প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

রাসোল্লাসভরেতে বিভ্রম চিত্ত হঞ্চা।
অশ্রুভরে নাগরী সব আছে দাণ্ডাইঞা।।
তার মধ্যে আসি রাধা কৃষ্ণ আলিঙ্কন।
করিয়া করিল বহু উদ্ভট চুম্বন।। "

প্রেমঘন মূর্ত অবয়বের সুরের আরতি প্রেম.....

হে পরমপুরুষ, প্রকৃতি আমার ;নশ্বর ধনই ঈশ্বর, মুক্তিই ঈশ্বর৷ বেদের ঊর্ধ্বে তুমি এক সনাতন পুরুষ ; তোমার অরূপ মুহুর্তে নবজলধরকান্তি পীতবাসনধারী গোপবালক তোমাতে মজেছে চিরন্তনের বৃন্দাবন। বেদ কি তোমাকে বলেছে, যে তুমি নিত্যসত্য, তুমি কারণকারণম। তোমার গোপিকারা যে শ্রুতি, বিশ্বজুড়ে ভালোবাসার নন্দনকানন ; মনে পড়ে রাধামাধব তোমার তোমার তপস্বী বেদব্রতের বেণু রূপ!!  সে যে গীতবিতান প্রভু!  যুগাবসানে পরম বৈষ্ণব, ভূমি তুমি আমার৷

ভুলি কি করে প্রভু!  তুমি যে একা নও! এ যেন "বঁধুয়া, হিয়া 'পর আও রে। " দক্ষিণেশ্বরে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের গঙ্গাকক্ষ ধরে অজ্ঞাত পদকর্তার গান,

" রাধার দেখা - কি পায় সকলে,
রাধার প্রেম কি পায় সকলে।
অতি সুদুর্লভধন, না করিলে আরাধন,
সাধন বিনে সে ধন এ ধনে কি মেলে।। "

শুনে বুঝি হৃদয়ের বোধি বলতে চায়, কালাংড়া একতাল, "বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে! "

তোমার স্পর্শ প্রেম, না গো পূর্বরাগ নয়। গোষ্ঠ হতে ফিরতি পথে ধুলো চোখ ধরে একান্ত আপনে যখন ভেবেছিলে! "রাধা তুমি সব, আমরা কেউ নই " তখন আমারো নতজানু হতে মন চেয়েছিল৷ তোমার লীলা বিস্তারে বেশির ভাগটাই তো মানুষের মতো। মাঝখানে যমুনা, এপারে বৃন্দাবন, পরপারে মথুরা৷

অসাধারণ খেলুড়ে চরিত্র "বড়াই " ; জটিলা,কুটিলা, রাধিকা। চণ্ডীদাসের কথায়, খেলুড়ে চরিত্র আঁকি..

"শ্বেত চামর সম কেশে। কপাল ভাঙ্গিল দুই পাশে।
ভ্রূহি চুনরেখ যেহ্ন দেখি।কোটর বাটুল দুঈ আখি।। "

বীজ পত্রে বিহ্বলের কাঁটা। কিন্তু রাধা, তিনি তো পৃথিবীর ভাগ্য। কৃষ্ণ ভারতে রাধিকা স্বাধীন ও স্বকীয়া৷ সুন্দরী হাসি, ছন্দ বদ্ধ অখণ্ডমণ্ডলে আনন্দ রস পরিহার করেই আঁকা বাঁকা পথ৷ মাঝ বৃন্দাবনে পথ হারাতেই পূর্বরাগের উৎস। উঠে এলো বড়াই এর মুখে চিরকালের পটে আঁকেন নায়িকার অপূর্ব সব উপমা। মুখে দ্যুতি সোনার কমল আর সৌন্দর্য জুড়ে  সূর্য উদয় যেন চাঁদ পালায় লক্ষ যোজন দূরত্ব।
তোমার পূর্বরাগে মদনজ্বালা সে তো বড়াই এর কারণে। তবে কি কুট্টিনী দূতী তিনি। তোমার তাম্বুলে যে প্রেম সাগর তা যে প্রস্তাব। কদলীকান্ডের মতো উরুযুগল, মকরধ্বজের বাসভূমির মতো স্ফীত স্তনযুগল, মৃণালসম বাহুযুগল, কামদেবের ধনুর্গুণের মতো রোমরাজি, শীলাতলের মতো জঘন, এ তো সুন্দরী অগ্নী। রাধা সেদিন স্বামীর ক্লীবত্ব বুঝতে পারেন নি। গোপী নেত্রীর রূপ তাই আইহনের কাছে আতঙ্কের কারণ। স্বার্থ ভরিয়ে সেদিন কুট্টিনীর মতোই বড়াই তোমার সম্ভোগের থালা সাজিয়ে ছিলেন সস্নেহে। পরিকল্পনায় সীমান্ত সিঁদুর মানভজ্ঞন করলেন। কাঁচুলি ছিঁড়ে" জড়িয়ে আছে বাধা", জাতি কুল নিষ্প্রভ হয়ে যায়। পথের শুল্ক জুড়ে এ যে ঋণ সময়ের অপেক্ষা৷

রাধা বললেন, তিনি যে মাতুলানী। কৃষ্ণ বলেছিলেন, রাধা তাঁর গঙ্গা, তিনি যে বারাণসী, তিনি যে সকল তীর্থ, সকল পুণ্যস্থান। হে রাধা মাধব!  তোমার কাছে আমি যৌবন রুদ্ধদ্বার।  আমি তো জানি না রতিক্রিয়া, নিতান্ত বালিকা; রাধা মাধব আঁকলেন প্রাপ্য দানের হিসাব; বললেন, রাধিকা..  "তোমার দেহের মাপ, সাড়ে তিন হাত..  আমার প্রাপ্য দান দু'কোটি মুদ্রা ; তোমার চামরের চেয়ে সুন্দর কেশরাশি দু ' লক্ষ মুদ্রা ; তোমার ভুবন মুগ্ধকারী সূমান্তের সিঁদুর - তিন লক্ষ মুদ্রা ; নিষ্কলঙ্ক চন্দ্রের মতো মুখ - চার লাখ ; নীল পদ্মের মতো দুটি চোখ - পাঁচ লাখ ; তোমার গোরুড় পক্ষীর মতো নাক - ছয় লাখের কম নয় ; তোমার কানের কুণ্ডল - সাত লক্ষ ; মানিকের মতো সাজানো সারি সারি দুপাটি দাঁত - আট লক্ষ; বিম্বফলের মতো দুটি অধর - নয় লক্ষ; শঙ্খ - এর মতো সুন্দর কন্ঠদেশ - দশ লক্ষ, দুটি মৃণাল বাহু ও পদ্মের মতো হস্ত - এগারো লক্ষ, চন্দ্রকিরণের চেয়েও উজ্জ্বল নখ - পঙক্তি - বারো লক্ষ, যুগ্ম শ্রীফলের মতো দুটি স্তন - তেরো লক্ষ, ত্রিবলী - চিহ্নিত কটিদেশ - চোদ্দো লক্ষ, রামকদলির  সমান দুটি ঊরু - পনেরো লক্ষ, স্থলপদ্মের মতো দুটি চরণ - ষোলো লক্ষ,  হেমপাটনিন্দিত জঘন - চৌষট্টি লক্ষ।

রাধা মাধব তোমার ভৈরবপত্তনেই তো দেহ নিমর্জন। পদকর্তা বলেন,

"প্রথমে সিরিফল গরবে গমওলহ
জৌ - গুঁন - গাহক আবে।
গেল জৌবন পুনু পলটি ন আবএ
কেবল রহ পছতাবে৷। "

প্রাণপ্রিয় রাধা, যৌবন যে জলবিম্বের মতো ক্ষণস্থায়ী। হে কৃষ্ণ! তুমি করুণাপাথার!  তুমি নবঘনশ্যাম প্রিয়!! তবে কি এই বন্ধনই হলো কাম ; তুমি আমার পরমানন্দ মাধবম!  যখন ভক্তি হল কাম, ভগবান হলেন প্রেম ; এই কামের গতি তো প্রেমে ; তখন ইন্দ্রিয়রা অদৃশ্য। রাধা যে লক্ষ্মী। তোমার কালো অঙ্গের পাশে ওযে পূর্ণিমা সুন্দরী ; প্রকৃতি এই ভূমি আর পুরুষ সেই হলধারী। রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত বৃন্দাবন ; মাধব তুমি যাকে চাইছো, সেতো তাঁর দেহের অর্ধাঙ্গ ; মায়া, এখানে যোগমায়া এঁদের দ্বিখণ্ডিত করেছেন। ভাগবতে গোপী প্রেম তো "উর্জিত ভক্তি "। গোপী প্রেমই প্রকৃত প্রেম। প্রেমে কোনো স্বার্থ নেই।

ভক্তি চান ভগবান। গোপীরা পূর্বজন্মে ঋষি ছিলেন ;
ভগবানকে পতিভাবে আলিঙ্গন করতেই বৃন্দাবনের গোপীদের জন্মানো।  এতো ব্রহ্মানন্দের স্বাদ। ভূমি তো দুইপ্রান্তে দুইরকম, একদিক জাগতিক এবং অপরদিকে আধ্যাত্মিক। ধ্যানেই যে জগৎ সৃষ্টি রাধা মাধব৷
"তোরা যাবি কি না যাবি বল গো।।
তোদের শ্যাম কথার কথা।
আমার শ্যাম অন্তরের ব্যথা।।
তোদের বাজে বাঁশি কানের কাছে। "

প্রভু বিরহসাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন মথুরায় ; রাধা পরম বললেন, আপনি নিষ্ঠুর, আপনি হৃদয়হীন;আপনি কি সেদিন সে জগতের বাইরে চলে গেলেন। কি মর্মান্তিক যন্ত্রণা গোপীদের। আপনি রাসমন্দিরর রাধা বিগ্রহের পুজো করে রাধাকুণ্ডে বিসর্জন দিয়ে সেই যে মহাভারতে প্রবেশ করলেন, আর কি রাধা মনে পড়ে না!!  যে মর্মব্যথা ভরে এতো জল্পনা, এতো সুখ, এতো ভালোবাসা বাসি, কই আপনার বর্ণময়, কর্মময়, রসময় জীবনে সে কই প্রভু। জগতে একটা মাত্র আমিতেই আপনি রইলেন ; সেই রাত ভোরে কত কী হলো, কিন্তু তারপর আপনি নেই৷ কতো সহজে বন্ধন ছিন্ন করা যায় প্রভু!  আজ বললেন আপনি নাকি নিজেই বাঁধা পড়ে গেছেন।  এ যে মনে করিয়ে দিয়ে গেলো ওফেলিয়ার মৃত্যু। আচ্ছা!  সেদিন কি আপনি বর্তমান থেকে অতীতে নাকি ভবির বুকে হারিয়েছিলেন, তবে যে তিনকাল এক অনন্ত কাল।

হে মাধব! জাগরণ অবস্থায় বিচ্ছেদ। নিদ্রায় যে মিলন। আজ যে শোক সাধনায় পরিণত প্রভু। আপনি যে যৌগ৷ কৃষ্ণ পেলেই যে রাধা পাওয়া। সিদ্ধ সাধকরা সব রাধা। ভক্ত মানেই যে গোপী।।

"হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে"।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours