শ্রাবণী দাশগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতা:

উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে সংখ্যা – ক্রিকেটের রান নয়, বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা! মৃতের সংখ্যা!! ইতালিতে একদিনে মৃতের সংখ্যা চারশ’ পঁচাত্তর – হয়ত একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। মিলিটারি নেমেছে শবদেহ সৎকার করার জন্যে, দেশাধিনায়ক আহ্বান করেছেন বয়স্ক ও অবসরপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসারদের, এ্যাক্টিভ ছাত্রছাত্রীদের। হাসপাতাল আর জায়গা দিতে পারছে না। লক্‌ ডাউন! লক্‌ ডাউন ইতালি। প্রাণচঞ্চল দেশে কল্পনাতীত এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।
‘আপাতত যাঁরা সুস্থ ঘরবন্দী থাকুন। ডাক্তারেরা আপনাদের জন্যে কাজ করছেন, আপনারা তাঁদের জন্যে নিয়ম মেনে চলুন’ – বলছেন ডাক্তার।
অতীতে এহেন আতঙ্কে কখনো কাটাতে হয়েছে বলে মনে পড়েনা। কানু বিনে গীত নেই-এর মতো করোনা বিনে খবর নেই অবস্থায় পৌঁছে গেছি আমরা। বন্ধুবান্ধব থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে গত মাসদেড়েক ধরে ক্রমাগত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাবৃদ্ধির খবর এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুর খবরও। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ভাইরাস আমাদের ঘরের দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে, তাও হয়ে গেছে পনেরো দিনের বেশি। শুরুতে শোনা গিয়েছিল দুজন আক্রান্ত – একজন হায়দরাবাদে, একজন দিল্লীতে। আজকের(২০-এ মার্চ, ২০২০) সরকারী পরিসংখ্যান বলছে ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দুশো ছয় এবং মৃতের সংখ্যা পাঁচ। পশ্চিমবঙ্গে এক অবিমৃষ্যকারীর অপরিণামদর্শিতার কারণে আরো ছড়িয়েছে কিনা এই মুহূর্তে জানা নেই। আজই জানা গিয়েছে আরো একজন আক্রান্ত, অতএব পরিসংখ্যান অনুসারে আপাতত আক্রান্ত দু’জন।
ভারত নাকি স্টেজ-টুতে আছে এখনো, আগামী দুসপ্তাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারীভাবে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে স্টেজ-থ্রীতে না পৌঁছনোর। চারিদিকে নানা সতর্কবার্তায় জানানো হচ্ছে ‘ডুজ্‌ এন্‌ ডোন্টস্‌’ - আইসোলেশন ও সোশ্যাল ডিসটেন্সিং। অতি প্রয়োজন ছাড়া পথে বেরনো থেকে রোজকার খবরের কাগজ - বন্ধ সবই। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ও ব্যক্তিগতভাবে আর যা করণীয় প্রত্যেকের প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু এই জনবহুল দেশে কত সংখ্যক মানুষ সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলছে ও চলতে পারছে? আতঙ্কের শেষ কবে হবে, কোনো আশাভরসা দিতে পারছেন না বিশ্বের বৈজ্ঞানিক মহলও। এক ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, স্টেজ-থ্রী এত ডেঞ্জারাস, স্টেজ-ফোরের চেহারা তাহলে কেমন? তিনি বললেন, জানার দরকার নেই, সে অতি ভয়ঙ্কর। ভয় কমল না বরং বাড়ল। ইতালি কি স্টেজ ফোরে পৌঁছে গেছে? নেট খুলে বিবরণ পড়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম - যেন হাড় হিম করা। ‘ফাইনাল সল্যুশন’, ‘ডিসইনফেকশন’ এমত সাঙ্কেতিক শিউরে-ওঠা শব্দ হিটলারের আমলে ব্যবহৃত হত। স্টেজ-থ্রী, স্টেজ-ফোর শব্দসমূহ কেমন সেই আবহ নিয়ে এল।

গতশতকের উপন্যাসে মহামারীর কাহিনি পড়া গেছে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়নি। ইয়েলো ফিভার, ব্যুবনিক প্লেগ, এশিয়াটিক কলেরা, ম্যালেরিয়া, গুটি বসন্তর মতো মারাত্মক প্রাণঘাতী অসুখ একের পর এক গ্রাম উজাড় করে দিয়েছে। অবশ্য একদিকে দেখলে তখন অনেকটা লোক্যালাইজড্‌ ছিল - একই সঙ্গে বিশ্বের প্রায় সব মহাদেশে ছড়িয়ে এভাবে পড়ার ঘটনার কথা শোনা যায়নি।
কারণ হয়ত মূলত যাতায়াতের সীমাবদ্ধতা। সেযুগে সাধারণ মানুষ মৃত্যুভয় এড়াতে প্রাণ হাতে করে পালিয়েছে অনতিদূরে গ্রাম/শহরে যেখানে রোগ তখনো হানা দেয়নি - এপর্যন্তই। সেকালে প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি বা হলেও সর্বস্তরে পৌঁছাতে পারেনি। মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল। অন্ধত্ব ছিল, কুসংস্কার ছিল, সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতাবোধের অভাব ছিল। মানুষ অসহায় ছিল আজকের চেয়ে অনেক বেশি। খবর সরবরাহ করার সক্রিয় সংবাদ মাধ্যম বলতে বিশেষ কিছু ছিল না।
আজকের দিনে অর্থাৎ একুশ শতকের পৃথিবীতেও বহুদর্শী অভিজ্ঞ মানুষ অসহায়ভাবে বালির ঝড়ে দিশাহীন উটের মতো – কবে ভয়াবহ সময় উৎরে যাবে তার প্রতীক্ষায়। আজও এদেশে মানুষ কিছু অসৎ ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীর পাল্লায় পড়ে গোমূত্র পান করছে প্রতিষেধকের নামে।

সত্তরের দশকের প্রথমভাগে প্রাইমারিতে পড়ি। মনে পড়ে, প্রতিবছর গুটিবসন্ত এবং কলেরার প্রতিষেধক টীকা দিতে বাড়িতে আসতেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। বোতামের মতো বহুমুখী ছুঁচ ফুটিয়ে দেওয়া হত বসন্তের টীকা। বাহুর উপরিভাগে নিতে হত কলেরার টীকা, বেশ যন্ত্রণাদায়ক ছিল। নিজেদের সাহসী প্রমাণ করতে ‘আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান’ করে হাত বাড়িয়ে দিতাম। সমসাময়িক যারা নিতে ভয় পেত, পালাত, তাদের প্রতি বেশ অনুকম্পার ভাব থাকত। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে/পরে এসেছিল কঞ্জাংটিভাইটিস যার স্থানীয় নাম হয়েছিল ‘জয় বাংলা’। রক্তচক্ষুরা কালো চশমায় চোখ ঢেকে রাখত। চোখে হাত দেওয়া, কারো সংস্পর্শে যাওয়া, তার জামাকাপড় ইত্যাদি ছোঁয়াতে কথকিঞ্চিৎ নিষেধাজ্ঞা ছিল। যাই হোক, সে রোগ প্রাণনাশক ছিল না।   

করোনাতঙ্কের অনুষঙ্গে অনেকেই প্যারানয়েড। প্রায় ওসিডি-র পর্যায়ে যাচ্ছে মানুষের বারবার হাত ধোওয়া। শুচিবায়ু পিসিমার মতো শোনালেও একমাত্র ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার উপায়! ঋতুবদলের সময়ে এমনিতে সামান্য সর্দি- শুকনো কাশি, গলা খুশখুশ থাকে। অল্পেতে চাপা আতঙ্ক হচ্ছে, কে জানে বাবা, কি হল? ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, শেয়ার হচ্ছে নিমেষে। একটিতে “এক ছোবলে ছবি”র মতো ছুঁলেই করোনা চেন সংক্রমিত করছে একের পর মানুষকে। অন্যটিতে দিনে সাতান্নবার কুড়ি সেকেণ্ড করে হাত ধুয়ে হাতের চামড়া উঠে মাংস বেরিয়ে এসেছে। আরেকটিতে বেসিনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত হাত ও জলের কল অল্টার্নেট করে ধুয়েই চলেছে একজন। বাথরুম ছেড়ে বেরোতে পারছে না। বলা বাহুল্য এসবই বিদেশী ভিডিও।
মাথার ভার হাল্কা করতে গান/ছড়া প্যারাডি হচ্ছে, মজাদার মীম হচ্ছে – কিন্তু চাপা আতঙ্কগ্রস্ত প্রায় সকলে। হাতদুখানা নিয়ে কীযে করা যায় ভেবে ওঠা যাচ্ছে না। আমজাদ বলছে “য়ে হাঁথ মুঝে দে দে ঠাকুউর...”।
মনে মনে বলি ‘বকলমে আমার হাতদুখানার দায়িত্ব নাও ঠাকুর – জয় জগড়ঁনাথঅ’! ।।
স্পীড নয়, স্লো ডাউন... এ অবস্থায় সেই টিঁকবে, যার সংখ্যাবৃদ্ধি হবে না। পায়ের নিচে সর্ষে মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে ধীরগামী হতে হবে – হয়ত প্রকৃতির এই নির্দেশ। জীবনযাত্রা নিয়ম মেনে করতে হবে অতি নিয়ন্ত্রিত, যতদিন না এই রোগের করাল ছায়া পৃথিবীর ওপর থেকে সরছে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours