রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

সাহিত্য কথার অর্থ হল সামাজিক দর্পণ। "যাহা সামাজিক ও বাস্তবিক তাহাই সাহিত্য " বলেছিলেন এক বিখ্যাত মনিষী। দৈনন্দিন সমাজে খাওয়া, পরা ইত্যাদি যাবতীয় কর্মের সঙ্গেই যৌনতাও হল একটি বাস্তবিক কর্ম। বাবা ও মায়ের স্বাভাবিক যৌনক্রিয়ার মাধ্যমেই সন্তানের জন্ম, ময়ূরের আঁখিজল বিড়ম্বনা বাড়ায় ; হাসির উদ্রেক করে।

সাহিত্য ও শিল্প, দুজনাই দেবী সরস্বতীর বরপ্রাপ্ত ; তিনি হলেন বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী অর্থাৎ বাগদেবী। শিশুকাল থেকে আমরা বিদ্যালয় ও নিজগৃহে তাঁর আরাধনা করে থাকি, প্রার্থনা করি সফলতার।  আচ্ছা দেবী সরস্বতীর অঞ্জলিমন্ত্র খেয়াল করেছেন কখনো? তাঁর একটি লাইন হল " কুচযুগ শোভিত মুকুতাহারে " অর্থাৎ মুক্তোমালায় ঢাকা স্তনদ্বয়। এবার ভাবুন আপনারা এযাবৎ ঠিক কতবার শিক্ষক শিক্ষিকা ও তাবৎ গুরুজনদের সামনে মন্ত্রটি উচ্চারণ করেছেন, অশ্লীল তাইনা!

বাংলা সাহিত্যে যৌনতা ছড়িয়ে আছে মনিমুক্তোর মত। স্বল্প পরিসরে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবু কিছুকিছু তুলে ধরলাম আমার স্বল্প জ্ঞানানুসারে।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্য থেকে আরম্ভ করে সংস্কৃত, গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান ইত্যাদি দেশের সাহিত্যেও যৌনতা জড়িয়ে অঙ্গাঙ্গীভাবে। আরব্যরজনীর গল্পগুলোয় কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসেছে যৌনতা ; প্রকাশ পেয়েছে মূর্তভাবে।

সংস্কৃত " গীতগোবিন্দম " এর অনুকরণে রচিত বড়ু চণ্ডিদাসের " শ্রীকৃষ্ণকীর্তন " কাব্যগ্রন্থে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে যৌনতার, তা এতোটাই খোলামেলা যে আধুনিককালেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলে বাদ দিতে হয় তার তিনটি অধ্যায়। কাশীরাম দাসের লেখা মহাভারত মহাগ্রন্থেও সত্যবতী, হিড়িম্বা তাঁদের যৌনাকাঙ্ক্ষা জানিয়েছেন খোলামেলা সোচ্চারভাবেই।
বাংলা সাহিত্যে যৌনতার পথিকৃত ধরা হয় দোনা কাজী ও দৌলত গাজীকে। দোনা গাজী রচিত " ছয়ফুল উলক বদিউজ্জামাল " গ্রন্থটি হার মানায় আধুনিক চটি ও পর্ণকেও।

নাথসাহিত্যের অন্যতম স্থপতি বলা হয় গোরক্ষনাথকে। তাঁর রচনায় যৌনতা সমাজের ভারে অবদমিত হতে শিক্ষা দেয়।
প্রাচীন সাহিত্যে যৌনতার পথিকৃত হিসাবে ধরা হয় চর্যাপদকে। সেখানে যৌনতা শুধু সামাজিক নিয়মরক্ষা নয় তার উত্তরণ ঘটে আনন্দে যাকে পণ্ডিতগণ বলে থাকেন শৃঙ্গার রস। এছাড়াও তৎকালীন কবি আলাওলের রচনায় পাওয়া যায় যৌনতার বাস্তবিক উপাখ্যান।

মধ্যযুগোত্তর আধুনিক যুগে শ্রেষ্ঠ কবি ও লেখকদের কলমে যৌনতার সোচ্চার বর্ণনা পাওয়া যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা " কৃষ্ণকান্তের উইল" এ হীরামালিনীর সঙ্গে গোবিন্দলালের মিলনবর্ণনা দেওয়া রয়েছে সুচারুভাবেই, যা পড়ে অনেক বোদ্ধাই শিউরে উঠতে বাধ্য। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিশোরবয়সে রচিত একটি কবিতার লাইন " তব কুচযুগ নিঙারি নিঙারি ", মানেটা ভাবুন। এছাড়াও তাঁর "চোখের বালি", "ঘরে বাইরে", "চার অধ্যায়ের" এলা, "বৌঠাকুরানীর হাটে" নারীশরীরের বর্ণনা রয়েছে পরিপূর্ণভাবে। " শেষের কবিতা" উপন্যাস ও " ল্যাবরেটরি " গল্পেও উঠে এসেছে যৌনতার প্রকাশ, কখনো অর্গলযুক্ত, কখনো অর্গলহীন।
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত "গৃহদাহ" ও "চরিত্রহীন " উপন্যাসদুটির যৌন আবেদন অস্বীকার করতে পারবেন কি?  নাকি অস্বীকার করতে পারবেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের " কুষ্ঠরোগীর বউ " ও সমরেশ বসুর " বিবর" কে।
এবার আসি ধর্মে। বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্ম হতে জৈন হীনযান, তন্ত্র হতে সুফি মতবাদ যৌনতা ছড়িয়ে জীবনের প্রত্যেকটি কোনে। সমাজ তাকে অবদমিত করতে পারলেও অস্বীকৃত হতে পারেনা কোনোমতেই। একজন মানুষ নগ্ন জন্ম হতেই, বয়াতির গানে বলা হয় মানুষ জন্মতে মৃত্যুতে বাসরে হাশরে নগ্ন। অর্থাৎ মানুষের জন্ম যেমন যৌনতায়, তার শেষ অর্থাৎ ধ্বংসও যৌনতায়। ষড়রিপুর বাকি পাঁচটি রিপুর ন্যায় কামও সমান প্রাসঙ্গিক, কখনো কখনো উগ্রও।

বিখ্যাত দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও পাভলভ তাঁদের রচনায় যৌনতার জীবনমুখী চিত্রাঙ্কন করেছেন। একজন মানুষ প্রাপ্তবয়ষ্কতা প্রাপ্তির পূর্বেই যৌনবোধ প্রাপ্ত হয়, যে কারণে বিদ্যালয়ে সেক্স এডুকেশন চালু করার দাবী বারবার ওঠে।

সাহিত্য মনের আয়না, মানুষের কল্পনা, অবদমিত জীবনকে বাঁধে শব্দে। তাই সাহিত্যেও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে যৌনতা; কখনো তার রগরগে বর্ণনাও। সাহিত্যে যৌনতার ব্যবহার হলেই তা চটিগল্প হয়না, আবার সর্বশ্রেণীর পাঠকের কাছে তা গ্রহণযোগ্যও হয়না। ঠিক সেই কারণেই সমরেশ বসুর "প্রজাপতি " নিষিদ্ধ হয় আবার কবি বিষ্ণু দে " ঘোড়সওয়ার " লিখে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। আসলে পাঠকমন নিজেরাই প্রকৃতপক্ষে জানেন কি তাঁরা আদপে কি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক?

লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লিখিত " হলদে গোলাপ" উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে একটি মাইলস্টোন হলেও তাকে নিয়ে খিল্লি ও সমালোচনায় মত্ত হন কিছু তথাকথিত বোদ্ধা। সাহিত্যে যৌনতা উপস্থাপনের প্রধান শর্ত ভাষ্যব্যবহার ও নিগূঢ় পর্যালোচনা। কখনো কখনো কিছু লেখকের রচনায় যা পর্যবসিত হয় উগ্র আবেদনে, তবে তা সমালোচনা যোগ্য ; লেখকের চরিত্রব্যাখ্যার নয়।

কিছু সাহিত্যজ্ঞানহীন মানুষ নারী দ্বারা রচিত সাহিত্যে বিন্দুমাত্র যৌন আবেদন পেলে তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে বসেন,  এমনকি তাঁর ভোগ্যমূল্য ও বিছানায় কতজনের সঙ্গে শুয়েছেন তা নিয়েও রসালো রগড় করতে পিছপা হননা। আদপে ইহা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফলবিশেষ এবং এই সমালোচনায় নারীকূলই প্রথমা।

তাই সকলকে অনুরোধ লেখনীর সমালোচনা করুন, লেখকের চরিত্রবিশ্লেষণ আপনার অধিকারের আওতায় পড়ে না। সুস্থ যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা অবশ্যই কাম্য, এতে উন্নতি ঘটে লেখনীর। তবে সমালোচনা করতে গিয়ে নিজ কলুষিত মনের প্রকাশ করে ঘৃণার পাত্র হবেন না। সমালোচনা স্বাগত তবে নোংরামি নয়।।

তথ্যসূত্র-- গুগল

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours