কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতাঃ

একটি মৃত্যু। এক কোটি টাকা।
গণতন্ত্রের ডাকা মৃত্যুর অকশন।
দাঙ্গায় মৃত্যু। বিষমদে মৃত্যু। দুর্ঘটনায় মৃত্যু।
মৃত্যুর নিলামে দর হাকাচ্ছে রাষ্ট্র। শাসক দল।
এককোটি এক। দর হাঁকালেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। দিল্লি দাঙ্গার বলি পুলিসের হেড কনস্টেবল রতন লাল। এককোটি সঙ্গে দিল্লি পুলিসের খুন হয়ে যাওয়া কনস্টেবলের পরিবারের একজনের চাকরি।
সবমৃত্যুর দাম সমান না। প্রেক্ষিত, মৃত্যুর কারণ, মৃতের অবস্থান, সরকারি বেসরকারি চাকরিজীবী, এরকম অনেককিছু দেখে মূল্যসূচক ঠিক করেন শাসক।

ভেজাল মদ গিলে গা উজার। সেখানে মৃত্যু সস্তা। গড়পিছু ওই পাঁচ দশ লাখের মধ্যে। এখন সবচেয়ে মহার্ঘ্য সন্ত্রাসবাদীর গুলিতে ঝাঁজরা, রক্তের ডেলা হয়ে যাওয়া শরীর। সরকারি বেসরকারি শরীর যাই হোক না কেন। সরকার বুঝে ফেলেছে, টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। তাতেও যদি চেল্লামেল্লি হয়, তাহলে ফাউ সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি। এভাবেই কিনে ফেলা যায় সম্পর্কের আবেগ, যন্ত্রণা, নীতি নৈতিকতা সবকিছু। এমনকি ইজ্জতও। তাই ধর্ষণকাণ্ডের পরেও সরকার বাহাদুর টাকা তুলে দেন ধর্ষিতা বা তাঁর পরিবারের হাতে। আজ সবই বিক্রি হয়।

এবারের দিল্লি দাঙ্গায় ঠিক কজন মারা গেলেন?
এ মুহূর্তে বা আগামী কোনদিনেও হয়ত সেই সঠিক সংখ্যাটা জানা যাবে না। কিন্তু এই মৃতের পরিবারদের হাতেও প্রথামাফিক ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে দেবে সরকার। যে সরকারের নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে দাঙ্গা, আর সেই দাঙ্গাই ছিনিয়ে নিলো প্রাণ, সেই সরকারের হাত থেকেই মৃত্যুবাবদ ক্ষতিপূরণের টাকা পকেটে গোঁজা। ওদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র, বলা ভাল শাসক গোষ্ঠী জেনেই গিয়েছেন, তাঁদের বিরোধিতা করলে যে কোনও নাগরিককে মেরে ফেলা যেতেই পারে। তারপর সেই মৃত্যুর দাম ধরে দিলেই হলো। লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। জনগণের করের টাকা। খরচ হওয়ার কথা দেশের উন্নয়নে। আর হচ্ছে আরেক করদাতার মৃত্যুর দাম চোকাতে। শাসকের অক্ষমতার খেসারত দিতে।
খুন করা। খুন হওয়া থেকে বাঁচানোর অক্ষমতা। তারপর খুনের দাম দেওয়া, খুনের দাম নেওয়া- গোটা ব্যাপারটাই কেমন নির্লজ্জ দ্বিচারিতা না?

মৃত্যুর দাম নির্ধারণ করা গেছে বলেই জীবন এখন মূল্যহীন, সস্তা।
মৃত্যুর কারণ নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। দাঙ্গা হলেও না। তবু গণতন্ত্র বলে কথা। প্রথামাফিক কিছু কাজ করতেই হয়। তদন্ত। ওদিকে তদন্ত শুরুর আগেই শাসক, বিরোধীরা একদম গবেষক গোয়েন্দাদের মতো ঘটনার কারণ ব্যখ্যা করে দেন। সবশেষে কিছু গোলগোল কথা। "স্থানীয় মানুষরা কেউ দাঙ্গা চায়নি। বহিরাগতদের উসকানিতেই দাঙ্গা বাঁধে।"
তারপরেই কিছু গপ্প জাতি সৌহার্দের। আর এ জায়গাটাতেই ফাঁক গলে ঢুকে পড়েন বুদ্ধিজীবী, মানবদরদী স্বঘোষিত সেকুলাররা। চুটিয়ে খেলেন তাঁরা। আচ্ছা বলুন তো, আপনি যদি আপনার ঘরের চারদিকে পাহারা বসান, তাহলে বহিরাগতরা ঢোকে কি মাটি ফুঁড়ে?

এলাকার মানুষ যদি দাঙ্গা না বাঁধায়, তাহলে গুলি খেয়ে কাঁরা রাস্তার রক্তমাখা ধুলোয় গড়াগড়ি খেলেন? তাঁরা কি সবাই বহিরাগত? আর তাই যদি হয়, তাহলে ওই বহিরাগত দাঙ্গাবাজদের মৃত্যুর দাম দেওয়া কেন? আফজল গুরু, আজমল কসাবদের কি মৃত্যুর দাম দেওয়া হয়েছিল?
মোটকথা যত দোষ ওই বহিরাগত নন্দ ঘোষদের। আর স্থানীয়রা সব গোপাল অতি সুবোধ বালক। তা আপনারা দেশের রাজনৈতিক কেষ্টবিষ্টুরা কি করলেন মশাই? আপনারা বিধায়ক, সাংসদরা উসকানি দিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামাটা থামাতে পারলেন না? তাহলে তো বলতে হয়, আপনারা শুধুই মুখে মারিতং জগত। আপনাদের থেকে এলেকায় অনেকবেশি প্রভাব ওই বহিরাগতদের।
তবে এবারের দিল্লি দাঙ্গার মূলে সত্যিই এক বহিরাগতর আগমন। তাঁকে দেখেই নিপুন হাতে ছক কষা। উদ্দেশ্য একটাই, ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবিটা আন্তর্জাতিক স্তরে নষ্ট করা। এই বহুচর্চিত বহিরাগতর নাম নিঃসন্দেহে ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ভারত সফরটাই যেন,  যজ্ঞে ঘৃতাহুতির কাজটা করলো। একেবারে নিখুঁত এক চক্রান্ত। আর অমনি খোরাক পেয়ে গেল পদ্মবিরোধী শিবির।

কেজরিওয়াল সাহেব আঙুল তুললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর দিকে। সোনিয়া প্রিয়াঙ্কা আঙুল তুললেন নরেন্দ্র মোদির দিকে। তাঁদের একবারও মনে পড়লো না, কংগ্রেসের সেই কলঙ্কিত অধ্যায়। ইন্দিরা গাঁধি হত্যার খেসারত দিতে সেরেফ খুন করা হয়েছিল কমপক্ষে সতেরো হাজার শিখকে। 1984 এর সেই দাঙ্গা তৈরি করেছিল, নৃশংসতার নয়া নজির। শুধু দিল্লিতেই প্রাণ গেছিলো তিনহাজারেরও বেশি শিখের। সেদিন দিল্লির রাজপথে দাঙ্গাবাজদের সেনাপতির ভূমিকায় দেখা গেছিলো খোদ কংগ্রেস নেতাদের।
রইলো বাকী অরাজনৈতিক সেকুলার সমাজ। দিল্লির দাঙ্গায় তাঁরা তোপ দাগলেন আরএসএসের দিকে।

ঘটনার দায় কেউ নেবে না। তবে ঘটনার ফায়দা তুলতে সবাই ঝাঁপাবেন।
দাঙ্গার বেনিফিসিয়ারি কে? দাঙ্গায় লাভ কার? প্রয়াত জ্যোতি বসু বলেছিলেন, সরকার না চাইলে দাঙ্গা বাঁধে না। একেবারে ঠিক কথা। হাতেকলমে তা করেও দেখিয়েছিলেন বসুর উত্তরসূরী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। হায়দরাবাদে মুসলিম মৌলবাদীদের মারাত্মক হামলার মুখে পড়েছিলেন তসলিমা নসরিন। কলকাতায় এসে তিনি বাঁচতে চাইলেন। বাংলায় তখন বুদ্ধজমানা। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজেও শুধু শাসক নন। এক বিদগ্ধ সংস্কৃতিবান মানুষের পরিচিতিও ছিলো তাঁর। কিন্তু সংস্কৃতির পীঠস্থান, সেকুলার বাংলাতেও তসলিমার স্বপ্নভঙ্গ হলো। এখানে তাঁকে থাকতে হলো ঘরবন্দি হয়ে। কিন্তু তাতেও আপত্তি বাংলার মৌলবাদীদের। অগত্যা বাংলাতেও ঠাঁই হলো না বাংলাদেশি লেখিকার। দিনটা ছিল 2007 সালের 22 নভেম্বর। খেদানো হলো তাঁকে। এবার তসলিমার ঠিকানা হলো দিল্লি। প্রয়াত বসুর কথামতো সরকার না চাওয়াতে এড়ানো গেল দাঙ্গা। কিন্তু কিসের বিনিময়ে?
দিল্লিতে তখন মনমোহন সিংয়ের সরকার। সেখানেও ঘরবন্দি থাকতে হলো তসলিমাকে। মৌলবাদী শক্তির মুখোমুখী দাঁড়ানোর নৈতিক ক্ষমতা সেদিন কেউ দেখাননি। মাস তিনেক কোনক্রমে দিল্লিতে কাটিয়ে 2008 সালে ফের বিদেশে উড়ে যান নাসরিন। সেকুলার ভারতের বাস্তব ছবিটা সেদিন স্পষ্ট হয়ে গেছিল,  'ন্যাশনাল সেকুলার সোসাইটি'র অনারারি অ্যাসোসিয়েট তসলিমা নাসরিনের কাছে। পরে এক সাক্ষাৎকারে, তিনি ওই ঘটনার জন্য দায়ী করেছিলেন ভারতের ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিকে।

তবে সরকার বাহাদুরের সদিচ্ছা থাকলে যে দাঙ্গা বাঁধে না, তা মানতেই হবে। সরকারের হাতে যে
মেশিনারি আছে, তাতে দাঙ্গার সম্ভাবনার আগাম খবর থাকাই স্বাভাবিক। সেই বুঝে কড়া পদক্ষেপ নিলে ঘটনার জল গড়ায় না। আর যদি দাঙ্গা বেঁধেও যায়, তার রাশ টেনে ধরার মতো যথেষ্ট ক্ষমতাও আছে সরকারের। কিন্তু এর কোনটাই না হলে, শাসকের দিকে সন্দেহের আঙুল উঠবেই।

তবে দাঙ্গার দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন না বিরোধীরাও। তারা দিনের পর দিন নাগরিক বিল, সিএএ আটকাতে সরকারবিরোধী কথা বলে মানুষকে তাঁতিয়েছে। কোনও মাত্রাজ্ঞানের ধার ধারেনি তারা। যার মূল্য চোকাতে বারেবারে প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours