আহসান হাবিব, লেখক, বাংলাদেশ:

বিষন্নতায় ভোগে না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। এই রোগে মানুষ কত যে বিষন্নতা বিরোধী ওষুধ সেবন করে, তার ইয়ত্তা নাই। আমি বলি বিষণ্ণতা রোধে যারা প্রতিদিন ঘুমের বড়ি কিংবা অন্যান্য ওষুধ সেবন করছেন, আজই সেসব ওষুধ জানালা দিয়ে ফেলে দিন । এসব ওষুধ বিষণ্ণতা কমায় না, আরও বাড়িয়ে দেয় এবং ওষুধের উপর নির্ভরশীলতার জন্ম দেয় । আপনি যে সমাজে বাস করছেন, বিষণ্ণতা সে সমাজের জন্য সর্দি কাশির মত । সর্দি কাশি যেমন এমনি এমনি সেরে যায়, বিষণ্ণতাও আপনা আপনি ঠিক হয়ে আসে । ওষুধের সাহায্য নিলে শরীর মন এসবের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কোন সুযোগ পায়না । মস্তিস্ক ভেবে বসে তার নিজের কিছুই করার নেই । সর্দি কাশি তবু সারে, কিন্তু বিষণ্ণতার জন্য বাজারে যে সব ওষুধ আছে, সেসব বিষণ্ণতা সারিয়ে তোলার বিপরীতে এটিকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করে।

আপনি কেন বিষণ্ণতায় ভোগেন তা কি ভেবে দেখেছেন? বরং সেটা নিয়ে ভাবুন । দেখবেন আপনি অনেক কারণ খুঁজে পাবেন । সেসবের অনেকগুলির উৎস সামাজিক অর্থাৎ এই সমাজ আপনাকে আপনার ইচ্ছানিরপেক্ষ ভাবেই বিষণ্ণ করে তোলে । টিকে থাকার জন্য আপনি যেসব সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, সেসব সম্পর্ক শ্রেণী বৈষম্যের জন্ম দেয় । কিছু লোক আপনাকে ব্যবহার করে, আপনার শ্রম মেধা ব্যবহার করে কিন্তু উপযুক্ত বিনিময় মুল্য দেয়না । ফলে আপনি বঞ্চনার শিকার হন । আপনার মন বিদ্রোহ করে । কিন্তু আপনি কিছুই করতে পারেন না । এই কিছু না করতে পারা আপনাকে দিনে দিনে বিষণ্ণ করে তোলে । এখন বলুন এই সমস্যা আপনি কোন বড়ি খেয়ে কমাবেন ? বরং যে সমাজব্যবস্থা আপনাকে বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করুন, প্রয়োজনে মৃত্যু বরণ করুন।
পারিবারিক সম্পর্ক কিংবা নারী পুরুষের সম্পর্কও আপনাকে বিষণ্ণ করে তুলতে পারে । দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকার জন্য যে সামাজিক নিরাপত্তা দরকার, দেখা যায় এই নিরাপত্তা প্রায় পরিবারে অনুপস্থিত । তাছাড়া শ্রেণী বৈষম্যের কারণে নারী পুরুষ সম্পর্ক একই সমতলে থাকেনা, তখন নানারকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয় । বিষণ্ণতা তাদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা । এখন এই সমস্যার জন্য আপনি কি এমন বড়ি খেলে সমাধান পাবেন ? পাবেন না । বরং এইসবের জন্য যে কারণ, তার বিরুদ্ধে লড়াই করুন।

মানুষের মানসিক সমস্যার শেষ নাই । প্রাকৃতিক ত্রুটির জন্য জন্মগতভাবেই অনেক মানুষ নানারকম সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে । এসবের মুল কারণ জিনগত । ভ্রুনাবস্থায় এইসব ত্রুটি ঘটে যায় । কিন্তু দেখা গেছে এইসব ত্রুটির পেছনেও রয়েছে আমরা যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি তার কার্যক্রম । এই ব্যবস্থা তার উৎপাদন কালে যে বর্জ্য এবং তেজস্ক্রিয় তৈরি করে, তা মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে । প্রকৃতির স্বরূপ বিনষ্ট করে ফেলে । তখন এইসব সমস্যা দেখা দেয়, শুধু মানবদেহে বা মনে নয়, অন্যান্য জীবদেহেও এই ত্রুটি দেখা দেয় । এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে প্রকৃতিকে নষ্ট করে ফেলা । এখন আপনি বলুন কোন বড়ি খেয়ে আপনি সমস্যা দূর করবেন ? কোন বড়ি নেই । এর সমাধান একটাই যে সমাজব্যবস্থা এই সব ত্রুটির জন্ম দেয়, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে একে রুপান্তরিত করা যেখানে এমন সমস্যা উদ্ভবের কারণ না হবে সামাজিক সম্পর্ক কিংবা প্রকৃতি।
আপনি কি লক্ষ্য করেছেন এইসব ওষুধ কারা তৈরি করে ? ওরাই, যারা এইসব সমস্যাগুলির জন্য দায়ী । কি অদ্ভুত প্যারাডক্স, তাইনা ? একদিকে সমস্যার জন্ম দিচ্ছে, অন্যদিকে এর দাওয়াই তৈরি করে আপনার চোখে ধুলো দিচ্ছে ! আপনি এর পেছনে ছুটছেন, কত ডাক্তার, কত পরীক্ষা নিরীক্ষা, কত ওষুধ, কত অর্থ বিনিয়োগ ! কিন্তু ভাল হচ্ছেন কি ? না, হচ্ছেন না, কারণ এর পেছনে যে কারণ- ব্যবস্থা- তা অনড় থেকে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আপনি টুঁ শব্দটি করছেন না । ভাবছেন এটা আপনার দোষ, আপনার নিয়তি ! ভুল, এটা আপনার ভুল চিন্তা, এর দায়ভাগ সম্পূর্ণ তাদের, যারা এর জন্মদাতা এবং এই নিয়ে যারা ব্যবসা ফাঁদে এবং মুনাফা লুটে নেয় । কিন্তু সমস্যার কিছুই সমাধান হয়না ।
এই ফাঁকি থেকে বেরিয়ে আসুন । বেরিয়ে আসার এই পথে আপনি প্রথম যে কাজটি করবেন তা হোল সব ওষুধ জানালা দিয়ে ফেলে দেয়া এবং সমস্ত ধরণের মানসিক চিকিৎসককে 'না' বলে দেয়া । দ্বিতীয় কাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করা, এই সংগ্রাম আপনাকে সুস্থ রাখবে, সতেজ রাখবে । যদি মৃত্যু হয়, তা হবে বীরের, গৌরবের । যদি একান্ত এই লড়াইয়ে নামতে না পারেন, তবুও ওষুধ ফেলে দিয়ে হাঁটুন, গান শুনুন, কিছু লিখুন, সিনেমা দেখুন, আপনার উপর ব্যবস্থার চাপিয়ে দেয়া অসহ্য ভার ইগ্নর করুন । রাষ্ট্রকে অস্বীকার করুন মনে মনে এবং নিজেই নিজের সম্রাট ভেবে সব কিছু উড়িয়ে দিন । সুস্থ থাকুন, সবল থাকুন আর বিষন্নতাকে বলুন 'বাই, বাই'...

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours