প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

ইতিহাস বলছে,

"শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্মের পরিক্রমণের প্রথম পথ ইসলাম ধর্মের পথ, আর সাথে সম্প্রীতির পথে আছে খ্রিস্টধর্ম "।
দক্ষিণেশ্বরের বহু মুসলিম সুফি সাধক এসেছেন। তাঁরমধ্যে সাধক গোবিন্দ রায় অন্যতম। মুসলিম সাধক গোবিন্দ রায়  রামকৃষ্ণকে ইসলামধর্মে দীক্ষিত হওয়ার অনুরোধ করেন। ইসলামধর্মে দীক্ষার মুহুর্তে তিনি আলখাল্লা পড়েন। ব্রাহ্মণ্য সমাজের নিষিদ্ধ গোমাংস ভক্ষণে তিনি তৎপর হন। কিন্তু, মথুরবাবুর একান্ত অনুরোধে তা খণ্ডন করা হয়। ইতিহাসে সর্বধর্মের সমন্বয় সাধনাকেই নাকি রামকৃষ্ণের ইসলাম সাধনার তাৎপর্য বলেই চিহ্নিত হয়েছে।

পোড়া বাদুড়ের গন্ধ বয়ে আনে বিচ্ছিন্নতা।  তাই ১৮৬৬ থেকে ১৮৭৩ পর্যন্ত সাত বছর পর,তিনি খ্রিস্টধর্মকে উপলব্ধি করেন। এ যেন বিশ্বধর্মচর্চার ইতিবৃত্তে নতুন পথ। দক্ষিণেশ্বরের পাশের বাগানবাড়ির মালিক মল্লিকবাবুর কাছে বাইবেল পাঠ শ্রবণ শুরু হয়৷ আসলে অন্তরে চেতনার  জাগরণ এলে কলসপূর্ণ স্বপ্নের দ্বারে খড়, মাটির আয়োজন লাগে না। অকপট পূর্ণভাবে ভক্তিভাব, ঋষিভাব চোখে পড়ে। যেমন করে চৈতন্য প্রমত্ত হয়েছেন তালে তালে৷ বিভোর আতরের শিশিতে তো প্রেম ধরা আছে আলোক ফুলকি চেতনে, তাই আয়োজনের খাদ্য খাদক চক্র নিপাট বৈধতা পায় না।

সময়টা ছিল প্রথা ভাঙ্গার কাল৷ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের জমিটি যে, রানী  রাসমণি কিনেছিলেন, তা আসলে এক ইংরেজ খ্রিস্টান অ্যাটর্নি জেমস হেস্টিস - এর জমি। কালী মন্দিরের পাশেই ছিল গাজী সাহেবের স্থান।  এমনকি রানী মন্দিরের অতিথিশালায় সকল ধর্মের সাধকদের থাকার ব্যবস্থা হয়। চিরায়ত সংস্কার ভেঙে যোগ হয়  সমন্বয়ের সাধনা।

জার্মান মনিষী ফ্রেডরিখ ম্যাক্সমুলারের লেখা "হিজ লাইফ অ্যাণ্ড সেইংস " পাশ্চাত্যে আলোড়ন তোলে। রোলাঁ যেমন বুদ্ধ ও খ্রিস্টকে আলাদা করে দেখেন নি,  অনুরূপে নিরবিচ্ছিন্ন ধারায় লিখেছেন রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ। একদিকে ধর্মনীতি এবং দর্শন, অপরদিকে নীতি ও সমাজ। সম্বৃদ্ধতার মূলে ফিরে ফিরে এসেছে বুদ্ধ, খ্রিস্ট, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ।
বর্হিজীবনে তাঁর প্রাপ্তি শিল্পী নয়, কর্মবীর নয়, তবে সমন্বয়ের সম্পদ বলেছেন মনীষী রোলাঁ। বলা হয় যে, চৈতন্যবৃক্ষের কুসুমিত শাখা ছুঁয়েই আত্মা ও প্রেমপথ। সারদা ও শ্রীরামকৃষ্ণের বিবাহ যেন "আলি
চার্চের " যুগে খ্রিস্টীয় বিবাহ৷ অনুবাদের প্লটে ধরা আছে তাঁর নাম৷ আয়োজনের জয় তো পথ নয়, বরং প্রেমই শ্রেষ্ঠ পথ।
চরাচরের  আশ্চর্য দাবানল যেন জাগরণের ফসল। শরৎচন্দ্রের "জাগরণ " ইন্দুর মুখে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ও চেতনার উন্মোচন কথা বলে। রোমাঁ রোলাঁর মতে মানব দেবতার চিত্র অনেকটাই বাইবেলের জাকোবের সিঁড়ি মতো।  প্রগতিশীল পাশ্চাত্য প্রভাব তাঁর হৃদয়কক্ষের  বাতায়নগুলিকে পরিপূর্ণ উন্মুক্ত করেছিল৷ দ্বৈতবাদ, বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ এবং পরিপূর্ণ  অদ্বৈতবাদ - এই তিন স্তর দিয়েই পরম সত্যের পথে দিশা দেখালেন। তাই জাহ্নবী নয়, তিনি জাহ্নবী ও জোর্ডার মিলিত মহামিলনের কাণ্ডারী। প্যালেস্টাইনের নিরক্ষর জেলেরা খ্রিস্টকে পূর্ণাবতার রূপে দেখেছিলেন। গোথে মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন,  Light!  More light!
সচেতনে নিজেকে দেখা আর বিভেদহীন আত্মদর্শন " Be perfect as your father in heaven is perfect".

যীশু বলেছেন কর্ম ও প্রেম উভয়ই প্রয়োজন। এখানে বাইবেলের দুই নারীর উল্লেখ আছে, মার্থা ও মেরী। একজন যিশুর খাওয়ার ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আর একজন যীশুর বাণী শ্রবণ করেছিলেন। আসলে জীবনের সবটুকু যুক্তি বিচারে নয়, হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে অনুভব করতে হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, যীশু কামিনীকাঞ্চন ত্যাগী। "we see in the life of christ the first watchword " Not this life, but something higher. "

 আসলে, "prayer is a great weapon. " ধর্মজীবনে সাধনাই মূল কথা। এখানে সমন্বয়ের কথা আসবে কি!!  ছুঁচ কাদা দিয়ে ঢাকা থাকলে আলোর দর্শন সম্ভব হয় না। কামিনীকাঞ্চন ত্যাগই তো ত্যাগ। জীবনে সঞ্চয় কেবল ভিক্ষার ঝুলি ভরে কর্ম। সমন্বয় হলো মানব মননের মুক্তি ভাব; শাশ্বত বাণী জুড়ে ষোলো আনা ত্যাগই সাধনা, বাসনা মুক্তি।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours