প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

শিল্পপ্রবণ মনের সৌন্দর্য ছুঁয়ে জগতে আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। মানুষের মনের প্রবৃত্তিগুলির বিকাশ কেবল মাতৃভাষার মধ্য দিয়েই সম্ভব। নরম রোদ্দুরের মতো অনুভূতির রাজ্যের ভাষা৷ যদি বলে সংজ্ঞাগত প্রকাশ, তবে, "মনের ভাব প্রকাশের জন্য, বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে।" মাতৃভাষা স্বাভাবিক ও সর্বাঙ্গীন বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ সহায়ক৷ জাতীয় চেতনা, জাতিয়তাবোধ ও স্পন্দিত গৌরবের তৃপ্তিকর মাধ্যম হলো মাতৃভাষা।

সময়টা ১৯৫২ সাল৷ ইতিহাস বলছে ঝিমধরা রাত ঘেঁষে কতো কথারা একা হয়ে গেছে। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৯ এ অমৃতসরে জালিওয়ানাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন, ১৯৩১ এ গান্ধী আরউইন চুক্তি,  ১৯৩৪ এ মাস্টারদা সূর্য সেন ধৃত, ১৯৩৪ সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি,  ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনা, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারতের ভাগ, পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়৷ পাকিস্তানের দুই অংশ - পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান।  ১৯৪৮ সালের পাকিস্তান অধিরাজ্য ঘোষণা করে যে,  উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণাই পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণের মধ্যে ক্রোধ সৃষ্টি করে।

উর্দু হলো একটি ইন্দো আর্য ভাষা। এই ভাষা ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামী সংস্কৃতির একটি অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যেখানে হিন্দি আর দেবনাগরী লিপিকে হিন্দুধর্মের উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়৷ তাই উর্দুর ব্যবহার উত্তর ভারতে সম্বৃদ্ধির জায়গা নিলেও, বাংলার মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসাবে মেনে নেয়। উনিশ শতকে শেষভাগে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা শুরু করেন।  ১৯৩৭ এর মুসলিম লিগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৪৭ সালে ১৭ ই মে খলীকিজ্জমান ও জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব প্রদান করেন৷ এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মুহাম্মদ এনামুল হক সহ বেশ ক'জন বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করেন৷ আর করাচীতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, আর তার ফলেই তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরাজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানায়৷ আর এই দাবি মেনেই ২৬ শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ধর্মঘট হয়। মার্চের প্রথম দিকেই " সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ "। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হতেই মানুষের চেতনায় সাড়া জাগে৷ ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ এক বিশিষ্ট কর্মসূচী পালনে ব্রতী হয়৷ এবার বাঁধ ভাঙে।  শেখ মুজিব, শ্যামসুল হক, আলি আহাদ সহ ৬৯ জন গ্রেপ্তার হয়। আর ফলস্বরূপ ১৩- ১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। এই আন্দোলনের পক্ষ হয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন কে ১৫ ই মার্চ ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত করতে বাধ্য করা  হয়। ২১ মার্চ  মাসে সোহারওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা করা হয় যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
২৫ শে জানুয়ারিতে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এলে, ২৭ শে জানুয়ারির পল্টন ময়দানে এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ শুরু হয়। তিনি সেই উর্দুকেই সমথর্ন করেন৷ এরপর ২৯ এ প্রতিবাদ সভা ও ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়৷ সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জড়ো হয় এবং প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ পরে ৩১ শে জানুয়ারি মাওলানা ভাসীনের নেতৃত্বে ৪০ জন সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়।

এবার আসি ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায়। পূর্ব সময় নির্ধারণের কথা ধরেই সমবেত প্রতিবাদীবৃন্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে তখন ১৪৪ ধারার বিপক্ষে স্লাগান শুরু হয়৷ পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের সাধারণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানানো হয়৷  পুলিশ ঘিরে ফেলে অস্ত্রে ; উপস্থিত এবার শ্রদ্ধেয় ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের  উপাচার্য।  বেলা সোয়া এগারোটায় প্রতিবাদের অনলে ভাঙে গেট; বাংলা ভাষার দাবিতেই তো বিক্ষোভের ভূমিতে ঝড় ওঠে। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস তো আর সর্তক করে না ভয়ে, এবার যুদ্ধ জুড়ে যেন মায়ের মুখের ভাষা নিয়ে সন্তানের কান্না মেরুদণ্ড সোজা করে আত্মবিশ্বাসে। উপাচার্যের নির্দেশ তখন পুলিশকে রুখতে পারলেও, ক্যাম্পাসে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রতিবাদে পুলিশ বেশ কিছুজনকে গ্রেফতার করে। এতো কিছু পরেও তেজগাঁও নিয়ে কিছুজনকে ছেড়ে দেওয়া ফলে, বিক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়৷ বেলা ২ টায় আইন পরিষদের সদস্যদের বেঁধে ফেলা হয়৷ কিন্তু যখনই ছাত্ররা আইনসভায় গিয়ে দাবি উত্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনই অতর্কিতে পুলেশের গুলিবর্ষণ শুরু হয়৷ রক্ত ভিজে মাটিতে সাক্ষর রেখে গেলেন আব্দুল জব্বার, রফিক উদ্দিন আহমেদ। এছাড়া আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরো অনেকে নিহত হন৷ ঐদিন ৮ থেকে ৯ বছরের অহিউল্লাহ নামে এক কিশোর নিহত হন৷

রক্তে তাজা ইতিহাসে এবার প্রতিবাদের সুর। আন্দোলন ধীরে ধীরে শিল্পী মহলে ছড়িয়ে পড়ে। মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলের বেশ কিছুজন এই ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ান৷ এর পাশে দাঁড়ান অনেকেই, কিন্তু প্রাণের মূল্য কি আশ্বাসে ধরা যায়। একই দিনে পুলিশের পুনঃপুন আক্রমণ জনতাকে আরো বেশি বিক্ষুব্ধ করে৷ কেউ কেউ বলে, পুলিশ বেশ কিছু লাশ নিজেই সরিয়ে দেয়। সংবাদপত্রগুলি অনেক সংবাদ নিজেই চাপা দেয়। সরকারের প্রতিশ্রুতি কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ প্রত্যাখ্যান করে।

২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের পর আব্দুল লতিফ প্রথম সুরারোপ করেন, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি। " ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ নতুন করে সুরারোপ করে৷ ১৯৫৪ সালে একুশে সংকলনে এই গানটি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সরকার এটি বাজেয়াপ্ত করেন। এবার আসে ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি।

 আলোর ঝলকানিতে চমকে গেছে দূর অভিমান। এমন ছায়া মেঘে ভালোবেসে এসেছে, সোনালী পরগ। ও বুকে, মেয়ের  মুখ গুঁজে থাকা সন্তানের মতোই অপরাহ্নের ধ্যান প্রতীক্ষা । হৃৎপিণ্ড আঁকড়ে ধরলে,  এমন সজাগ স্মৃতি আটকে নিতে হয় চোখে।
নমীয় বন্ধুর মতো দখিনা বিহ্বল লাগে শাখায়। বিশ্রামের পথে আধুনিকের  উদাস ভালোবাসায় অকারণ পাতা ঝড়াটা মানতেই তো কালের ঘাত প্রত্যাঘাত। পথ বেয়ে শরীর ও মন জোড়া বুকে ঘাম ছুঁয়ে আবাধ্য লীলায় পবিত্রমাটিরাও প্রতীক্ষায়। পলাতক সময়ে পদাতিক রাস্তারাও যে কালের সন্ধিক্ষণ বোঝে; সাজিয়ে যায় অন্তরীক্ষ গোপন নিঃস্বতায় ; মনও সন্ন্যাসী হয়,  শব্দের খেলায়।  মগ্ন বেহাগের সুরে  কথা বলে।।

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতে এই ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা প্রকাশিত হয়৷ উদযাপনের বাহারে উদ্বোধন তো ফলাফল, কিন্তু যাপনে আজও মায়ের বুকে কান্না আসে...  রক্তে রাঙা ভাষা দিবস আজ৷


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours