রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

সময় তখন একটার কাঁটা ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছে তরতর করে, মেঘলা আকাশে কেমন যেন গুমোট ভাব। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ আনমনা করে দেয় অজান্তেই, মনখারাপির মাস্তুলে বেবাক স্মৃতির আনাগোনা।
কর্পোরেট হাসপাতালের সবটুকুই যেন বড় হিসেবী, কৃত্রিম। প্রতিমুহূর্তে জীবন মরণের খেলা চলে যান্ত্রিকতায়, নিরুত্তাপ মুখোশী আবহাওয়া যেন সেঁটে থাকে ছদ্ম হাসির অন্তরালে। কোনোকিছুতেই কেমন যেন নির্লিপ্ত নিষ্পৃহতা, জীবন- মৃত্যু আপেক্ষিকতার অবলোকন মাত্র।
স্ট্রেচারে শোয়ানো একটি শরীর এইমাত্র প্রবেশ করল কাঁচের দরজা ঠেলে, সম্পূর্ণ শীততাপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশেও এক ঝকঝকে বছর পঁয়তাল্লিশের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম; চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্ত। সঙ্গে আসা সফিস্টিকেটেড মহিলা আচমকাই করিডোর দিয়ে গমনোদ্যত সফেদ কোটের হাতদুটো জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন হাউমাউ করে, নোনাজলে আলতো ধুয়ে যাচ্ছে দামী কাজল - মাস্কারা - ফাউন্ডেশন।
স্ট্রেচারে শুয়ে উনিশ - কুড়ির পাংশুটে মুখ, চোখের তলার গাঢ় কৃষ্ণগহ্বর অজান্তেই বলে যায় ভাঙচুরের গোপন গল্প, ঠোঁটের কষ বেয়ে চুঁইয়ে পড়া লালচে রেখায় আঁকা অভিশাপের গোপন দীর্ঘশ্বাস। জটপড়া এলোমেলো একমাথা কালো চুলে আগাম ঝড়ের সংকেত, নীলচে শার্টটা যেন একটু পরেই ধ্বংসপতাকা হয়ে পতপত উড়বে আসমানী সীমানায়।
যান্ত্রিক শব্দে আশ্বস্ত করলেন সফেদ কোট, স্ট্রেচার ঢুকে গেল লালবাতির অপারেশন থিয়েটারে।  সেখানে এখন শুরু হবে যম আর মানুষের টানাটান লড়াই, সাকশন ব্যবহার করে পেট থেকে খামচে তুলে আনা হবে কোনো কষাটে তরল, এদিকে শিরা বেয়ে বিন্দু বিন্দু অন্দরে পৌঁছবে সঞ্জীবনী। উদভ্রান্ত দম্পতি বসলেন আমার পাশটিতেই, দুজনের চোখেই জল, সন্তান যে বড় বিষম বস্তু!! প্রভাবশালী আত্মীয় মুঠোফোনে পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছেন কেস সাজানোর, যতটুকু বুঝলাম অতিপুরাতন হেরে যাওয়ার গল্প। এদিকে খবর এল অন্দর থেকে, যুদ্ধ শেষ ' শরীর এবার চালান যাবে লাশকাটা ঘরের হিমানী নীরবতায়।
শুনতে পেলাম বছর পঁয়তাল্লিশ এর সক্রন্দন স্বগতোক্তি,  শিশু থেকে শুধু আর্থিক স্বচ্ছলতা আর সামাজিক স্ট্যাটাস এর পেছনে অন্ধভাবে না ছুটলে হয়ত আভাস পাওয়া যেত ভাঙচুরের, হয়ত বাঁচানো যেত একমাত্র সন্তানের প্রাণ। মা তখন ব্যস্ত কোনো অজ্ঞাতকুলশীলার মুন্ডপাতে, তার প্রত্যাখ্যানেই আজ জীবনের তীরপ্রান্তে মৃত্যুর বিউগল।
মনটা খারাপ হয়ে গেল, উঠে এসে দাঁড়ালাম পার্কিং এর শেষ মাথায়, মনে একটাই প্রশ্ন, আটকানো কি যেত না এই পরিস্থিতি?
আপনাদের এই গল্পটা কেন শোনালাম জানেন? নজরটা একটু নিজের চারপাশে বোলাবেন, ক্ষতবিক্ষত মানুষের সংখ্যা আজ কিন্তু কম নয় সমাজে। আত্মহনন পাপ, সৃষ্টির নিয়মকে অগ্রাহ্য করে নিজের শেষের কবিতা লেখা ; এটাকে সমর্থন করিনা একদমই। তবে আত্মহননকারী কাপুরুষ,  মানতে পারিনা এই যুক্তিটাও। মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকেই, তাই যখন শেষের গল্প লেখা হয় আপন হাতে; নেপথ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক না বলা গল্প।
এবার প্রশ্ন হল, আমরা কি এটা আটকাতে পারি না? পারি না একটা বিদ্বস্ত জীবনকে আবার সাজাতে? পারি। একটু লক্ষ করলে দেখবেন আত্মহননকারী ঘটনা ঘটাবার আগে কিছু না কিছু সংকেত রেখে যায়, যেমন আচমকা মৌনতা অথবা হতাশামূলক " আমি আর বাঁচতে চাইনা " ধরনের বাচনভঙ্গি।  আবার এমনও দেখা যায় অতিশান্ত কম কথার মানুষটি পূর্ণচ্ছেদ টানার আগে হয়ে ওঠে প্রগলভ, বেপরোয়া।
তাই লক্ষ রাখুন, নিজের আশেপাশের মানুষগুলির হটাৎ বদলে যাওয়ার নেপথ্যের কারণগুলি সন্ধান করুন। জীবন ব্যস্ত, অনবরত ছুটছে ঠিকই, তাও দিনে অন্তত একবার কাছের মানুষটির খবর নিন। দুচারটে কথা, হালকা হাসি, কিছু প্রশ্ন অনায়াসেই দিয়ে দেবে মনের অন্দরের হদিস। শুধু অনুভূতিটাকে জাগিয়ে রাখুন, পরে হাহুতাশ করার চেয়ে এটাই কার্যকরী। যেকোনো সমস্যা, তা সে যত বড়ই হোক, অন্তত একজনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন, পৃথিবীতে কোনো সমস্যাই অসমাধানযোগ্য নয়। বিচ্ছেদ আসে, বিশ্বাসভঙ্গ ও হয়, তবে ইতি টানাটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়। তারচেয়ে নিজেকে গড়ে তোলায় মন দিন, সবাই সবার জন্য পারফেক্ট হয়না। জীবনের রাস্তায় প্রতিটা হার্ডলস আমাদের নতুন শিক্ষা দেয়, নির্ভরশীল হোন তবে এমন মানুষের ওপর যে আপনার প্রকৃত মর্যাদা দেয়। দিনে অন্তত কিছুটা সময় নিজের সঙ্গে কাটান, নিজের ভালোলাগার সঙ্গে কাটান ; বাঁচার রসদ পাবেন। ব্যস্ততা, আবেগ এগুলো যেন আপনার বাস্তববোধ ছিনিয়ে না নিতে পারে, অপাত্রে অনুভূতিদান বন্ধ করুন। মর্যাদা না পেলে সরে আসুন, কিন্তু কখনো আত্মসম্মান বিকিয়ে দেবেন না। ভালোবাসায় আত্মসমর্পণ ভালো, তবে সেটা যেন এমন মানুষের কাছে হয় যার কাছে আপনার অমর্যাদার ভয় নেই। সমস্যা খুলে আলোচনা করুন, পরিবারকে সময় দিন, ডিপ্রেশনে থাকা মানুষকে নিয়ে খিল্লি নয় বরং সহমর্মিতায় পাশে দাঁড়ান। ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours