শাঁওলি দে, লেখিকা, জলপাইগুড়ি:

দৃশ্য একঃ  “তিনটি প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হচ্ছে রঙিন বাংলা ছবি   ‘লাঠি’ , শ্রেষ্ঠাংশে  ভিক্টর ব্যানার্জী ...” দূর থেকে ভেসে আসছে আধা শহর , আধা মফস্বলের একমাত্র সিনেমা হলে প্রতি শুক্রবার করে পালটে যাওয়া নতুন সিনেমার বিজ্ঞাপন। হাফ প্যান্ট ,ফুলছাপ টেপ জামা পড়া কতগুলো ছেলেমেয়ে খেলা থামিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। রিক্সাটা কাছে আসতেই তারা ছুঁড়ে ফেলা লাল হলুদ কম দামি কাগজগুলো কুড়িয়ে নিল অনাবিল আনন্দে।

দৃশ্য দুইঃ  ছুটির দিনগুলোতে চটজলদি হাতের কাজ , রান্নাবাড়ি সেরে তৈরি হয়ে নিচ্ছে আশপাশের বাড়ির মহিলারা। সকাল থেকেই  ব্যস্ততা যেন বেড়ে গেছে অন্যান্য দিনের চাইতে আরও কয়েক’শগুন। দুপুরের খাওয়ার সময়টা একটু এগিয়ে এনে , বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে একদল পাড়াতুতো বৌদি কাকিমা লাইন দিয়েছে সিনেমা হলের সামনে।

দৃশ্য তিনঃ বাড়িতে ছোট কাকু বা পিসির বিয়ে উপলক্ষে হই হট্টগোল। নতুন কাকীমা বা পিসেমশাইকে নিয়ে বসেছে আসর। অন্তাক্ষ্যরী , ঘন ঘন চা ...এসবের মাঝেই প্ল্যান হয়ে গেল ম্যাটিনি শো’তে সবাই মিলে সিনেমা হল। কী সিনেমা ? কুছ পরোয়া নেহি। প্রায় উনিশ কুড়ি জন মিলে চলল পাশের হলে। উপচে পড়া ভিড়ে হইহই করে সিনেমা দেখার মধ্যে যে উৎসাহ  ছিল তা এখন কোথায় ? বিরতির সময় কাকু বা পিসেমশাই’এর ঘাড় ভেঙে বাদাম খাওয়া ? সেই চিনে বাদাম ভেঙে ভেঙে জামা নোংরা করা আর আঙুলের ডগায় লেগে থাকা বীটনুন একটু একটু চেটে খাওয়ার স্বাদ যেকোনো হালফিলের ‘স্ট্রীটফুড’এর চাইতে কম কি?

  আমরা যারা নয়ের শেষের দিকে কিম্বা এই দশকের শুরুতে একটু একটু করে বেড়ে উঠছি তাদের জন্য সিনেমা হলটা ছিল কেমন যেন অক্সিজেনের মত। স্কুলে থাকাকালীন যখন কালে ভদ্রে মা ,কাকীমার সঙ্গে সিনেমা হলে যাওয়ার সুযোগ মিলত তখন নিজেকে মনে হত যেন পৌঁছে গিয়েছি সব পেয়েছির দেশে। এইভাবেই দেখা হয়েছিল বেশ কিছু সিনেমা। কলেজ পালিয়ে নতুন শুরু হওয়া বন্ধুত্বকে ভালোবাসার মোহর লাগাতেও ঠিকানা ছিল সেই সিনেমা হল। যে সময়ের কথা লিখছি তখনও সিনেমা বা ফিল্ম না বলে ‘বই’ দেখতে যাওয়াই ছিল অন্যতম অবসর যাপন। টিকিট ব্ল্যাক করে হলেও ‘বই’ দেখতে যেতেই হবে সদলবলে কিম্বা ‘শুধু দু‘জনে’।

   সব জায়গায় যে সিনেমা হল ছিল তাও নয়।  যেসব জায়গায়  ছিল না ,সেখানে ভিডিও হলই সই। ‘গুরুদক্ষিণা’ কিম্বা ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র মতো সিনেমার টিকিট বিকোত রমরমিয়ে। আবার টাউনে ‘বই’ দেখতে যাওয়ারও চল ছিল। পরীক্ষার শেষে মা’এর সঙ্গে কিম্বা দু’চারজন ছোটবেলার বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে দেখা হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু সিনেমা।  দেখা শেষে হাতের নাগালের রেস্টুরেন্টে মোগলাই পরোটা বা পুরি তরকারি খেয়েই ছুটতে ছুটতে আবার বাস ধরা। সেই উত্তেজনাই বা এখন আর কোথায় ?

  সিনেমা হল ‘কালচার’টা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পালটাতে পালটাতে একেবারেই বদলে গেছে। বড় বড় শহর তো বটেও গ্রাম বা জেলা শহরগুলিতেও হাতে গোনা সিনেমা হল আর তাতে দর্শক সংখ্যা আরও কম। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা শপিং মলের মতোই এখন সিনেপ্লেক্স  , মাল্টিপেক্সের ছড়াছড়ি। তিন চারটে স্ক্রিণের ঝা চকচকে এসিতে দুটো তিনটে সিনেমা চলছে একসঙ্গে। আমরা সিনেমার আগের ট্রেইলর দেখার জন্যও মুখিয়ে থেকেছি একসময় আর এখন সেই সময়টুকু কেড়ে নিয়েছে ‘সেলফি’ আর ফেসবুক স্ট্যাটাস । মুহূর্তে এক’শ লাইক আর কমেন্টের ছড়াছড়ি, দেখা শেষ হতে না হতেই গরম গরম ‘রিয়্যাকশন’। সবেতেই এক চূড়ান্ত ব্যস্ততা , যান্ত্রিকতা। মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল আন্তরিকতা , সম্পর্কের উষ্ণতা , অবসর যাপনের অনাবিল আমেজ , ছেলেমানুষী আরও কত কী!
    দক্ষিণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তরেও এখন ‘দখিন হাওয়া।’ সিনেমা হলের সংখ্যা কমতে বসেছে। হল মালিকেরা মন দিয়েছেন অন্য ব্যবসায়। শিলিগুড়ি শহরের বিখ্যাত ‘ঊর্বশী’ হল যেমন বন্ধ  হয়ে গিয়েছে তেমনি কোচবিহারের প্রান্তিক শহর হলদিবাড়ির শ্রীমা সিনেমা হল ,যেখানে ‘নাচ নাগিন নাচ’এর মতো সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকেও পাওয়া যেত না ,সেটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুবছর। বন্ধ হলটিতে এখন আগাছা ভর্তি ,বাইরের লোহার গেটে মরচে পড়ে প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। সামনে চপ সিঙ্গাড়ার দোকান। সন্ধেবেলায় খারাপ ছেলেদের আড্ডা। এই প্রজন্ম জানেই না ওখানে এককালে একটা , চারটে, সাতটার শো’গুলো কেমন হাউসফুল থাকত!

   সদর জলপাইগুড়ির ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল রূপশ্রী ভেঙে তার জায়গায় বিরাট মার্কেট কমপ্লেক্স হয়েছে তাও অনেক বছর হয়ে গেল। বাকী দু’তিনটে হলেও হাতে গোনা দর্শক। যে ছেলেটি টিকিট ব্ল্যাক করত অন্য কাজে মন দিয়েছে । জানি না ওই কমপ্লেক্সের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওর বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে কি না?  বাথরুমের সামনে বসে থাকা মহিলাটা আজকাল বেশি পয়সা চায় । জিজ্ঞেস করলে বলে ,’আগে লাইন লেগে থাকত, এখন কেউ আসে না। কামাই একেবারে নেই।এই কাজ করে সংসার চলে না আর। ’ রায়গঞ্জ ,মালদা , বালুরঘাট , ইসলামপুর যে জায়গার নামই বলি না কেন ,অবস্থা একই !

  আজকাল শিক্ষিত রুচিশীল মানুষেরা সিনেমা হল শুনলেই নাক কোঁচকায়। বরং তার চেয়েও অনেকগুণ বেশি টাকায় টিকিট কেটে পৌঁছে যায় মাল্টিপ্লেক্সে। চিনে বাদাম ,মোগলাই’এর জায়গা নিয়ে নিয়েছে পপকর্ণ কিম্বা পনির টিক্কার মতো খাবার।

   সব জায়গাতেই প্রায় একই অবস্থা। উত্তরের সিনেমা হলগুলো ধুঁকছে। আর এই ধুঁকতে ধুঁকতেই কখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আমরা কেউই টের পাব না। যেমন করে একে একে সব পুরোনো কিছুকে ছেড়ে আসছি আর এক পা এক পা করে এগোচ্ছি বিশ্বায়নের দিকে, তেমনি করেই একদিন সব শেষ হয়ে যাবে ,থেকে যাবে টুকরো কিছু স্মৃতি ।আর এই স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে বেঁচে থাকবে কিছু মানুষ যারা সাক্ষী এমনই ঐতিহ্যবাহী কতকিছুর !

   উত্তরেও আজকাল আকাশ দেখা যায় না। বড় বড় বিল্ডিং যেন একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মাঠগুলো হা পিত্যেশ করে বসে থাকে কচি কচি পা’এর দামাল দৌড়ের  জন্য। সদ্য কিশোর কিশোরী এখন আর মা’এর হাত ধরে সিনেমা হলে যাওয়ার অপেক্ষা করে না। সময় ওদের মুঠোয় ভরে দিয়েছে সব কিছু।

যা চাই সবই হাতের মুঠোয়। পাড়ার কাকিমা বৌদিরা একসঙ্গে দলবেঁধে সিনেমা হলে যাওয়ার কথাই বা ভাবে কি ? ওরা তো একে অন্যকে ঠিকমতো চেনেই না ! বিয়ে উপলক্ষে এখন বসে ডিজে জোন সঙ্গে সেলফি ম্যানিয়া।  সব সবকিছু বদলে গেছে। বদলে গেছি সেই সময়ের আমরা,  আমিও।

  তবু আজও অবসরে বা কোনো অলস ফাগুন দুপুরে যখন পেছনে তাকাই দেখতে পাই হাফ প্যান্ট ,ফুলছাপ টেপ জামা পড়া ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোকে। কান পাতলে শুনতে পাই পাড়ার এক কাকু রিক্সা করে বলে যাচ্ছে তিনটি প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত সিনেমার কথা। সেই কাকুও মারা গেছেন বহুদিন। ওঁর সঙ্গে সঙ্গেই যেন হারিয়ে গেছে সেই সোনালি বিকেল , হলুদ বসন্তের দিনগুলি। 

  চোখ বুজলে সামনে ভেসে ওঠে বদ্ধ টিকিট কাউন্টারের ছোট্ট ফুটোয় হাত ঢুকিয়ে হালকা সবুজ অথবা গোলাপি টিকিট নেওয়া আর ওর লাগে লেগে থাকা কাঁচা রঙের গন্ধ। গাঢ় অন্ধকারে হলের ভেতর দিশাহীন ঢুকে পড়া ,তারপর ছয় ব্যাটারির টর্চ হাতে নিয়ে থাকা কাকুর দেখিয়ে দেওয়া সিটে নিজেকে নির্দ্ধিধায় সঁপে দেওয়া তিনঘন্টার জন্য। নারকেলের ছিবড়ে দিয়ে তৈরি ছেঁড়া ফাঁটা এবড়োখেবড়ো গদিতে বসার যুত ছিল না ঠিকই মনের শান্তি ছিল প্রচুর। সিনেমা শেষে ছাড়পোকার কামড়ে ফুলে যাওয়া পা নিয়ে চিন্তা ছিল না একচুলও।

   এসব এখন আর কোথায় ? পাঁচ ছয় ইঞ্চির মুঠো ফোনে কিম্বা কোলে নিয়ে রাখা ল্যাপটপে সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত ছেলেমেয়েদের কাছে এসব কিছু অধরাই। জীবন তাদের আরাম দিয়েছে ঠিকই ,সঞ্চয় করে রাখার মতো কিছুই কি দিতে পারছে ? দশ জিবি নেট ডেটা দিয়েছে , ঐতিহ্য ধরে রাখার মতো হৃদয় দিয়েছে কি ?

   কলকাতা বা অন্যান্য মেট্রো শহরগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে উত্তরবাংলা তার নিজস্বতা হারাচ্ছে বা বলা ভালো হারিয়ে ফেলেছে। তাই শুধু সিনেমা হলই নয় যাত্রাপালা , পালাটিয়া ,পাবলিসিটি , পুতুলনাচের মতো সবকিছু মুছে যাচ্ছে উত্তরের গা থেকে ,আর এই সাফ সুতরো উত্তরকে বড়ো অচেনা লাগে আজকাল । নিজের বলে মনে হয় না।

  শুধু ই-টিকিট হাতে নিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে ঢোকার সময় কানে বাজে দুটো ব্যালকনি ,সাইড দেবেন।

  আমি তো শুনতে পাই । আপনারা পান না ,তাই না ?

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours