দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

রামপুরহাট মর্গে আত্মীয়দের ভিড়!  লাশকাটা ঘরে মাত্র ষোলো বছরের কিশোর রোহিত লেট!  ওভাবে কেন মরবার সাধ হলো ? সেটাই চিন্তার! সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু আশা ছিল, তবুও …

এখানেই থেমে গেল একটা জীবন!  অকুতোস্থল বীরভূমের ময়ুরেশ্বরের -১ ব্লকের  ডাবুক গ্রাম পঞ্চায়েতের মজুরহাটিগ্রাম। সেই গ্রামের বছর ষোলোর  বাসিন্দা রোহিত লেট। ডাবুক উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীর পড়ুয়া।সে নাকি মোবাইলে আসক্ত ছিল। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় আগের রাতে ইউটিউবে ক্ষুদিরামের ফাঁসির ভিডিও দেখে এবং তার গান শোনে।  মঙ্গলবার  দুপুরে সেটাই  দেখার পর আত্বহত্যা করে রোহিত!মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মল্লারপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় মৃতদেহ। বুধবার রামপুরহাট হাসপাতালে ময়না তদন্ত হয়।

মৃতের দাদু অনাথ লেটই জানিয়েছেন, ‘‘রোহিতের দেহ হাসপাতালে পাঠানোর পর প্রতিবেশীরা তার মোবাইল ঘেঁটে দেখেছেন যে রোহিত শেষবার শুনেছিল ‘একবার বিদায় দে মা’ গান। দেখেছিল ক্ষুদিরামের ফাঁসির ভিডিও।’’ গ্রামেরই যুবক শ্রীমন্ত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘‘খবর পেয়েই ছুটে যাই। খুব ভালো ছেলে ছিল। একদম চুপচাপ। সবচেয়ে আশ্চর্য, ওর মোবাইল ভরে রয়েছে ‘একবার বিদায় দে মা’ গানের ডাউনলোডে। নানাজনের কন্ঠে গাওয়া এই গান সে রেখেছে মোবাইলবন্দী করে। ইউটিউব সার্চ করেও দেখা গেছে, শেষ সময়ে সে শুধু দেখে গেছে ক্ষুদিরামের ফাঁসির নানান ভিডিও।’’

বড়লোক ঘরের অবসাদগ্রস্থ ছেলে ছিল না রোহিত। বাবা মা দিনমজুর। পরিবারের একমাত্র পুত্রসন্তান বলতে রোহিত লেট। তার দিদি বিয়ে হয়ে গেছে আগেই। স্বভাবে চুপচাপ গোছের। পড়াশোনায় মধ্যম মানের।  বেশিরভাগ সময় একাই থাকত রোহিত। একদমই ঘরকুনো। বন্ধবান্ধব, বাইরে জগতের সাথে মেলামেশা একদমই ছিল না বললেই চলে। অনেক কষ্টে পুরোনো ফোন পালটে জিও ফোন নিয়ে ছিলেন পনেরো শো টাকার বিনিময়ে। পরিবারে লোকেরা জানিয়েছেন, মোবাইলেই বুঁদ হয়ে থাকত সে। প্রায় সবসময়।
মনস্তত্ববিদ তথা চিকিৎসক দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায় বলেন, আসলে মোবাইল, ইন্টারনেট জগতের মাধ্যমে এই কোমলমতি কিশোররা ফ্যান্টাসির জগতে বিচরণ শুরু করে। শক্তিমান বা ভীমের মত অবাস্তব কাণ্ড বাস্তবায়িত করতে প্রবৃত্ত হয়। এরা অনেক সময় জানেই না, তাদের  এই কাণ্ডের আফটার ইফেক্ট কি? তবে ক্ষুদিরামের ফাঁসির ভিডিও দেখে তাকে নকল করে মৃত্যু কোনদিন শুনিনি। খুব দুঃখজনক ঘটনা। 

 কি ঘটেছিল সেদিন?  অন্যান্য  দিনের মতই রোহিতের বাবা ও মা  সকালেই বেরিয়েছিলেন কাজে। রোহিতে ঘরে থাকা রোহিতের ঠাকুমা বলে গিয়েছিলেন দুপুরে রোহিতকে দুপুরের খাবার দেবার জন্য। সেইমত দুপুরে ঠাকুমা ডাকতে গেলে দেখে রোহিতের ঘরে খিল দেওয়া। ডাকাডাকি করার পরও সাড়াশব্দ না মেলায় জোরে ধাক্কা মারেন দরজায়। জোর ধাক্কায় খুলে যায় দরজা। ঠাকুমা আঁতকে ওঠেন। মুখে কাপড় জড়িয়ে কে যেন ঝুলছে। চিৎকার করতেই পাশেই থাকা রোহিতের সম্পর্কিত এক দাদু ছুটে আসে। দেখার পর ডাকাডাকি করেন আশপাশে লোকজনকে। নামানো হয় রোহিতের দেহ। ততক্ষণে সব শেষ। রোহিতের দাদু অনাথ লেট জানান, ‘‘নিতান্তই গরিব পরিবার আমাদের। রোহিত ছিল একেবারেই চুপচাপ। সবসময় কিছু না কিছু ভাবত। তবে ওর মনের খোঁজ পাই নি কোনদিন।  স্কুল ছাড়া বাইরে খুব একটা বেরোতো না। একটি মোবাইল কিনেছিল। তা নিয়েই পড়ে থাকত সব সময়। মোবাইল কাল হল, অকালে ঝরে গেল ছেলেটা !”

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours