প্রশান্ত ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতাঃ

বিশ্বে আর কোনও রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি মাতৃভাষার গর্ভে। সেইদিক থেকে বাংলাদেশি মাত্রই মনুষ্যজীবন মাতৃগর্ভ থেকে আর রাষ্ট্রীক জন্ম হচ্ছে মাতৃভাষা থেকে। আমাদের গৌরব এই যে সেই বাংলাভাষা আমাদেরও মাতৃভাষা।
তারই সংগ্রামী শিখায় পরবর্তীকালে ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রস্তাব পাশ হয়, এবার  থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। আর সেই থেকে সারা বিশ্বে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর আমাদের অবস্থা হয়, 'দাদায় কইছে ড্যাশের ভাই/ আনন্দের আর সীমা নাই।'
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষাতে পরিণত করতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের যুব সমাজ ছিল সরব। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের মতো তরুণেরা হয়েছিলেন ভাষাশহিদ। সেই থেকে বাঙালির একটিই সেনাবাহিনী -- ভাষাসেনা। পূর্ব থেকে তার রেশ ছড়ায় পশ্চিমেও। তবে আমরা, ভাষা আন্দোলনের ওম নিয়ে যতটা ফুলেফেঁপে উঠেছি, তার এক কণাও সংগ্রাম করিনি। দইয়ের মাটাটা খাচ্ছি কোনওরকম মন্থন না করে। এক কাছাড় আর শিলচরে যা লড়াই হয়েছিল, তাকেও আমরা তেমন করে কলকে দিইনি। ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে অসমের বরাক উপত্যকার শিলচর স্টেশনে আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইতে অসম পুলিশের গুলিতে এক নারীসহ ১১ জন বাংলাভাষী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, সেই কথা আমরা কজন মনে রাখি? বুক ঠুকে বলতে পারি, আমাদের মধ্যে বোধহয় একজনও ওই আন্দোলনের শহিদ দিবসটির তারিখ ঠিক মতো বলতে পারবে না!
এটা কিন্তু, 'আমার বাচ্চাটার ঠিক বেঙ্গলি আসে না।' এমন গর্বিত বাবা-মায়েদের যুগ আসার অনেক আগের কথা। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের, 'আমি বাংলায় গান গাই' শুনে মোহিত হয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে হিংলিশে কথা একমাত্র বাঙালি ছাড়া আর কোনও ভাষীর মানুষ পারবে না। তাই বাংলার কবি সহজেই লিখতে পারেন, 'সারাটা বছর বাংলাকে ভুলে থাকি /ছেলেকে পড়াই ইংলিশ মিডিয়ামে /রবীন্দ্রনাথ শোকেসে সাজিয়ে রাখি/ কান্না ঝরাই মাতৃভাষার নামে।'  কিংবা 'ইংরেজিটা সভ্যভাষা,/ বাংলা পড়ব না/ এগিয়ে থাকার স্বপ্ন দেখি/ পিছিয়ে পড়ব না/ বোকার মতো সহজপাঠকে /আঁকড়ে ধরব না।'
অথচ একুশে, থুড়ি অমর একুশে এলেই আমরা স্কুল-কলেজ-কর্মক্ষেত্রে-পার্কে গলা কাঁপিয়ে বলি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা মধুর একটি ভাষা। কারণ এ ভাষাটিকে আমরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ছিনিয়ে এনেছি। যে কারণে এর মর্যাদাও আমাদের কাছে অনেক। গর্বোবোধ হয় এ ভাষার জন্য। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের মতো ভাষাসৈনিকরা যে ভাষা প্রতিষ্ঠিত করে গেছে তার আবেগ ও সম্মান বাঙালীদের কাছে অনেক। সত্যিকার অর্থেই মনের আবেগমিশ্রিত এক ভাষা বাংলা ভাষা। ভাবুন তো কীরকম হিপোক্রিট আমরা! আমাদের মধ্যে হিপোক্রেসির ডিগ্রিতে যারা আরও চড়া, তারা গলার শ্লেষসা ঝেড়ে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ঝরিয়ে বলি, 'মাতৃভাষা সবার কাছেই প্রিয়। সেই ভাষা আরও বেশি মধুর হয় যদি তা অর্জন করে নেওয়া যায়। তখন উপলব্ধি করা যায় মাতৃভাষার টান কতখানি।' আমি মানছি, দুই বাংলাতেই ঘুরেফিরে প্রতিবছর বেশ আড়ম্বরেই পালিত হয় মহান ভাষাদিবস। অমর একুশে। প্রভাতফেরীতে বেজে ওঠে চিত্ত। নব জাগরণে জাগরিত হয়ে ওঠে চারদিক। বিভিন্ন আঙ্গিকে দিনটিকে স্মরণ করার জন্য চলে ব্যাপক আয়োজন। কিন্তু আমরা দিবসটিকে মানি, শপথগুলোকে নয়। তাই প্রতিদিন নানা স্তরে আমাদের বাংলাভাষা ধর্ষিত হচ্ছে। কখনও নিজেদের কৃতকর্মের ফলে কখনও বিজাতীয়দের মূঢ় আস্ফালনে। এই খাল কেটে কুমির আনার কাজটা আমরা করছি আমাদেরই সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে। নইলে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নানারকম রাষ্ট্রীক কৌশল হয়, কৈলাস থেকে নেমে এসে কোন বর্গী আমাদের ধান-চিঁড়ে লুটতে শুরু করে তখন আমাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা লবেজান বাঙালিগুলো তাদেরই হাত ধরে জিগির দেয় কোন সাহসে? অথচ তখনই তো অকম্পিত স্বরে আমাদের বলা উচিত ছিল, 'বাংলা ভাষা শুধু গোরুর দুধই খায় না, কাছিমের মাংসও খায়।' আমাদের তো বলা উচিত, যে ভাষায় গীতাঞ্জলি লেখা হয়, যে ভাষায় কপালকুণ্ডলা লেখা হয়, যে ভাষায় বিদ্রোহী লেখা হয়, যে ভাষায় সাতটি তারার তিমির লেখা হয়, যে ভাষায় পথের পাঁচালি লেখা হয়, যে ভাষায় কাজলা দিদি লেখা হয়, যে ভাষায় চিলে কোঠার সেপাই লেখা হয়, যে ভাষায় পদ্মা নদীর মাঝি লেখা হয়, যে ভাষায় হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান, যে ভাষায় নন্দিনী রঞ্জনকে ডাকে, যে ভাষায় সুবর্ণরেখা অভিযান শেষে কবি গেয়ে ওঠেন,
এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধরো,
যে ভাষায় গভীর নির্জন পথে লালন বলে ওঠেন, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।/ ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়। আমরা বলব, হাজার চুরাশির মায়ের ছেলে আমরা ফ্যাতাড়ু হতে পারি, কিন্তু ভাষারাবণদের হাতে আত্মসমর্পণ করব না। গভীর অন্তর্ঘাত চালিয়ে বর্গীহানার হাত থেকে আমরা বাংলাভাষাকে, মায়েরভাষাকে বাঁচিয়ে রাখব। এটাই হবে দু'হাজার কুড়ির একুশে শপথ।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours