চৈতালী সেনগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতা:

      বর্তমানে আমার অনেক কাজগুলির মধ্যে একটি বিশেষ কাজ হল, বাচ্চাদের ঘুমের সময় গল্প শোনানো। তবে যে সে গল্প নয়, সে আবার হতে হবে ভূতের গল্প। বাচ্চাদের মন পাবার আর যে কোন উপায়ে শান্ত করিয়ে দেবার এ হল এক মোক্ষম অস্ত্র। তাই ভূতকেই পাতালাম সই। ওদিকে ভগবানের তো অভিমানের সীমা নেই। আমাকে এক্কেরে সব ভুলেই গেল বেমালুম? সত্যিই তো তাঁর রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।এমনটা হলে তো .... তাঁর দৈব ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রেস্টিজ আছে না? দিব‍্যি সকলে ভগবানকে ছেড়ে ভূঊত ভূঊত করে হাঁপিয়ে মরছে। তা যাই বল বাপু, ভূতের এখানে কোওন দোষ নেই। খামোখা রাগের পাত্র হচ্ছে। মানুষেরই বা কতটা দোষ? সত্যি কথা বলতে কি, সব ঘটনার পেছনে একটা কারণ থাকে। এই যে, ভগবান আছেন, তার প্রমাণ দিতে পেরেছেন কোনদিন? এই যে প্ল‍্যানচেট করে ভূত ডাকাডাকি হয়, অনেকে তো দাবি করলেও থাকেন ভূতের  দেখা তাঁরা নাকি পেয়েছে, তার এইভাবে একদিন ফলমূল সাজিয়ে,ফুল চন্দন গুছিয়ে, দূর্বা তুলে, আমপাতা ঘটে দিয়ে,গঙ্গাজল ছিটিয়ে, ধূপ জ্বেলে,শঙ্খ উলুধ্বনি দিয়ে ভগবানকে একমনে ডাক তো দেখি। আসবেন? আসলেও তৎক্ষণাৎ নয়,পরে আসবেন। তোমার কথা জানি না.....এই যে আমি ছোট বেলা থেকে প্রতি পরীক্ষার আগে কত্ত ডেকেছি মা সরস্বতীকে, "হে মা!! এবার অঙ্কের প্রশ্ন গুলো যেন একটু সহজ হয়, এবার যেন পরীক্ষার আগে পেট মুড়িয়ে বমি না হয়,".....হয়েছে একবারও? অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় কতবার তো ভেবেছি....ওই ওখানে নির্ঘাত কেউ কালো শাড়ি পড়ে, চুল ছাড়া দিয়ে দাঁত বের করে খ‍্যাক্ খ‍্যাকিয়ে হাসছে, একবারও কি মনে হয়েছে ভগবান এসে হাত ধরে বলবেন, "আমি তো আছি ভয় কী?"  ফি বছর যে  লক্ষী গণেশের পূজো হচ্ছে, আর ফি বছর বাজারের সমস্ত জিনিসের দাম চড়ে চড়ে আগুন, দরিদ্র তো কোন ছার, সাধারণ মধ্যবিত্তদেরই তো নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে। মন্দির মসজিদের বাইরে অভুক্ত ভিক্ষুকের সারি, রোজ একমুঠো অন্নের অপেক্ষায় পথচলতি অগণিত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যদি আজ ভগবান/ আল্লাহ আসেন কোন মানুষের বেশে , আজ তার পেটের জ্বালা মিটবে। কোন দিন ভগবান এলেন, তো কোন দিন এলেন না। যেদিন এলেন না সেদিন কোথায় সে ভগবান? গায়ে জামা নেই, মাথায় ছাদ নেই, পেটে খাওয়ায় নেই, শিক্ষার বালাই নেই, ঝড় ঝঞ্ঝা মাথায় করে, এক পেট খিদে নিয়ে কত মানুষ বসে থাকেন রোজ..... ভগবানের অপেক্ষায়। আর যাদের মাথায় ছাদ আছে তারা? সবাই কি খুব ভালো আছে? পকেটে গুটি কয়েক নোট নিয়ে বাজারে গিয়ে চিন্তায় পড়ে যান কি আনবেন আর কি বাদ দেবেন। ভগবানের জন্য অন্তত নকুল দানা তো আনতে হবে। তারপর ছেলেমেয়ের পড়া, খাওয়া,জামা। সেদিন FM রেডিওতে একটা মজার কথা শুনলাম। আগে মানুষ পকেটে টাকা নিয়ে একথলে বাজার আনতো আর আজ, থলে ভর্তি টাকা নিয়ে এক পকেট বাজার করে আনে।শুধু কি টাকা? বাড়ছে শোষণ, বাড়ছে নারী নির্যাতন, বাড়ছে অনাচার, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ। ভগবান যে কোথায় ঘুমিয়ে আছেন কে জানে? মানুষ ভগবানকে তুষ্ট করতে টাকা, সোনা ভেট দিয়ে কত লোভী বাবাজি আর মৌলবী তৈরি করছে। ভারতবর্ষে বহু বহু প্রাচীন মন্দির আর মসজিদ আছে যাদের কোন একটারও গচ্ছিত সম্পদের হিসাব নিলে দেখা যাবে পুরো একটা বড় দেশকে এক ঘাটে কিনে অন‍্য ঘাটে বিক্রি করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে এদের।
      দেখুন ভাই, আমায় আবার গাল মন্দ করবেন না যেন। স্বয়ং লেখক উপেন্দ্রকিশোর তাঁর সৃষ্টির মধ্যে ভূতেদের সুখ‍্যাতি করে গেছেন। গুপি গাইন বাঘা বাইন, তারপর জোলা আর ভূত, কুঁজো আর ভূত, লালবিহারী দে-র ভীতু ভূত,এইসব গল্প লিখে ভূতেদের উপর আস্থা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। সত‍্যজিৎ রায় তার পরিচালনায় যে অপূর্বভাবে  গুপি গাইন বাঘা বাইনকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন আমরা সিনেমার পর্দায় তার ভাগ‍্য দেখে ইর্ষান্বিত হইনা কি? আপনার কি মত? ভগবানকে কি তারা কম ডেকেছিল? শেষে হাজারো ভূতের রাজা এলো তার তিন বর আর জুতো নিয়ে। ব‍্যাস!!!কেল্লা ফতে। সেই ভূতের রাজা , সেই জঙ্গল কটা মানুষ তাদের নিজেদের জীবনে একটিবার পেতে চায় না? এই যে কুঁজো মানুষটি তার এতো শারীরিক কষ্ট নিয়ে ভূতের দেখা পেল, আর এক নিমেষে তার সব কষ্ট দূর করে তাকে চিরসুখী করল এই ভূতের দলই তো? শুধু একটু কর্কশ গলায়..."লুন হ‍্যায়, তেল হ‍্যায় " গানে সঙ্গত দিতে হয়েছিলো এই যা। আজও বাড়িতে পিঠে হলে আমার ইচ্ছে করে,সাতটা পিঠে নিয়ে এক ছুটে চলে যাই কোন নিম গাছের তলায় আর গান ধরি....
      একটা খাবো, দুটো খাবো
 সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাবো।
একবার যদি তেনাদের দেখা পাই।
কিন্তু এতো কিছুর পর আজও মানুষ ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে। ঈশ্বর আসলে আছেন সবার মধ্যে। ঈশ্বর আছেন বিশ্বাসে, শক্তিতে, বুদ্ধি-বিবেচনায়,চেতনায়, প্রেমে,সেবায়, আত্মসম্মানবোধের মধ্যে। মানুষ আসলে নিজেই নিজেকে ঠকিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ঈশ্বর সাধনার জন্য ফুল, ফল নকুল দানা না হলেও চলে। কি নেই তাই নিয়ে চিন্তা না করে কি আছে সেটাকে আঁকড়ে যখন মানুষ ভাল থাকতে চায়, তখন মানুষের অর্ধেক কষ্ট কমে যায়। মানুষ মনে করে ভগবান পবিত্র, উদার,সুন্দর, ন‍্যয়পরায়ণ। তাই আজও তার শত কষ্টে মানুষ ভগবানকে স্মরণ করে। ঠিক তখনই ভগবান জিতে যান।
   এতো বুঝি ভাবি কিন্তু ওই, কচিকাঁচাদের ঘুম পারানোর বেলায় ভগবান লবডঙ্কা। তখন কিন্তু ভূতই কাজে আসে। ভূতের স্মরণাপন্ন হয়ে যদি একটি বার ঘুম পারানো যায়, কত কাজই যে একসাথে সেরে ফেলি আর মনে মনে ভাবি........ ভূত আমার সই রে!!!

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours