ষই এখন নেমে পড়েছে বাংলাভাষা সংস্কৃতির শুচিতা রক্ষা করতে।

ডালপালা ছাঁটলেই চলবে না। দরকার গোড়া ধরে টান মারা। আর গোড়া মানেই রোদ্দুর রায়। তবে তাতেও কি বাঙালির মনের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা অশ্লীলতা দূর হবে? কখনোই না। শ্লীল, অশ্লীলের লক্ষণ গণ্ডী টানাও বোধহয় অসম্ভব। কারণ আজ যা শ্লীল, কাল তা অশ্লীল। আবার উল্টোটাও। আবার কিছু প্রেক্ষিত, কিছু বিশেষ বা অশ্লীল শব্দ দাবি করে। কিন্তু সাবধান হতে হবে অশ্লীল শব্দের ব্যবহারে। শুধু চমক লাগানোর জন্য অশ্লীল শব্দ ব্যবহার বন্ধ হোক।
তাঁর ডাস্টবিন-মুখ খোলার আগে, যেন দশবার ভাবতে বাধ্য হন রোদ্দুর রায়।
ঠিক এমন একটা সময়, অমলকান্তি রোদ্দুর হয়ে ফিরে এলে, বেশ হতো।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours