কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতাঃ

"বাংলায় জন্মকম্ম। এখানেই বাস। তাই বাংলাতে সড়গড় নাহলে চলে?"
পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সেই তন্বী।

বয়স, এক কুড়ি দুই বছর। বেশ চোখে পড়ার মতো দেখতে- শুনতে। আরও পাঁচ আধুনিকার মতোই ঝকঝকে, স্মার্ট। নাম জেবা।
জেবা আহমেদ। বাংলা শেখা শুরু করলো একুশেই। তাও একেবারে গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির কমার্সে মাস্টার ডিগ্রি। পড়াশোনার শুরু আসানসোলে, ইংরেজিতেই। বাড়ি, মহল্লায় উর্দু হিন্দি। তাই বাংলা বলার অভ্যাসটা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না।

এরকম এক শহরের মেয়ে জেবা, যেখানে বাংলা শেখা একেবারেই জরুরি না। হিন্দি জানলেই চলে যায়। সেদিক থেকে আসানসোল নির্ভেজাল কসমোপলিটান। কিন্তু মেধা বুদ্ধি একটু পরিণত হতেই ঘা লাগলো জেবার আবেগে। যে মাটিতে জন্ম, শৈশব থেকে যৌবন, যেখানকার আকাশ বাতাস তার নিজের, সেখানকার মাটির ভাষাটা শিখতেই হবে। এক জেদ ভর করলো তার ওপরে।

বাবা মহম্মদ অইয়াস আহমেদ, আসানসোলের এক নামজাদা বস্ত্র ব্যবসায়ী। মেয়ের মনের কথা জানতে পেরেই সন্ধান শুরু করলেন এক গুরুর। এমন একজন, যে তাঁর আদরের মেয়ে জেবাকে বাংলায় অনর্গল করে তুলবেন।

যতোই ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ভাষা দিবস পালন করুন, যতোই "আমি বাংলায় গান গাই" ধরুন, গোটা রাজ্যে স্পোকেন বাংলা'র দেখা পাওয়া মুশকিল। তবে হাত বাড়ালেই স্পোকেন ইংলিশ। আসানসোলে তো আবার প্রাচীন রেলস্কুল থেকে বাংলাকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। ঠিক এরকম এক সময়, সেই আসানসোলেই বাংলা শিখতে বসলো জেবা। তাও একুশের ভাষা দিবসে।

"স্কুলে বাংলা বলার সুযোগ ছিল না," বলে জেবা। "মহল্লাতেও সবাই হিন্দি উর্দু বলতো। তাই বাংলা বলার কোনও সুযোগই ছিলো না।"
তাহলে হঠাত বাংলা শেখার এই ঝোঁক কেন?
"বাংলার মেয়ে। বাংলা পড়তেও পারি। তবে লিখতে জানি না।" খানিক লাজুক মুখে বলে জেবা, "বাঙালির মতো বাংলা বলাটা শিখতেই হবে।" পড়াশোনা, চাকরি করতে গিয়ে, কিছুদিন কলকাতাতেও কাটিয়েছে সে। হোক না বণিকবাড়ির মেয়ে, তবু জেবা চায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে। অল ইন্ডিয়া সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার জন্য চলছে প্রস্তুতিপর্ব। তবে মেয়ের সাধ, বাংলায় থেকে বাংলাতেই চাকরি- বাকরি করা।
সিনেমা দেখার অভ্যাস থাকলেও, বাইশ বছরের জীবনে জেবার দেখা একমাত্র বাংলা সিনেমা "বোঝে না সে বোঝে না"। সিনেমা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। এর বাইরে সে নাম শুনেছে উত্তমকুমারের। সুপারস্টার। বাংলা গান-টান প্যান্ডেলে, রাস্তাঘাটে কানে এলেও, ঘরে বসে তেমন ভাবে জমিয়ে শোনা হয়নি।
এরপরেই যে প্রশ্নটা অবধারিত ভাবে আসে, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কোনও ধারনা আছে জেবার? আছে বৈকি। "স্কুলে কাবুলিওয়ালা নাটক হয়েছিল। বেশ লেগেছিল," বলে জেবা। এরপর গড়পরতা এক অবাঙালি মেয়ের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যতটা কেতাবি জ্ঞানগম্যি থাকা দরকার, তা আছে।

বাংলা না জানলেও বাঙালি লেখক দুর্জয় দত্তর লেখা ভালবাসে জেবা। কিন্তু ওই প্রবাসী লেখক আবার বাংলা লিখতে পড়তে জানেন না। কিন্তু তাঁর পাঠিকা অবাঙালি জেবা চায়, যে ভাবেই হোক বাংলাটা শিখে ফেলতে।
কেন?
"সবাই যখন বাংলায় কথা বলে শুনি। খুব ইচ্ছা করে ওদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়তে। নিজের মত জানাতে। কিন্তু পারি না," হতাশ সুরে বলে জেবা। কলেজের বন্ধুবান্ধবরাও ওর ভুলভাল বাংলা শুনে হাসিঠাট্টা করতো। বলতো, হিন্দিতেই কথা বলতে।
মুখে কিছু না বললেও মনটা দমে যেত জেবার। ঘা খেতো আবেগ। বাংলার মেয়ে। কিন্তু কোথায় যেন তৈরি হতো বাংলা, বাঙালির সঙ্গে এক যোজন দূরত্ব। মন থেকে কোনদিন তা মেনে নিতে পারেনি আসানসোলের জেবা।

জেবার বাংলা শেখা শুরু হচ্ছে বাংলা সিনেমা দেখে আর কবিতা পড়ে। গুরু কেয়া ঘোষ বলেছেন, তাতে ডায়লগ বলার ভঙ্গিমা শেখার পাশাপাশি উচ্চারণটাও শিখে ফেলা সহজ হবে। একুশের সন্ধ্যা থেকে শুরু হলো জেবার বাংলা শেখার প্রথম পাঠ। এবার তার মিতালি আরও গাঢ় হবে বাংলার মাটি, বাংলার জলের সঙ্গে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours