তানজিন তিপিয়া, লেখক ও রন্ধন বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ:

বিশ্বকে অচল করে ঘর বন্দি করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে এই অতি ছোট্ট ভাইরাসটি। কতোই না আসহায় আমরা, এতো বড় আকৃতির হয়েও কোভিড-১৯ কে ভয় দেখাতে ব্যর্থ।
উৎপত্তি, বিস্তৃতি, কেমন, কোথায়? কম বেশি ইতোমধ্যে প্রায় সবার সবজান্তা। 
কিন্তু মিথ্যে প্রচারণার কমতি নেই।
চীন ২৫০০০ হাজার মানুষকে মেরে ফেলতে যাচ্ছে।
যোগ ব্যায়াম করলে আপনি পরিত্রাণ পাবেন।
লেবু দিয়ে গরম পানি খেলেই চলবে ইত্যাদি।
“করোনা ভাইরাস” এক বিশাল পরিবার। যা ফুস্ফুসে উপস্থিত প্রোটিনের উপর জমে ফুস্ফুসের কোষ ধ্বংস করে। উৎপত্তি চীনের উহান শহরে, সেই সুত্রে নামকরণ হয় “উহান ভাইরাস”। ২০১৯ আবিষ্কৃত হয়েছে বিধায় কোভিড এর পার্শে ১৯ যুক্ত হয়েছে।
উহান শহর থেকে অন্যান্য দেশে যারা ভ্রমন করেছেন প্রায় সেসব স্থানে ছড়িয়ে পরেছে যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, ইটালি, ফ্রাঞ্চ, মার্কিন যুক্তরাজ্য, তুর্কি, রাশিয়া, আরব আমিরাত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়শিয়া মোট ৬০টি দেশে। আর এই কারণেই এটি বৈশ্বিক রোগে (global disease)  পরিণত হয়েছে।
জ্বর, সর্দি,  কাশি,  শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট এই রোগের লক্ষণ।
লক্ষণগুলোর মাত্রার উপর নির্ভর করে একে ৩টি স্তরে ভাগ করা যায়। 
চীনে ৮১% হালকা ,
        ১৪% তীব্র,
        ৫% সংকটপূর্ণ অবস্থায় রোগীদের শনাক্ত করা হয়েছে। তীব্র আর সংকটপূর্ণ পর্যায়ে  নিউমোনিয়া হতে পারে। সারা বিশ্বে, 
আক্রান্তের সংখ্যা ১২৭,৭৪৯ জন,
সুস্থ হয়েছেন ৬৮,৩০৭জন,
মারা যান ৪,৭১৭ জন। 
যেহেতু প্রভাব সাধারণ মৌসুমি সর্দির মতোই এবং প্রভাবিত রোগীর সংখ্যাও হালকা পর্যায়ের এবং মৃত্যু হার কম তাই এতো ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু এই বিশেষ কারণটির জন্যই এর মূল লক্ষণ বুঝে ওঠা খুব দুষ্কর।
সব ভাইরাসের একটি ডিম ফুটোনের সময় (incubation period) থাকে। কোভিড-১৯ এর ডিম ফুটোর সময় সীমা ২-১৪ দিন অর্থাৎ এই সময়ে দেহে সুপ্ত থেকে আপনার দেহে লক্ষণ প্রকাশ না করলেও অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে। এই ক্ষেত্রে আপনি হবেন অসম্পূর্ণ রোগী (asymptomatic patient)। সরকার চিকিৎসা দিচ্ছেন শুধুমাত্র তাদের যাদের হয়ে গেছে এমনো আছেন যাদের শরীরে সুপ্ত আছে কিন্তু প্রকাশ পায়নি। এরা হয়তো ধরা ছোয়ার বাইরেই রয়ে যাবেন এবং ছড়াতে থাকবেন। এটি ছড়ায় মানুষ কথা বললে বা কাশলে ফোঁটাগুলো (droplets) বাতাসে চলে আসে ৩-৬ ফুট এগিয়ে মাটিতে পরে যায়। তবে এই সীমায় কেউ উপস্থিত থাকলে বিপদ আছে। প্রত্যেক রোগের মৌলিক প্রজনন সংখ্যা  (basic reproduction number) থাকে অর্থাৎ একজন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি আরো কতো জনকে রোগ দিতে পারেন। এই ভাইরাসের প্রজনন সংখ্যা ২.৭ মানে আপনি ১-৩ জনকে রোগ প্রদান করতে পারবেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইরানের ডেপুটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশে পরিস্থিতি ঠিক আছে জানান,  পরের দিন তিনি নিজেই আক্রান্ত হয়ে পরেন।
যেকোন রোগ কোন পর্যায়ে ভয়ংকর তা  নির্ভর করে
১- কীভাবে ছড়ায়?
২- উর্বরতার হার কেমন?
খেয়াল রাখবেন-
-মাথার টি (‘T’ area) এরিয়া অর্থাৎ চোখ, নাক, মুখে যেন বার বার হাত না যায়। 
-হাত ধোবেন প্রায় ২০ সেকেন্ড।
-যে জায়গাগুলোতে ছড়িয়ে আছে সেখানে না যাওয়া।
-আক্রান্ত কোন ব্যক্তি কাছে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
-কার আছে কার নেই এই নিয়ে সংশয় রয়েছে এখনো তাই ভিড় এলাকায় না যেতে পারলেই উত্তম।
-মাস্ক ব্যবহার তাঁরা করবেন যারা আক্রান্ত হয়ে গেছেন। যাতে অন্যজনের কাছে এটি না ছড়ায় কিন্তু আক্রান্ত না হওয়ার জন্য মাস্ক ব্যবহার করলেই যে আপনি বেঁচে যাবেন তা এখনো নিশ্চিত নয়।
-হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক সাধারণত বিশ্রাম,জ্বর, ব্যথা কমানোর ঔষধ, নির্ধারিত তরল দেন, যাতে দেহ পানিসল্পতায় না ভোগে। চেষ্টা থাকে রোগীকে কোনভাবে সহায়তা করতে, যাতে রোগী নিজেই লড়াই করে আরোগ্য লাভ করতে সক্ষম হন। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাঁরা বেশি মাত্রায় কবলে পরেন। ঝুঁকি তাদের জন্য বেশি যারা আগেই কোন রোগে ভুগছেন বিশেষ করে যাদের বয়স ৬৫ ঊর্ধ্বে। মৃতের হার পর্যবেক্ষণ করলে, মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই ৬৫ বছরের উপর। তবে ১০০ বছরের বৃদ্ধ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এমনও আছেন।
-ডাব্লিও,এইচ,ও(WHO) এর মতে শিশুদের খুব কমই আক্রান্ত করছে, পেলেও খুব হালকা।
একাধিক ভাইরাসের প্রকাশিত লক্ষণ এক হলেও ধরণ ভিন্ন হওয়াতে এদের প্রতিষেধকেও ভিন্নতা আনতে হয়। গরম আসলে এর প্রভাব হ্রাস পাবে - মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের উক্তিকে ডাব্লিও,এইচ,ও (WHO) এর এইচ,ই,পি  (Health Emergencies Programme)  “মিথ্যে আশা” বলে খারিজ করেন।   
এমতাবস্থায় সরকারের প্রধান করণীয় হয়ে দাড়ায়, 
১-চিকিৎসার জন্য ঔষধ সরবরাহ,
২- করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি কমানো,
বিভিন্ন সরকার মানুষের জমায়াত রোধ করতে যেমন অলিম্পিকের খেলা, প্রিমিয়ার লীগের ম্যাচ, ওমরাহ্‌ হজ্বও  স্থগিত, জনসাধারণে সচেতনতার প্রচার এবং ভ্যাকসিন তৈরির কাজে ব্রত। 
করোনা আপাতত পৃথিবী হতে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে,  হয়তো একেবারে শেষ করা সম্ভবপর নয় যতক্ষণ না কোন প্রতিষেধক তৈরি হয়। ততদিন এই রোগ পৃথিবীতে বিরাজমান থাকবেন। পুনরাবৃত্তি রুখতে চীনের বন্য প্রাণীর ব্যবসা নিষিদ্ধ করতে হবে কারণ প্রাণীদের কাছ থেকেই ভাইরাস মানব দেহে আসে। 
ইবোলা এসেছিল বাদুড় থেকে,
সার্স  সিভেট বিড়াল হতে,
কোভিড -১৯ বাদুড় হতে, 
প্রাণীতে কোটি রকমের ভাইরাস থাকে, যা মানব দেহে কার্যকর হয় না।
দুর্ভাগ্যবশত  ১৯১৮ সনে যুক্তরাজ্যে এইচ১ এন১ (H1N1) হয়েছিলো একটি ফার্মে
একটি মানুষের মৌসুমি সর্দি হয় আর একটি মুরগীর বার্ডফ্লু। এরা উভয় একে অপরকে ক্ষতি না করে প্রভাব ফেলে এক শূকরের  শরীরে। এটি বিক্রিয়া করে এক নতুন জুনোটিক  এইচ১ এন১(H1N1)  ভাইরাসে পরিণত হয়ে ছড়িয়ে পরে। 
যেহেতু মানব ও মুরগী উভয়ের সংমিশ্রণে তৈরি তাই মানুষের অংশটি ভাইরাস ছড়াতে আর মুরগী হতে আসন্ন অংশটি দেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা নষ্ট করতে সক্রিয় হয়।পুরো বিশ্বে ৫ কোটি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা পরেন। 
চীনে বেশ বড় মাপের বন্যপ্রাণীর ব্যবসা হয় তাই জুনোটিক ভাইরাসের উৎপত্তি হওয়া খুব স্বাভাবিক। ২০০৩ সনে সার্স হবার পর বন্যপ্রাণী ব্যবসায় নিষেধাজ্ঞা জারী করলেও পরবর্তীতে আবার চালু হয়। আপাতত এই বাজার বন্ধ আছে কিন্তু প্রশ্ন হলো, সার্সের পর নতুন ভাইরাসের হামলায় চীন আবারো এই ব্যবসা চালু করার ঝুঁকি নিচ্ছে কি না?
যেহেতু এখনো  কোন প্রতিষেধক অবিস্কার হয়নি তাই দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে কিছু ভিটামিনযুক্ত উদ্ভিদ যোগ জরুরী।
ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ খাবার সাইত্রাস জাতীয় ফল, লেবু, কমলা, কলা, আমলকী, টমেটো, রসুন, পেঁপে, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি। এতে শরীরে রোগ প্রতিরোধ বলয় তৈরি হবে। যা ভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম। আর মাছ, মাংস, ডিম, সবজি অবশ্যই ভালো করে সেদ্ধ করবেন যাতে উত্তাপে জীবাণু ধ্বংস হয়। 
তাছাড়া আমাদের রব ১৪১০ আগেই কিছু খাদ্য উপকরণ উল্লেখ করেই দিয়েছেন যেমন-
কালি জিরা- মৃত্যু ব্যতিত সকল রোগের ঔষধ। 
মধু- সকল রোগের নিরাময় রয়েছে। মাসে ৩ দিন চেটে চেটে মধু খেলে কোন বড় রোগ দেহে জায়গা গড়তে পারবে না।
দুধ- সবচেয়ে উত্তম খাবার।
পানি- অপর নাম জীবন। প্রচুর পরিমাণে পান করুন এতে ভাইরাস গলায় আটকে থাকলে পানি পানের মাধ্যমে কোনভাবে পাকস্থলীতে পৌছোতে পারলেই হাইড্রোক্লোরিক(HCl) এসিড ও অন্যান্য অম্ল দ্বারা ধ্বংস হয়ে যাবে। 
মাথায় রাখবেন, গুজব ছড়ানোরও একটি ব্যবসা রয়েছে। যেহেতু মৃতের সংখ্যা আক্রান্তের তুলনায় খুব কম তাই দুশ্চিন্তা একদমি না কারণ দুশ্চিন্তা বিরাট মহামারী। করোনা হলে আপনি বেঁচে যেতে পারেন কিন্তু দুশ্চিন্তা পেয়ে বসলে মেরেই দম নেবে। আমাদের কাজ সচেতন থাকা, সচেতন করা,বাক বাকিটা সৃষ্টিকর্তার উপর। অবশ্যই দোয়া প্রার্থনারও কোন বিকল্প নেই।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours