জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা, দুর্গাপুর:

একজন অবুদ্ধিজীবি কারখানা গেটের বোধে দাড়িয়ে, আজকের যে বিভাজনের সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাকে যেমনটি দেখেছি, তাকে  ভারতের  জাতীয়তা সংহতি সাধনে রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্যোগহীনতার পরিনাম হিসেবেই বুঝেছি।
প্রকৃত অর্থে এর প্রাথমিক দায় যদি কারুর নিতে হোত, তা কংগ্রেস দলের ঘারেই বর্তাবে। স্বাধীনতা আন্দোলনে জন-একাত্মতা নির্মানে উদ্যোগের  শতভাগ যদি কংগ্রেস দল, বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধীর নস্ত থেকে থাকে, তবে স্বাধীনতা উত্তোর কালের প্রথম ছাব্বিশ বছরের একচেটিয়া উদ্যোগ কংগ্রেস দলের উপরেই বর্তেছিলো।
তবু মেনে চলতে হবে, চৈনিক বিপ্লবের দুর্বার গতিমুখে দাড়িয়ে, দল হিসেবে কংগ্রেস এবং নেতা হিসেবে মহাত্মা গান্ধীর
-----  দ্বিতীয় যুদ্ধকালে স্বাধীনতার তরঙ্গকে দাবীয়ে রাখার তাগিদেই, তাকে খন্ডিত স্বাধীনতা এবং অতি-পশ্চাতপদ আর্থ-সামাজিক নীতিকে মেনেই স্বাধীনতা চুক্তির দিকে এগুতে হয়। এখানে খন্ডিত অর্থে, বিভাজন থেকেও বিপদজনক ছিলও, ভারতীয় সমাজে খন্ড-বিখন্ডিত জাতীয় সত্বাকে মেনে নেওয়া। তেমনটি না ঘটলে, বিভাজন সত্বেও  দু'টি দেশ (যা পরে তিন হয়েছে)
এক পারস্পরিক বোঝাপরার ভেতর দিয়ে, এক উপমহাদেশীয় সত্বায় আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেতো। জাত-পাত, ধর্মীয় বা স্ত্রী-পুরুষে খন্ডিতকরন ব্যতিরেখেও খন্ডিত অর্থনৈ্তিক ব্যবস্থাও, জাতীয়তার পুনঃর্গঠনে বাধা দিয়েছিলো।

সেকালে ভারতীয় মুক্তি আন্দোলনের সংগ্রামী অভিমুখ হিসেবে সুভাষ চন্দ্র বসুকে কোনঠাসা করা এবং পরে, তাকে হিটলারের কবলে ঠেলে পাঠানোতেও
---- ভেতরের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে জমিদার এবং ঔপনিবেশিক আশ্রিত
পুজিপতিদের  নিয়ন্ত্রন বজায় রাখার নীতির সাথে সাথে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামকে আপোষ করে নেওয়া, বিপুল ভুমিকা নিয়েছে। সেই যুদ্ধে অনেক দেশ সরাসরি হিটলারের বিরুদ্ধে দাড়ালেও, সাধারনভাবে বিশ্বের প্রায় সব কেন্দ্রিভূত পুজি হিটলারের পেছনেই ছিলো ।অন্যথায়, অতি সহজে ফ্রান্স যেমন ফ্যাসিস্ত কবলিত হতে পারতো না, তেমনি বৃটিশ রনপোতের অর্ধেকের বেশী ধ্বংস হয়ে যেতে পারতো না।
সাধারনভাবে ঔপনিবেশিক দেশগুলির জাতীয় আন্দোলন,  যেখানে যেখানে যারাই  দ্বিতীয় যুদ্ধে হিটলার সম্পর্কে নরম নীতি নিয়ে চলেছে, তাদের কোন দেশেকেই যেমন এক রাখা যায় নাই, তেমনি কোন স্বাধীন অর্থনৈ্তিক অবস্থান নেওয়া সম্ভব ছিলো না।
অনুরুপভাবে,
যদি মিলিয়ে দেখার চেষ্টা হয়
কীভাবে দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তোর কালে, ক্রমবৃদ্ধিমান বিশ্বপুজির কেন্দ্রিয়ভবন, বিশ্বের সদ্যস্বাধীন দেশগুলির জাতীয়তাবোধের সংহতিকে বিপরীত দিক থেকে
নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে, তবে কমরেড স্তালীনের ভবিষ্যতবাণীর যথার্থতাই প্রমান হবে। তিনি যদি উল্লেখ করে থাকেন
--------দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের নিধন হলেও, যুদ্ধান্তে পুজির কেন্দ্রিভবনের সাথে সাথে, দেশে দেশে এবং আন্তর্জাতীক ক্ষেত্রে, ফ্যাসিবাদ তার ডালপালা বিস্তৃত করবে এবং হীংস্ত্র হতে থাকবে।
তবে নিশ্চিত মেনে চলতে হবে, যতই নেহেরু সরকার চাইতেন না কেন কিংবা নেহেরু-স্তালীন চুক্তি, জাতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ নির্মানের কারন হোক না কেন,
----- কংগ্রেস নামক বৃহৎ পুজি নিয়ন্ত্রিত এবং জমিদারদের দ্বারা পরিচালিত দলটি কিছুতেই, কোন বৈপ্লবিক সামাজিক অভিমুখকে সামনে রেখে জাতীয়তার পূনঃর্গঠনে হাত দিতে পারতো না। এই সুত্র ধরেই বুঝতে হোত, নেহেরু-স্তালীন চুক্তি এবং নেহেরু নেতৃত্ব যদি কংগ্রেস সরকারকে আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং জাতিসত্বাগূলিকে সংহত করার সুযোগ দিয়ে থাকে তবে কেন কংগ্রেস দলটির রাজনৈ্তিক অভিমুখ ,মুলতঃ আমেরিকান মিলিটারী ইচ্ছার অধীন হয়ে পরছিলো। আরো বুঝতে হোত এই দ্বিমুখীনতার কারনেই, এই উভয়ের দ্বন্দ্ব
ষাটের দশকের শুরু থেকেই দেশে রাজনৈ্তিক সংকটের সূচনা করতে থাকে এবং তা ক্রমে চিন-ভারত যুদ্ধে গুরুতর ইন্ধন যোগানদার হয়ে উঠে।
যদি বিশ্বের সদ্যস্বাধীন দেশগুলির ইতিহাসের
দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, দেখা যাবে, সেই সময় থেকেই
দেশে দেশে রাজনৈ্তিক সংঘাত চরম হতে থাকে এবং সেই সময়েই ভিয়েতনাম
এবং ইন্দোচিন বিশ্বদ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে শুরু করে।
---- জবাব খুব স্পষ্ট। যুদ্ধোত্তরকালে আমেরিকার মিলিটারী তন্ত্রের প্রথম দুই প্রাথমিকতা ছিলঃ
প্রথমতঃ দ্বিতীয় যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া, ইউরোপীয় অর্থনীতির পূনঃর্গঠন এবং আধুনিকতায় আমেরিকান পুঁজি এবং  প্রযুক্তির যোগানদার হিসেবে, আমেরিকান পুজীর বিশ্ব কেন্দ্রিভবন শুনিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়তঃ সোভিয়েতকে কমরেড স্তালীনমুক্ত করা এবং ভেতর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে সোভিয়েতকে ভেংগে ফেলার পথ সুনিশ্চিত করা।

এখনেই আসছে সাম্যবাদী দায়বদ্ধতার বিষয়টি। একদিকে লেনিনের সাথে সুর মিলিয়ে বলা হবে,অক্টোবর বিপ্লব বা বিশ্বের প্রথম মহামানবিক বিপ্লবের পর,
জাতীয় বিপ্লবের দিন ফুরিয়ে গেছে
---- অন্য দিকে মনে মনে তাল মিলিয়ে যাওয়া হবে, এই বলে যেন 'বুর্জোয়ারাই সদ্যমুক্ত দেশগুলিতে, জাতীয়তা পূনঃর্গঠিত করে দেবে। আর সাম্যবাদীরা যেন 'বুর্জোয়া সৃষ্ট জাতীয়তাকে ভড় করেই গনতান্ত্রিক বিপ্লব বা প্রজাতন্ত্রকে এক ধাপ এগিয়ে দেবে। অনেকতা 'সোনার পাথর বাটির' মতোই।

এখানেই জাতীয়তাবাদের পূনঃর্গঠনে সাম্যবাদি এবং
তার সাথে শ্রমিক আন্দোলনে,
 শ্রম এবং শ্রেনী রাজনীতিতে
উত্তোরনের প্রশ্নের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে।
বিশ্ব দ্বন্দ্ব যেখানে 'মেহনত' এবং 'পুজিঁতে' ক্রমাগত কেন্দ্রিভূত হয়ে,
আন্তর্জাতীপ পুজিকে বেপোরায়া করে দিচ্ছে এবং দ্বিতীয় যুদ্ধের পর
থেকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে থাকা  ' বুর্জোয়া জাতীয়তা'কে গিলে খাচ্ছে
---- তখন তো এটা নিশ্চিত ছিলো
হয় 'মেহনত' বা 'দুনিয়ার মজদুর এক হোক' জাতীয়তাকে গিলে খাওয়া থেকে
রক্ষা করবে, তাকে সমৃদ্ধ করবে এবং ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক ভাবনাকে সমৃদ্ধ
করবে।
--- অথবা ---  অথবা ---   
 আমেরিকান মিলিটারীতন্ত্রের পেটে, ভারতীয় জাতীয়তার যতটুকু টিকে আছে,
তাকে  গিলিয়ে খাওয়াতে,
মধ্যবিত্তিয় ব্রাহ্মনতন্ত্রকে ক্রমাগত উস্কিয়ে দেওয়ার পথে
'শ্রমিক আন্দোলন'কে নির্জলা অর্থনীতিবাদ, যাকে ইংরাজীতে
বলে Unalloyed Trade unionism তাই করবে। সেই পথ বেয়েই
কমরেড স্তালীন বিতারনের মতোই, কমরেড বি টি আর দের মতো
বিপ্লবী নেতৃত্বকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। বি টি আর উত্তোর কালে,
শ্রমিক আন্দোলনের শ্রেনী উপাদানগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা হবে।

স্মরন রাখতে হবে আজকের দিনে পুরানো কালের
 ঔপনিবেশিকতামুক্ত দেশগুলিতে 'জাতীয়তা নিধনের' যে মহাযজ্ঞ
চলছে সেখানে
-----  শ্রমিক আন্দোলনের নির্জলা অর্থনীতিবাদ বা unalloyed Trade Unionism কে  বুর্জোয়া  অক্ষমতাকে এক সেকলে বেঁধে, সার্দুলের খাঁচায়
নিক্ষেপের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
সোভিয়েত এবং শ্রমিক রাজনীতি বিবর্জীত ভারতীয় জাতীয়তা এখন সেই সার্দুলের খাচায়, যে সার্দুল
----- ইতিহাসের মুক্তির সাথে সাথে চিরন্তন দাসত্বের ঘোষনা রেখেছে। (চলবে)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours