জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা, দুর্গাপুর:

জাতীকে নির্মান করতে হয়। আকাশ থেকে বজ্র পরে । কোন জাতী লাফ দিয়ে পরে না। কান জাতী যখন অজস্র পরস্পর বিরোধীতাকে অতিক্রম করে নিজেকে যখন কোন রাষ্ট্রীয় রুপে বিকশিত করার সুযোগ পেয়ে যায়, সেই জাতীসত্বার একাত্মতাকে সামনে রেখে যে কিভাবে একটা জাতীগোষ্টি নির্মান করা সম্ভব তা শেষবার ব্রাজিলের  ফিনান্সিয়াল রাজধানী,  সাও-পলো ঘুরে এসে টের পেয়েছি।

এই সুত্রেই একটা আলাপচারিতার বিষয় উল্লেখে রাখলে ভালো হবে। তখন যুক্তফ্রন্টের কাল। একবার, রাজ্যের শিল্প মন্ত্রী তথা সি পি আই এম দলের পলিট ব্যুরোর সদস্যের সাথে কোলকাতা যাত্রার সোয়ারী হয়েছিলাম। পথে অনেক কথার মধ্যে,সাম্প্রদায়ীকতা বিরোধী সংগ্রামের যে একটা ভিন্ন দিক রয়েছে, সে কথাটা উঠাতে  গিয়েই প্রশ্ন করলাম
----- আমরা কেন, উপমহাদেশের দেশগুলির ভেতরকার, বিরোধের যায়গাটিকে কিছুটা দূরে রেখে, একতার যায়গা গুলিকে বেশি বেশি সামনে এনে কেন বিরোধের যায়গাটিকে পেছনে ঠেলবার চেষ্টাকে খাটো করে দেখছি। আমি বল্লাম, অর্থনৈতিক সামাজিক সম্পর্ক,  দুরের  ইতিহাসগত পরিপ্রেক্ষিত ছাড়াও, স্বাধীনতা আন্দোলন,  সংগীত কলা  সাহিত্য, , , ভাব ও ভাষা এবং সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিকে,উপামহাদেশে অনৈক্য থেকে একতার দিকগুলি, প্রধান হলেও, এই  অনৈক্যের দিকগুলিকেই সামনে এনে, যখন রাজনৈ্তিক ফয়দা নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে
----  তখন একতার দিকগুলিকে সামনে নিয়ে এসে একতার শ্রোতগুলিকে সামনে এনে, কেন প্রতিরোধের প্রাচীর তোলা হবে না? তখনই, সাও - পোলো মিউজিয়া্মের  কথা উল্লেখ করেছিলাম।

সালটা সম্ভবতঃ ২০০৪ হবে। একটা আন্তর্জাতীক সম্মেলনে সাও পোলো যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মাত্র বছর খানেক পূর্বে, কমিউনিষ্ট নেতা লুলা দ্যা সিলভা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। হোটেলেই এসেছিলেন দেখা করতে। এর আগে দেখেছিলাম ১৯৯৮ তে, প্যারিসে কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টোর ১৫০ তম বার্ষিকী সম্মেলনের প্রেসিদিয়ামে।এবারে দেখলাম অনেক স্মার্ট।
ব্রাজিলে পা' রাখলেই যে কোন সমাজ বিজ্ঞানী, যিনি দর্শনের সর্বোচ্চ শিখর দেশ থেকে ব্রাজিলের জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতটিকে সামনে এনে দেশটার রাজনৈ্তিক বিন্যাসের পরিমাপ করার চেষ্টা করবেন
----- তিনিই বুঝতে পারবেন, ব্রাজিল রাজধানী ব্রাজিলিকা এবং অর্থনৈ্তিক রাজধানী, আমেরিকান মিলিটারী তন্ত্রের সব রকম প্রহেলিকা এবং রাজনৈ্তিক জুয়াচুরীকে পেছনে রেখে, প্রথমে শ্রমিকেরা এবং তার পাশে পাশে সাধারন মানুষ কেমনভাবে সাম্যের কাছাকাছি এসেছে।
----  এইভাবেই ব্রাজিল একপ্রান্তে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলির ফ্যাসিস্ত শক্তির আমেরিকান আধিপত্যকামীতার  অন্যপ্রান্তে লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার 'রাজধানীর' দ্বৈরথ কেন্দ্র হিসেবে চিনেছিলাম।

যে ব্যক্তি ইস্পাত ও কয়লার মতো দুটি, আন্তর্জাতীক শক্তির প্রধান হিসেবে
কাজ করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ সেই  জীবন রায় জাতীয়তাকে
------  যেমন আন্তর্জাতীকতার অভিমুখে এক প্রবাহ হিসেবে দেখেছিলাম, কোন পঁচা জমাট জল নয়, এবং বুঝেছিলাম জাতীয়তাকে শ্রোতবতি করেই শ্রমিক একতা তার আন্তর্জাতীক অভিমুখটি চিহ্নিত করতে পারবে।  অন্যথায়, শ্রমিক আন্দোলন  নিজেই আঞ্চলিক সত্বার  বদ্ধ জলাধারে আটক হয়ে পড়বে।

এসব সুত্র ধরে যত এগিয়েছি,
দেখেছি জাতীয়তা যেন নিজেই  সপ্ত সুরের মতোই অজস্র উপাদান  আন্তর্জাতীকতায় আবদ্ধ । সেখানে কোন সুর একান্তে  পূর্ণতা পেতে পারে না । ধর্ম সেখান একক উপাদান, তেমনি ভাষা, বিদ্যার একাত্মতায় জ্ঞান এং তার সাংস্কৃতিক অভিমুখ, তার সাথে বেশ, ভুষন, ব্যঞ্জন, ইতিহাস থেকে পাওয়া বীর মোহনলালের বীরত্ব কিংবা মিরজাফরেরে বিশ্বাসঘাতকতা, মেধা  এবং এমন কি বেশ, প্রাকৃতিক বৈচিত্রের বন্ধন
----  এই সব কিছুকেই চিনেছিলাম   সপ্তু সুরের একাত্মতাতায়  রবীঠাকুরের 'বিবিধের মাঝে মিলন মহান'।
এই সব  এবং জেলার আন্দোলনের উপর আলাপচারিতাতেই অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলাম। কমরেড নিরুপমকে সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ৩০ বছর যুক্ত ফ্রন্টের সরকার চালানোর পরেও  কেন কোলকাতায়
------  একটি উপমহাদেশের সংগিত, কলা, সাহিত্য, শিল্প চেতনা  ইত্যাদিকে নিয়ে একটি যৌথ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা গেলো না কেন।
------  কমরেড সেনকে,  তখনই - সাও পোলোর সেই মিউজিয়ামটির কথা বল্লাম। সাও পোলো লাতিন আমেরিকা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সেখানে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলির
------- শিল্প কলা ভাস্কর্য্য এবং সংস্কৃতির সম্ভার থেকেও, একটা একাত্মতা বোধ যেন আমার চিত্তকে দোলন দিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, যেন সেই মিউজিয়ামটি ভারতীয় উপমহাদেশের একাত্মতার প্রতিবিম্ব।

সব  থেকে যেঁ নিনিষটি আমায় মথিত করেছিলো, তা মিউজিয়ামের মধ্যমনি হিসেবে একটি স্তম্ভ। জেনেছিলাম, এই স্তম্ভটি - মিউজিয়ামকে দর্শকদের সামনে ইন্ট্রডিউজ করছে।
----- জানিনা, সেটা কোন কোন সংস্কার কিনা , যে সংস্কারকে -- সেই একুশ বছর বয়সে শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম, এক চুড়ান্ত ঘৃ্না হিসেবে
চিত্তে প্রস্তরিভূত হতে দিয়েছিলাম
----  কিছুটা ধনুকের মতো ঢাল বেয়ে -  উপর থেকে নিচে নেমে আসা এক রক্ত প্রবাহ যেন থরে থরে স্থর বেয়ে যেন নিচে নেমে আসছিলো
------ আমার চোখের জলে  ভেষে যাচ্ছিলো।সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, লুন্ঠনে লাতিন আমেরিকার মানুষের অনভব এবং  অনুভূতিই যেন চোখের দু'কুল ভেঙ্গে নেমে আসছিলো
আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিলো
----- সেই স্তম্ভটি আসলে কালান্তরের ইতিহাসে,  লাতিন আমেরিকার মানুষের উপর ঔপনেবিশিক লুন্ঠনের প্রতিবিম্ব।

জ্ঞানতত্বের এ এক বিচিত্র রীতি।কোন বিদ্যাই কিংবা অভিজ্ঞতাই স্বতঃসিদ্ধভাবে  জ্ঞানে বদলে যায় না । তিলে তিলে যে সব বিদ্যা বা অভিজ্ঞতা ধারনার রুপে সঞ্চিত হতে থাকে, হটাৎ করেই একটা আলোর ঝিলিকে সে সব বিদ্যা ধারনার সাথে মিলে মিশে জ্ঞানে বদলে দেয়। সে সব জ্ঞনো যে পূর্ণজ্ঞান, সে রকমটি ঘটে না  । কখনো কখনো ইতিহাসে এমন সব ঘটনা ঘটে যায়, যা অতীতের সব ধারনা এবং বিদ্যাকে পুঞ্জিভূত চেহারা দিয়ে দেয়।  সে সব জ্ঞান বা বোধ যখন রাষ্ট্রীয় চেতনার সাথে যুক্ত হয়, তখনই জাতীয়তাবোধে নতুন নতুন উপাদানের সংযুক্তি ঘটে।
------এমনিতেই সোভিয়েত ভেংগে যাওয়ার পর জাতীয়তাকে একটা শক্ত শিলান্যাসে স্থাপন করেই যে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনকে বাচার রাস্তা খুজতে হবে এবং সব রকম সংকীর্নতা মুক্ত হয়ে সংগমে মিলতে প্রানপণ চেষ্টা যে একটা  করতে হবে সেটা বুঝে গিয়েছিলাম। নিজের জীবনের একটা বড় দুর্গঠনার মুখে এটাও বুঝেছিলাম, সোভিয়েতের ভাঙ্গন বিশ্ব মানবিকতার অভিমুখ গুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারনে
----- শ্রমিক শ্রেনীকে শুধু জাতীয়তার পুনঃর্গঠনেই আত্মনিয়োগ করতে হবে তাই নয়। এই পুনঃর্গঠনের মুল অভিমুখটাই সেখানে হতে হবে যেখানে  ইতিহাসের সব নেতিবাচক  উপাদানগুলিকে বর্জন করে জাতীয়তার অন্যান্য উপাদানকে মানবিক অভিমুখে, সে পথেই  রবীন্দ্রনাথের বিবিধের মাঝে মিলন সেতুকে পুনঃনির্মানে হাত দিতে হোত। 
সোভিয়েত ভেংগে যাওয়ার পর, শ্রমিক আন্দোলনকে যে সব রকম বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে বেড়িয়ে আসার চেতনাকে নিয়ে আসাটাই প্রধান দায় হলেও, পুরানো পথ থেকে বেড়িয়ে আসাটাই যে একটা বিপ্লব
-----  সে কথাটা হাড়ে হাড়ে বুঝলাম, যখন দুর্গপুর শিশু আকাদমি নির্মানে হাত দেওয়া হয়েছিল, ১৯৯৩ সালে।সে  কাহিনী পরের কোন দিন বোঝানো যাবে । প্রতিবিপ্লব যেন ভেতরেই যেন  কাজ করছিলো।তবে দুর্গাপুরের ইউনিয়ন গঠনের সময়কালের আধা-ফ্যাসিস্ত আক্রমনের মুখে, এই বহুমুখীন প্রকৃয়ায় যেতে হয়েছিলো বলেই,
---- সবাইকে নিয়ে সবাইকার জন্য ফোরামের একটা সংস্কৃতি ছিলো ।  সেটাকে বিস্তুৃত করেই একটা জাতীয়তার শ্রোত নির্মানের চেষ্টা হয়েছিল।

এই অভিজ্ঞতায় দাড়িয়েই কমরেড নিরুপম সেনকে  বলেছিলাম,
------ কোলকাতায় যদি কোন, উপমহাদেশীয় মিউজিয়ামের জন্য যদি
জমি না পাওয়া যায়, তবে আকাদমির ক্যাম্পাসে জমি দেওয়া যেতেই
পারে।
সে দিন এই দাবীটি যদি বলিষ্ঠতার সাথে  করা গিয়ে থাকে,তার পেছনেও সেই সপ্তসুরের সাধনয়াই শক্তি যুগিয়েছি। গান বাজনা না বোঝা মানুষ হয়েও অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম
----- হিন্দুস্থানী সংগীতের সাথে দক্ষীন ভারতীয় সংগিত, রবীন্দ্র সংগিত কিংবা সব রকম লঘু এবং গনসংগীতের মাতৃভূমী যদি সপ্তসুর বলে মানা হয়, তবে এই সুর যখন  গজল থেকে কাউয়ালি, পর্য্যন্ত সব সুরকে সংহত করেছে, তখন এই সুরেই ভারতীয় সব ভাষা- হিন্দী থেকে  উর্দু বা সংস্কৃতের সেতুবন্ধন করেছে।
উপমহাদেশকে বেধে রেখেছে, রবীন্দ্রনাথ এবং বিশ্ব সাহিত্যে মর্য্যাদা পাওয়া অনেক সাহিত্য।
----- আর বাকিটা তো মানবিকতা, যা সারা বিশ্বকে এক করেছে।বিশ্ব ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি এক থেকে অন্য অঞ্চলের জীবন প্রবাহকে এক সুত্রে বেধেছে।
---- সব কিছু যখন একতার এবং  মাস্নবিকতার সাধারন অভিমুখটাই একাত্মতার , সেখানে ছোটখাটো বিবিন্নতাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখানোর শয়তানীকে কেন দমন করা যাবে না ? (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours