শ্রাবণী দাশগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতাঃ

একটা চলতি প্রবাদ শুনতাম, বয়স্থা মেয়ে সুন্দরী হয় না, সুন্দরীরা বয়স্থা হয় না। অতএব মেয়ে পঁচিশ ছুঁল মানেই বয়স কমিয়ে সাড়ে বাইশ! বি-এ পরীক্ষা শেষ হতে না হতে সম্বন্ধ আসা শুরু। লেখাপড়ায় ভালো হলে মাস্টার্স – সায়েন্স বা আর্টস্‌ স্ট্রিমে।

চেনা পরিজনকে বলা, মেয়েটার জন্যে একটা ছেলে দেখে দাও না! বাড়িতেই থাকে, সপ্তাহে তিনদিন টাইপ শিখতে আর একদিন গানের ক্লাসে যায়।
পাত্র চাইঃ- সুউপায়ী(প্রফেশন ভদ্রগোছের যা-ই হোক), বয়সে বড়ো অন্তত চার/পাঁচ বছরের বড়ো হতে হবে, দেখতে যেমনই হোক উচ্চতা কন্যার চেয়ে বেশী হওয়া বাঞ্ছনীয় (যাতে বরের বুকের কাছে মাথা রেখে ঘাড় উঁচু করে তাকে দেখতে হয়)।
পাত্রী চাইঃ- ফর্সা, সুমুখশ্রী, (অধিকাংশক্ষেত্রে)কর্মরতা চলবে না। গৃহকর্মনিপুণা হলে ভালো, না হলে শ্বশ্রূমাতা ‘নিজের মতো করে গড়ে নেবেন’ ইত্যাদি। কেউ কেউ চাকুরিরতা কন্যায় নিমরাজি, যদি মেয়েটি স্কুলশিক্ষিকা বা ছোটোখাট অন্য কিছু হয় (কারণ বিস্তারিত ব্লা ব্লা ব্লা ...)। (উহ্য) সংসারের দরকারে(উদা. শ্বশ্রূ অপারগ হলে), বাচ্চা হলে, চাকরি ছেড়ে দেওয়ার (মানসিক)প্রভিশন রাখতে হবে।
চেনা চিত্র। আমাদের সময়েও বিয়ের বয়স হওয়া পর্যন্ত মোটামুটি এই ছক প্রায় সত্তরভাগ মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে।
(ব্যতিক্রম ছিল, থাকে সব সময়েই। তবেই না সাধারণেরা শিখতে পারে, ভাবার সুযোগ পায়, পরের প্রজন্মকে এগিয়ে দিতে পারে।)

দিদি-মাসি-পিসিরা লাল বেনারসী, চন্দন, শাঁখা-পলা-চুড়ি পরে লজ্জামুখে বরের পেছনে, বউদি-মামী-কাকিমা একইভাবে নতুন বাড়িতে শ্বশ্রূর পায়ে পায়ে ‘মা’ ‘মা’ করে—। পোশাক-টোশাক নিয়ে শহরের কিছু বাড়িতে আর তেমন কড়াকড়ি নেই – ‘লিবারল’ শ্বশুরবাড়িতে সালোয়ার, ম্যাক্সি ‘পার্মিটেড’। সদ্য কলেজে ঢোকা কিশোরীর মনে রঙিন ফাল্গুণী স্বপ্ন ঘুরঘুর করে ...।
বউভাতের সকালে “সারাজীবন ভাত-কাপড়ের ভার নিলাম” বলে খাবারের থালা ও সঙ্গে একখানা কাপড় ধরিয়ে বিশেষরূপে বহনের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব, উপস্থিত আত্মীয়াদের প্রবল দাবীতে পিঠে একখানা কিল – উৎসবের মধ্যে অলক্ষ্যে আরম্ভ হয়ে যেত সংসারযাপন। মেয়েটির আপ্রাণ প্রচেষ্টা থাকত শ্বশুরবাড়ির মনের মতো হয়ে ওঠা। প্রতিমাসে বরের দেওয়া ‘হাতখরচের’ নির্দিষ্ট পরিমাণ, মাঝমাঠে শেষ হয়ে গেলে কুণ্ঠিতমুখে চাইতে গিয়ে ভ্রূ-কুঞ্চিত প্রশ্নের সম্মুখীন, ‘কিসে খরচ হইল’! অনেক বাড়িতে বর না বললেও বরের বড়ো গুরুজনেরা আড়ে-ঠারে কিম্বা স্পষ্ট করেই শোনান, ‘বউমার আমাদের বড়ো খরচার হাত। বরের টাকা নষ্ট করার আগে চিন্তা করতে হয়’ এবং ইত্যাদি।
কিছুদিনের মধ্যে ‘অমুকদি’র ছেলের বউ যা ভালো হয়েছে – একগালে চড় দিলে আরেক গাল বাড়িয়ে দেবে আর আমার ঘরেরটি দেখো!’ এসব নিয়ে চলতে চলতে নিরন্তর নিজেকে কেটে-ছঁটে মানিয়ে নেওয়া মাপসই করে নেওয়া, মাঝেমধ্যে মুখ ফুটে প্রতিবাদের চেষ্টা, বছরদুয়ের মধ্যে সন্তানের জন্ম। প্রথমে পুত্র এলে কেল্লা ফতেহ্‌ আর মেয়ে হলে চারদিকে ইল্যাস্টিক হাসি, ‘মেয়ে, তাতে কি হয়েছে? তবে ছেলে হলে আরো ভালো হত,’ কিম্বা ‘পরেরবার নিশ্চয়ই ছেলে হবে।’

গত তিরিশ বছরে এসবে কিন্তু উদাহরণযোগ্য বদল এসেছে। আমাদের প্রজন্ম বড়ো হতে হতে শ্বাশুড়ি স্টেটাসে উন্নীত। কলেজ, অফিস বা চ্যাট-সাইটে স্বনির্বাচিত পাত্র/পাত্রী, বিয়ের আগে লিভ্‌-ইন্‌ করে দেখে নেওয়া কম্প্যাটিব্ল কতখানি, সমবয়সী এমনকী বয়সে বেশ ছোটো বর, দু’জনের দু’শহরে বাস - ছেলে-মেয়ে দু’বাড়িতেই মেনে নিতে শিখে গেছে। শুরুতে প্রচলিত অভ্যস্ততায় ধাক্কা লাগলেও ‘যাকগে ওরা নিজেরা ভালো থাকলেই হল’ আপ্তবাক্যতে নিজের ধারণাকে আধুনিক করে নেওয়া–। আসলে আমাদের প্রজন্ম জন্ম থেকে মানিয়ে নেওয়ার পাঠ নিয়েছিল কি না!

এখনো বউভাতের সকালে ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠান হয়। আমার কন্যার কথামতো তার স্বনির্বাচিত বর ভাতকাপড়ের থালা ধরিয়ে বাড়ির সকলের সামনে স্বতস্ফূর্ত উচ্চারণ করে, ‘দু’জনে দু’জনের ভার নিলাম।’ আমার বন্ধুর আত্মীয়কন্যাটি বাঙালী বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে অনায়াসে তার বিদেশী বরকে বলতে পারে, ‘আমি সিঁদুর পরছি, তুইও পরবি।’ অতঃপর তারা দুজনে সিঁদুর মেখে সাতদিন বিবাহযাপন করে। ভালো লাগে যে, এই বিষয়গুলো এখন অনেকাংশে ভারহীন সাময়িক কৌতুকের পর্যায়ভুক্ত।

এহ বাহ্য! আসল হল আর্থনীতিক স্বাধীনতা এবং সেই বোধ। বিজ্ঞান বলে, মেয়েরা মাল্টি-টাস্কার। সমার্থক পুরনো প্রবাদ মনে পড়ে, ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। অতএব ‘চিরকাল বারোহাত কাপড়ে কাছা হয়না যাদের’ সেই স্ত্রীবুদ্ধিকে তুচ্ছ করার সাহস এখনকার ছেলেরা বিশেষ পায় না(হয়ত নিজেদের স্বার্থেই)। মেয়েরা এগোতে এগোতে ছেলেদের ছুঁয়ে ফেলেছে এবং ছাপিয়ে যাচ্ছে উচ্চাকাঙ্ক্ষায়, দক্ষতায়, স্যালারিতে। সুযোগ এলে বিদেশে অফিশিয়াল ট্রিপ করে আসছে। মেইল ইগোতে গোপনে হলেও লাগে বৈকি, যুগাতীত জন্মসংস্কার মন থেকে সরিয়ে মেনে নেওয়া সহজসাধ্য না কি?
আর আজকাল মেয়েরা স্পষ্টবক্তা এবং সর্টেড্‌। ডমিনেশন নয়, বন্ধুত্বে আস্থা রাখে।  কী ও কেন ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যৌথভাবে। যেখানে মেলেনা সেখানে আলোচনা, তর্কাতর্কি করে সমাধানে এসে পৌঁছে যায়।

আমার মেয়ে তার এক সিনীয়ার কলীগের কথা বলেছিল। উচ্চশিক্ষিত স্বামী-স্ত্রী দুজনে আলাদা কম্পানিতে ভালো পোস্ট-এ কর্মরত ছিল। মেয়েটির দ্রুত ক্রমান্নোতিতে বরের তুলনায় আয় বেড়ে যায় অনেকখানি। সন্তান জন্মের পরে শিশুকে সময় দেওয়ার জন্যে দুজনের একজনের চাকরি ছাড়ার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় সাধারণভাবে মায়ের চাকরি ছেড়ে ঘরে থাকার কথা, কিন্তু তাদের যৌথ সিদ্ধান্তে শিশুর বাবা চাকরি ছেড়ে ‘গৃহ-স্বামী’ এবং মা বাকি যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগোয়। আপাতত বছর চার-পাঁচ ধরে এই ব্যবস্থা চলছে। তাদের মধ্যে বিরোধ নেই এবং হয়ত পরিবারের অন্যান্যরা নির্লিপ্ত অথবা তাদের বক্তব্যকে এই দম্পতি গুরুত্ব দেয় না।

কোনো মন্তব্য না করলেও ব্যাপারটা যে ঠিক হজম করতে পারছি না মেয়ে বুঝেছিল। পরিষ্কার বলল, ভেবে দেখো যে উন্নতি বেশি করছে যার স্যালারি বেশি, চাকরিটা তারই রাখা উচিত নয়? এই যে এতসব ফেমিনিজমের বড়ো বড়ো কথা বলে/ভাবে লোকে, এ্যাট পার হবার জ্ঞান দেয় – এখনো কিন্তু বেশির ভাগের মাথায় বদ্ধমূল ধারণা ছেলেদের কোয়ালিফিকেশন, চাকরি, স্যালারি সবই তার বউয়ের চেয়ে বেশি হতে হবে। চাকরি ছাড়ার দরকার হলে মেয়েটিই তার ব্রাইট কেরিয়ার কম্প্রমাইজ করে ঘরে বসে যাবে। তাহলে আর আমরা এগোলাম কোথায়? বাবা কিম্বা বরের পয়সায় ফুটানি করে ফেমিনিজম-এর হাওয়া ওড়ানোতে আমি বিশ্বাস করিনা।

আমি এরপর কোনো উত্তর দিতে পারি নি। এরা অন্যভাবে চিন্তা করে। আমার পরিচিত একটি অত্যন্ত গুণী মেয়ে ভালোবেসে স্বেচ্ছায় শারীরিক প্রতিবন্ধীকে বিয়ে করে আনন্দে আছে। এই পারাটি যে খুব সহজ নয় তা অনুভব করি। মন থেকে সম্পূর্ণ গ্রহন করতে পারি বা না পারি, এদের চিন্তাকে সমীহ করি। এদের আন্তরিক শ্রদ্ধা করি।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours