চৈতালী সেনগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতা:

ষাটের দশকের শেষের দিকে এক অসামান্য জনপ্রিয় চিত্রায়িত ধারাবাহিক কৌতুকমালা ওরফে কমিক্স "নন্টে ফন্টের " আবির্ভাবের পঞ্চাশ বৎসর পূর্ণ হল। খবরটা পাবার পর কিছুক্ষণের জন্য একটু নস্টালজিক লাগছিল বটে। নিমেষে তলিয়ে গিয়েছিলাম প্রায় চল্লিশ বছর অতীত স্মৃতির গভীরে যেখানে এক একটি ছোট ছোট গল্পের সম্ভারে লুকিয়ে রয়েছে অসাধারণ ছবি সহ রোমাঞ্চকর, কৌতুক রস আর নীতিবোধ সমৃদ্ধ কথা আর কাহিনীমালা। ১৯৬৯ সালে  ' কিশোর ভারতী ' পত্রিকায় একজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রায়ন শিল্পী নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্টি এই "নন্টে ফন্টে" শুধুমাত্র কচিকাঁচাদের নয়, যে কোন বয়সের মানুষের মনে নির্মল আনন্দ প্রদানে সক্ষম হয়েছিল। সেই সময় শুকতারা পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত  "হাঁদা ভোঁদা" নামক আরও একটি কমিক্স আর তার পাশাপাশি সমগোত্রীয় আর একটি অনুরূপ কমিক্সের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নন্টে ফন্টের আত্মপ্রকাশ।
      প্রথম কয়েক বছর অবশ্য এই কমিক্সে চরিত্র সীমাবদ্ধ ছিল মাত্র দুজনের মধ্যে..... নন্টে আর ফন্টে। কিন্তু ১৯৭৩ সালে এই কার্টুন চরিত্রে যোগ দিলেন বোর্ডিং- এর সুপারিনটেনডেন্ট স্যার আর কেল্টুদা। এই দুটি চরিত্রের সংযোজনের ফলে নন্টে ফন্টে কমিক্স এক আলাদা মাত্রায় মাধূর্য আর মাদকতা পায়। ছিপছিপে গড়নের নন্টে আর ফন্টে, একটু দুষ্টুমি আর রসিকতায় ভরপুর দুজন কিশোর, প্রয়োজনে বুদ্ধি বলে প্রকৃত দুষ্টের মোকাবিলা করতে সক্ষম, নন্টের মাথায় একটি ছোট্ট টিকি, অপর দিকে কেল্টু, নন্টে ফন্টের থেকে একটু বয়সে ও উচ্চতায় বেশি , তাই তাকে ডাকাও হয় কেল্টুদা। মাথায় কোঁকড়ানো চুল, বক্র বুদ্ধিতে পটু এক পরিপক্ক মাথা, যে নিজের সুবিধা লাভের জন্য অন্য যেকোন কাউকে অসুবিধায় ফেলতে পারে। গল্পে প্রায়ই দেখা যায় কেল্টুর অতিচালাকির দ্বারা নন্টে ফন্টে প্রথমদিকে বিপদে পড়লেও শেষ পর্যন্ত বুদ্ধির জোরে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। সুপারিনটেনডেন্ট স্যার একজন স্থুলদেহী আর ভোজনরসিক মানুষ।  গল্পের শেষ অঙ্কে দেখা যায় কেল্টুর চালাকি সুপারিনটেনডেন্ট স্যারের সামনে ফাঁস হয়ে যায় তারপর কেল্টুদার পেছনে স্যারের ছড়ি হাতে দৌড়ের দৃশ্য। এইরূপে হাস্যরস শিক্ত দুষ্টের দমনের দ্বারা অনায়াসে শিশু সুলভ মনে দাগ কাটতে সক্ষম আর দীর্ঘদিন মনের অন্তঃস্থলে বিরাজ করা সম্ভব হয়েছে।
       প্রসঙ্গত বলে রাখি নন্টে ফন্টে ছাড়াও নারায়ণ বাবু.....হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, বাহাদুর বেড়াল, ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়, ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ, ডানপিটে খাঁদু আর তাঁর ক্যামিকাল দাদু, কৌশিক রায়, পেটুক মাস্টার বটুকলাল, শুঁটকি আর মুটকি এইরকম বহু আকর্ষণীয় কার্টুনের সৃষ্টি করেছিলেন যাদের মধ্যে বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা ভোঁদা আর নন্টে ফন্টে সবথেকে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এদের মধ্যে সবথেকে প্রবীনতম সৃষ্টি হল "হাঁদা ভোঁদা"...যার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬২সালে এবং ২০১২ সালে এই কমিক্সের বয়স ৫০ বছরে পদার্পণ করে। এরপর এসেছে বাঁটুল,১৯৬৫ সাল। ২০১৫ তে তারও বয়স ৫০ ছুঁয়েছে। এবার ছিল নন্টে ফন্টের পালা।  আমার মত যদি বলি, এই সব কটি কার্টুন কমিক্সের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যে চরিত্রকে রাখা যায় সে হল, নন্টে আর ফন্টে।
       সেসময় যুগটা ছিল অন্য, আজকের মত যান্ত্রিক আর ইন্টারনেটের আওতা থেকে অনেকটা ব্যাতিক্রম। বইয়ের ভারে নুয়ে পড়া স্কুল ব্যাগ পিঠে নিয়ে,  আর পড়াশুনার ভারে নুয়ে পড়া মাথা নিয়ে আজকের শিশুরা ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছে তাদের প্রাপ্য শৈশব, আকাঙ্খিত কৈশর। এযুগের শিশুদেরও এইরূপ সহজবোদ্ধ , নীতিবোধ মূলক , হাসি ঠাট্টার মধ্যে ঠিক ভুল বিচারের মৌলিক ক্ষমতা সম্পন্ন কমিক্স অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে,  সময়ের অভাব সত্ত্বেও আকর্ষণীয়তার বিচারে এই সৃষ্টি আজও জয় করে রেখেছে সমস্ত বাঙালির হৃদয় সমান দক্ষতা নিয়ে।
         ২০১৩ সালের ১০ই মে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে এই অসামান্য কিংবদন্তি শিল্পীকে "বঙ্গ বিভূষণ" সম্মান প্রদান করা হয়।  এই সালেই বইমেলাতে লালমাটি প্রকাশনার পক্ষ থেকে "নারায়ণ দেবনাথ সমগ্র"  প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশ করা হয়। একটি সাক্ষাৎকারে শিল্পী আশা প্রকাশ করেন , তাঁর এই সৃষ্টি আগামী আরও তিনশো বছর বেঁচে থাকবে এবং তিনিও বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অগণিত পাঠকের মনে।
        বর্তমানে কিছু আইনি জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে এই সৃষ্টি। শিল্পী অভিযোগ করেন নন্টে ফন্টে এখনও মানুষের মনে সমান জনপ্রিয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে তাঁর প্রাপ্য রয়ালটি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অপর দিকে যাঁদের বিরুদ্ধে শিল্পীর এই অভিযোগ সেই পত্রভারতীর কর্ণধার ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ২০১৪ সালে বই প্রকাশের জন্য শিল্পী লিখিত সম্মতি দিয়েছিলেন, কিন্তু জুলাই মাসে যখন‌ এই বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়, তখন কোন উত্তর তাঁরা পাননি।
    বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে বহু তর্ক বিতর্ক, তবু আমার মত সাধারণ কিছু মানুষের মত হল, এমন বিরল প্রতিভা এবং তাঁর সৃষ্টি সমূহ যেন উপযুক্ত মর্যাদা পান। এই অনবদ্য প্রবীন স্রষ্টা বেঁচে থাকুন আপামর বাঙালিদের মনে যোগ্য সম্মানের সঙ্গে, এবিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাচ্ছি।  কবির  ভাষায়  "হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন,
তা সবে ( অবোধ আমি) অবহেলা করি.....
শুধু এই বাংলার মাটিতে খুঁজলে দেখা যাবে অনেক কালজয়ী শিল্পীরা  তার প্রকৃত প্রাপ্য সম্মান থেকে অবহেলিত হয়েছেন,  এখনও হচ্ছেন..... অবিলম্বে এর প্রতিকার না হলে আমরা আরও অনেক সৃষ্টি সম্ভার থেকে বঞ্চিত থাকবো। সময় এসেছে সকল স্তরের মানুষের এগিয়ে আসার, সহযোগিতামূলক হাত বাড়িয়ে দেবার।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours