প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

সৃষ্টির আনন্দ ছুঁয়েছিল প্রাণ, তারুণ্যের আধারে শব্দ যাপন বড়ো একক মনে হয়। তাই তো মনন ও চিন্তনে সমাজ, সভ্যতার ইতিহাস শানিত হয় আর!  ভর করে প্রাণ, আসে কবিতারা। কি পায় নি, কি পেয়েছি ভাবতে বসেই কি কল্পনার জগতের প্রসারণ বেয়ে আনন্দ আর সৌন্দর্যের ভুবন নেমে এসেছিলো সেদিন!!শুধু যে প্রেমের বন্ধনীকে নাথ করে বয়ে যাবে ভাষারা, এটাও কি সাক্ষাত উত্তরণের কাল সুনিশ্চিত করে! এ যে ব্রহ্মানুভূতির মতো বর্ণনাতীত। জীবন তো নাটকীয়তায় সৃজনে গীতিময় নয়; জীবন কেবলমাত্র রুদ্র বা প্রেমময় হবে, এমনটাও কোথাও বলা নেই। তবে কি এখনও রাস্তায় হাঁটা! অর্ধেক জীবন তো শূন্য মনে হয়। কিছু নেই এমন জীবনে মাটি সরে যায় বার বার৷ মনে পড়ে যায়, " সময় ঝরিয়ে পড়ে নির্জন দুপুরে / যেখানে বসিয়াছিল একদিন মুখোমুখি, / তোমার চুলের গন্ধ বাসি হয়ে ধুলো হয়ে উড়ে / ক্লান্ত করে দিয়ে যায় যেখানে সূর্যের গান / তোমার আমার সেই ছোট চিলে ঘরে। " এতো সন্ধ্যা স্নাত ঘ্রাণ বয়ে বেড়ায় শ্রবণবাস্তবতার ঝোঁক৷ স্মৃতি বেয়ে চুলের আদুরে আলাপন, বিলি কেটে যাওয়া পরশে কাজল কৃষ্ণ বাহার আর তখনই দেওয়াল গড়ে ওঠে চিলেকোঠায়।

কবি বলে উঠলেন " তার চেয়ে শীতল মেয়ে / তোমার বুকে উপোসী গাল রাখা " ;তবে কি শীতল স্পর্শ বয়ে অদ্বিতীয়া চোখ ছোঁয়া তৃতীয় নয়ন ; এমন পদ্মপাতার প্রেম ছুঁয়ে আশ্রয়ের আলোক হৃদয়ে উপলব্ধির সারস এঁকে যায়, প্রাণ ভরে। কবি বললেন " সময়ের গায়ে জ্বর "। এ এক অনন্য ম্লান সময়ে  অকস্মাৎ জ্বলে ওঠা। মনে পড়ে জীবনানন্দের  বয়ে আনা বস্তু ছুঁয়ে পরাবাস্তবের অলীক ভুবন। কবি ফিরে এসেছেন মাটি ছুঁয়ে পরিণামে। " আমি অনেক হৃদয় দেখলাম / তোমার মতো গভীর কেউ না / আমি অনেক কবিতা জানলাম / তোমার পলিমাটির মতো না। "কবি তো স্নিগ্ধ পেলবতার সুখ খুঁজেছেন। নদী যে মাতৃসম। নদীর কাছে কবির প্রার্থনা, " শিখিয়ে দাও তোমার ভাবনা "।
দুই পথে দুই মানুষের প্রস্থান৷ নিষ্প্রাণ ঘোলাটে চোখে অনুভবের দেওয়াল৷ মানুষ তো আজীবন কাঁটাতার, ভিসা, পাশপোর্ট এই দিয়েই আপাদমস্তক ঢেকেছে নিজেকে৷ দেওয়াল মানেই তো ক্লান্তি, আর অতুল নিরাশার নিয়ত যন্ত্রণা৷ চেতন ও অচেতনের মাঝে ইথারের আলো। এতো জীবনের অধিকার। " যুগ্ম করুণার স্তন / অনুভব করবো আমি... দুই কুলে তার শাখা নাড়ছে বোধিবৃক্ষ, মিলে যাচ্ছে এপার ওপার। "
সমাজের ভীষণ সর্বনাশা দিনে কবির মনে হয়েছে সোনাগাছির বুড়ি বাড়িউলির চেয়ে তো মন্ত্রী, অধ্যাপক, অমানুষিক মনে হয়। "মানুষ আজো জাদুঘরের কাঁচে / ইতিহাসের কিরণ হয়ে আছে " আবার বললেন, "ভাদ্র মাসের কুকুর তাকে দেখে / মৃতদেহের মনুষত্ব শেখে। "

কবিকে নিরাশা পেয়ে বসে নি কোনোদিন। প্রাণের বুকে  জেগে ওঠার নির্যাস নিয়েই পথচলা৷ আজ দ্বেষের আগুনে কমতি ছিল, অনুভবে বুঝেছিলেন ভাতের গন্ধ বড়ো তীব্র। তিনিই তো লিখলেন, " পুরুষ নামের যত ফুল ফোটে রুক্ষ্ম ও কঠিন / তোমার ঘুমের ঘোরে প্রণামের মতো রাখব।" এতো আগুনে হাত রেখেই রুক্ষ্ম গ্রন্থি অবতরণ। তিনি বিলক্ষণ জেনেছেন, " মারতে জানা যত সহজ / মরতে জানা তত সহজ নয়। " সাধারণের জন্য পরমান্ন নয়, সাধারণের জন্য ঈশ্বরপ্রেমিক বৃক্ষ নয়, রয়েছে আদিগন্ত আকাশ জুড়ে জলসাগরের আহ্বান। তাই তো বললেন, " তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়। "

দীর্ণ অবয়বের ভরাজালে যেন আশ্রয়হীন সকলেই৷ " মানুষ রে, তুই সমস্ত রাত জেগে / নতুন করে পড় / জন্মভূমির বর্ণপরিচয়"।কবির চিন্তা চেষ্টা মায়ের আঁচলে, ফুটপাথের ঝুপড়িতে পৌঁছে দিতে হবে জ্যোৎস্না; ভাবের ঘরে চোর হলেও, বাস্তবিক আসক্তির চোর হতে পারেন নি৷ প্রতিটি আলোর বুকে শোক নয়, যাপন লিখে গেছেন। আলোর তো শীত নেই, খিদে নেই;  প্রতিটি দিক জুড়ে আছে পূরবী বিভাস। অনুভবের বুকে তো প্রশ্ন উঠে না কোনোদিন। কবি তো বিজন মানুষ নন, নশ্বর কিন্তু অঙ্গুলি নির্দেশনায় অবিনশ্বর।  আসলে কবি নবজীবনের স্বাদ পান করেছেন। জীবনে শর্তহীন প্রতিবাদের পদঝংকার শুনেছিলেন, তাই হারাতে তো পারেন না তিনি। কবি তো হারেন না, অতিক্রম করে যান সবটুকুই। অবিনাশী বরেণ্য পথ যদি দিতে পারে, তবে সে পথ, সে যাপন আছে শব্দে৷ মানুষ হারতে পারে, কিন্তু ধ্বংস হয় না কোনোমতে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours