কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

একরত্তি বজরংবলি।
ডানহাতে গদা, বাঁহাতে গন্ধমাদন নিয়ে উড়ে চলেছে পবননন্দন।
ছোট্ট এক নিষ্পাপ পুতুলের মতো। মাটির গায়ে ঝকঝকে সোনালি রং। ঘরের এক কোণে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছিলো আমার মেয়ে। ঠিক কতবছর আগের কথা, আজ আর তা মনে নেই। তবু সাত- আট বছর কী তারচেয়ে একটু বেশিও হতে পারে। আসলে সময়ের হিসেবটাই আমার ধাতে নেই।
বাবা ভগবান- টগবান মানে না। জানতো মেয়ে। বাবার মেয়েও বাবারই মতো। তবু কেন হঠাত মেয়ে বাবার ঘরে বজরংবলিকে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছিলো কে জানে।

তখন সদ্য একা হয়েছি। "তোমার মতো লোকের সঙ্গে থাকা যায় না।" একথা বলে উইদাউট নোটিশ বউ বিদায় নিয়েছে। এদিকে একা ঘরে থাকতে আমার কেমন গা ছমছম করে। খবর কাগজের অফিসে চাকরি। ডিউটি থেকে ফিরতে রাত দেড়টা- দুটো। মাঝরাতে ঘরে ঢোকা। তারপর ওই অস্বস্তিকর দমবন্ধ অবস্থা।

না। কোনও ভূত-টুতের ভয় না। নিজেকেই নিজের ভয়। একা থাকার ভয়। নিঃসঙ্গতার ভয়। এতদিন একটা মানুষ থাকতো। একরাশ বিরক্তিতে ভরা মুখ নিয়েও দরজাটা খুলে দিতো। সে চলে যাওয়ার পর, নিজেকেই নিজের দরজা খুলে দিতে হতো। ঠিক যেভাবে নিজের চলার পথ, একসময় নিজেকেই করে নিতে হয়।
মাঝরাতে অন্ধকার ঘরে ঢুকে লাইটের বোর্ডটা কোনদিনই ঠিকঠাক ভাবে খুঁজে পেতাম না। কিছুক্ষণ হাতড়ানোর পর এসুইচ ওসুইচ করে লাইটটা জ্বালাতাম। খানিকটা স্বস্তি। তখন বুঝতে পারতাম, এডিসন সাহেব কী উপকরটাই না করে গেছিলেন। বা তারও আগের সেই আদি মানবরা। আমার পূর্বপুরুষরা। যারা চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালিয়েছিলেন। মানবসভ্যতার সূচনা সেই আলোর ফুলকি দিয়েই।

আলো মানে জীবনের স্পন্দন। 'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত' কোনও আলোর সেদিন সন্ধান মেলেনি। দু চারবার লাফালাফি করে টিউব জ্বলে উঠলেই ঘরময় আলোর হাসির ছটা। আহ কী শান্তি। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরেই সেই হিমশীতল অনুভূতি একাকীত্বের। মনকে বোঝাতাম, মেধাবী মননশীল মানুষরা নিঃসঙ্গতার সঙ্গেই সহবাস করে। এমনিতেও তো একাই ছিলাম। দোকা ছিলামটা কবে? দুটো মানুষ একসঙ্গে থাকতাম। একই ছাদের তলায়। যে যার চার দেয়ালে বদ্ধ।

সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো।
সে বিদায় নেওয়ার পরে, আর কারোও বিরক্তিভরা মুখ দেখতে হয় না। পুরোপুরী স্বাধীন। এমনি আরও কত সহস্র যুক্তিতর্ক। তবু সেই ভয় কাটতো না। অজানা সেই আতঙ্কের হাত থেকে অনেক রাতে পালিয়েও বাঁচতাম। রাস্তার কালভার্টে গিয়ে বসে থাকতাম। পুলিস প্যাট্রোলের খপ্পরেও পড়েছি। উঠে যেতে বলতো। চোর ছিনতাইবাজের ভয়। কিন্তু ভয় তো ঘরেও। সেকথা কাউকে বোঝাতাম কী করে?
চার দেয়ালের থেকে খোলা আকাশের নীচে, সেই রাতগভীরে স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম।

জেগে থাকলে তবু একরকম। ঘরের সব লাইট জ্বলতো। কিন্তু শুতে গেলেই ভয়টা যেন সারা শরীরে চেপে বসতো। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও দু'চোখের পাতা এক করতে পারতাম না। তবে ভয়টা কাটতে শুরু করতো, ঘড়িতে চারটা বাজলেই।
নিজের অজান্তেই একসময় ঘুমে ঢলে পড়তাম। কিন্তু আটটা বাজতেই উঠে পড়া। তারপর ধীরে সুস্থে অফিসের জন্য তৈরি হওয়া। কিন্তু ওভাবে আর কতদিন টানা যায়? যথারীতি একদিন বিছানায় পড়লাম। ঠিক সেসময় মেয়ের কোলে চেপে, আমার ঘরে আগমণ বজরংবলির।

"দেখো এবার থেকে আর ভয় লাগবে না," বলেছিলো মেয়ে। "খুব ভালো ঠাকুর। তোমার খেয়াল রাখবে।" দুর্গা না, কালী না, এমনকি শিবও না। একেবারে বজরংবলি। প্রথমটায় সত্যিই একটু মেজাজ বিগড়ে গেছিল। ঠাকুরেরও জাতিভেদ আছে বৈকি।
বজরংবলি একেবারেই খাঁটি অবাঙালি ঠাকুর। তার দাপট বিহার আর যোগীরাজ উত্তরপ্রদেশে। আমাদের তো দুর্গা কালী শিব। বেশ কিছুদিন হলো গণেশবাবাজিরও বং সংস্করণ হয়ে গেছে। কিন্তু কপিরাজ বজরংবলিও যে কখন চুপিচুপি বঙ্গপ্রদেশে ঢুকে পড়েছেন, তা ঠিক টের পাইনি। কতো সুন্দর আমাদের সব দেবদেবীরা। আর এতো নিছক এক হনুমান। তবে শত দুঃখের মধ্যেও সান্ত্বনা একটাই, স্বামীজির লেখায় বীর হনুমানকে পেয়েছিলাম।
আমার ঘরে ঢুকে কোনও কমরেড ওই খুদে বজরংবলি দেখতে পেলেই অবধারিত ভ্রু কোঁচকাতেন। নাক সিঁটকোতেন। যেন ঘরটা দুর্গন্ধে ভরে গেছে। চাইকী আমার ঝকঝকে বেসিনে নাকের সিকনিও ঝেঁড়ে ফেলতে পারতেন। সন্দেহের চোখে তাকাতো পদ্মবিরোধী শিবির, আচ্ছা তলে তলে এতদূর! নিশ্চয়ই মোদি অমিত শাহ কলকাঠি নেড়েছে। আর তৃণমূলতো সেই কবে থেকেই বলে চলেছে, সিপিএমই বাংলায় বিজেপি'র ভোট বাড়াচ্ছে।

বজরংবলির দর্শন হতেই ইনস্ট্যান্ট এরকম অনেককিছু মাথায় ঘুরঘুর করতে লেগেছিলো। তবে মেয়েকে কিছু বলতে পারিনি। বেচারি, যত্ন করে আমার জন্য কপিরাজ বজরংবলিকে নিয়ে এসেছিল।
যাই হোক, সেদিন থেকেই আমার 'একাঘরে' ঠাই হলো আরেকজনার। ঘরের এককোণে, ছাদের কাছাকাছি দোল খেতে লাগলো সুতোয় বাঁধা বজরংবলি।
ব্যাস আমার মেয়ে নিশ্চিন্ত।

বিছানায় শুলেই চোখ পড়তো সোনার মতো চকচকে বজরংবলির দিকে। উপেক্ষা করার জো ছিলো না। এরপর কারণে অকারণে চোখ চলে যেত সেদিকে। অফিস বেরনোর সময় চোখ চলে যেত ওই একরত্তি বজরংবলির দিকে। হাতজোড়, নমস্কার- টমস্কারের বালাই ছিলো না। "বিপদে মোরে রক্ষা করো প্রভু," তাও বলতাম না। তবে মনে মনে বলতাম, "বাই বস। এবার বেরোই।" এমনি করেই দিনে- দিনে বেশ একটা দোস্তি ইয়ারির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।

সারাদিনে একটিবারও বজরংবলির কথা মনে পড়তো না। বরং কাজের ফাঁকে যখন সিগারেটে টান মারতাম, মনে পড়তো আমার সেই বউয়ের কথাই। ধোঁয়ার আড়ালে যেন তাকে খুঁজে পেতাম। "তোমার ওই সিগারেট খাওয়া দেখেই ফেঁসে গেছিলাম," বলতো সে। "কী কেত ছিলো মাইরি তোমার!"

মনখারাপটা ফিরে ফিরে আসতো। দিন কাটতো আগের মতোই। তবে মহাবলির আগমণে বদলে গেছিলো রাতের ব্যাপারটা। ঘরের তালা খুলে সুইচ খুঁজতে আর হাতড়াতে হতো না। দু একবারের চেষ্টাতেই পেয়ে যেতাম। লাইট জ্বেলে শোয়ার ঘরে ঢুকেই তাকাতাম ঝুলন্ত বজরংবলির দিকে।
"কী বস!" একটা খোঁচা লুকিয়ে থাকতো কথার আড়ালে। "কেমন লাগছে কলকাতার জলবাতাস?" নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতাম।

যাকে নিয়ে রসিকতা সে পাল্টা না দিলে রসিকতা মাঠে মারা যায়। হলোও তাই। দেখতে দেখতে খোঁচার ধার কমলো। তারপর ঘরে ফিরে মুচকি হেসে শুধুই বলা, "হায় বস।" মনেমনেই না। গলা নামিয়ে জানতে চাইতাম। "দাঁড়াও আসছি," বলে চলে যেতাম হাতমুখ ধুতে। ফ্রেশ হয়ে আরাম করে বিছানায় বসতাম। এরপর শুরু হতো কথোপকথন।

"সারাটা দিন তোমার একা কাটে বস। বাঁদরামির কোনও সুযোগ নেই।" মস্করা করতাম বানররাজের সঙ্গে। "বোঝ ঠেলা। তোমায সীতা মইয়া কেমন তোমার কোমড়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। আর বেশি ছটফট করলেই বিপদ। অত উঁচু থেকে পড়লেই হলো, তোমার সবকিছু ফেটে যাবে। তা তুমি যত বড়ো ভগবানই হও না কেন।" সেকথায় খোঁচার ঝাঁজ থাকতো না। বরং মনে হতো, দুই বন্ধুর নিজেদের মধ্যে পেছনে লাগালাগি চলছে। বজরংবলি তখন আমার কৃষ্ণসখা।

বেশ লাগতো। একটা সঙ্গী পেয়ে গেছিলাম। আমার নিঃসঙ্গতা উধাও। অফিস থেকে ফেরার সময় হলেই
মনে হতো, ঘরে আমার জন্য একজন অপেক্ষায় আছে। কাজটাজ সেরে অফিসে যখন রাতের খাবার নিয়ে বসতাম, খুব মনে পড়তো বজরংবলির কথা। সেও ঠায় উপোস করে আছে দিনের পর দিন। রাতের পর রাত।
কী খাওয়াবো ওকে? দুবেলা নিয়ম করে বাতাসা নকুলদানা খাওয়ানো। মনে মনে হাসতাম। বেটা হনুমান, সে আবার ওসব খায় নাকি। দুপুরে ক্যান্টিনে খাওয়ার সময় অবশ্য ওসব মনে পড়তো না। তখন একটা কথাই মনে হতো, কতক্ষণে খেয়ে কাজে বসবো।

রাতে বাড়ি ফিরে অনেকদিন হাঁ করে শুধুই তাকিয়ে থাকতাম সেই খুদে মূর্তির দিকে। ফাঁকা মাথা। শূন্য চোখ। বজরংবলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, কখন যেন গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়তো। বুঝতে পারতাম না, আমাদের দুই মনে তখন কী কানাকানি চলতো।

ধীরে ধীরে আমার ঘরে ঝোলানো কৃষ্ণসখার ওপর নির্ভরতা, চরচর করে আরও বেশ খানিকটা বেড়ে গেছিলো।
অফিসে তেমন কোনও ব্যাপার হলে, বাড়ি ফিরে বজরংবলিকে গল্প শোনাতাম। তার মধ্যে রসের গল্পও থাকতো। এমনকিছু কথা, যা মনের মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে বলতে নেই। একেবারেই ব্যক্তিগত। গোপন সেকথা। এতদিনের জমিয়ে রাখা আমার সব সুখদুঃখ, মান অভিমানের সাতকাহন।
অসীম ধৈর্য নিয়ে সব শুনতো চিরকুমার পবননন্দন। মুখে রা কাড়তো না। তার কাছে সবকিছু ঢেলে, নিজে বেশ হালকা হতাম।
এরপর একদিন দেখলাম, আমার কৃষ্ণসখার সামনে আমি করজোড়ে দাঁড়িয়ে। নিজেরই অজান্তে। কখন যেন দুহাত জড়ো হয়ে উঠে এসেছিল বুকের ওপর।
আসলে অফিসের কাজে মাঝেমধ্যেই শহরের বাইরে ছুটতাম। কখনও দু একদিন, আবার কখনও সপ্তাহখানেকের জন্য। সেই যাওয়ার আগেই কখন যেন হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, সেই একরত্তি বীর হনুমানের কাছে।

"সব দেখে রেখো ঠাকুর।" সেদিন আচমকাই কৃষ্ণসখা দেবতার রূপ নিয়েছিলেন। মানুষ যখন অসহায়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, তখনই সখা ভগবান হয়ে যায়। স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিরক্ষার দায়, মানুষ তুলে দেয় ঈশ্বরের ঘাড়ে। ঠিক যেমনভাবে সেদিন বজরংবলিকে আমার ঘরের পাহারাদার করে বেরিয়ে পড়তাম।

ভাড়াবাড়ি ছেড়ে আজ আমি নিজের ফ্ল্যাটে। বাসা বদলানোর সময় অনেককিছুই খোয়া গেছে। কিন্তু আমার বজরংবলি আছে আমার কাছেই। নাকি বজরংবলির কাছেই আমি আছি কে জানে!

একদিন আমার মেয়ের হাত ধরে আমার অনীহাতেই আমার ভাড়াবাড়িতে ঢুকে পড়েছিল বীর হনুমান। তারপর ফের তার নতুন ঠিকানায় যাত্রা। এবার আমার হাত ধরে। ঠাকুর তো না। যেন এক ভরসার ব্যাটন। একদিন যা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলো আমার মেয়ে। সেদিন সবার অলক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল এক পরম্পরা। এই নিঃশর্ত ভরসার পরম্পরা থেকেই সম্ভবত জন্ম বিধাতার।

বজরংবলির দেবত্বের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে আমার আত্মজার অস্তিত্ব। সেদিনের কিশোরীর পিতৃস্নেহ। আমার মেয়ের কথা, "খুব ভালো ঠাকুর। দেখো, তোমার খেয়াল রাখবে।" তা সত্যিই সেকথা রেখেছিলো বজরংবলি। ভালো রেখেছে আমায়। আজও। আমার ভরসার জায়গা। লোকাল গার্ডিয়ান।
আমার সেই ছোট্ট সোনালি বজরংবলি আমার কাছে আজ খোদ ঈশ্বরেরও বাড়া।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours