কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

এই মেয়েগুলোই যেন হঠাত জ্বলে ওঠে।
লাল হলুদে। ভরসা জোগায়। বাঙালি আছে বাঙালিতেই। সরস্বতী পুজোয় ঢল নামে শাড়ির সাজে পাঁচ থেকে পঁচিশের। কেউ দলবেঁধে, আবার কেউ বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে।
ছেলেরা ধুতি ছেড়েছে বহুযুগ আগেই। অনেক কায়দা মারা ধুতি আবিষ্কার করেও ফ্যাশন ডিজাইনাররা ছেলেদের ঠিক কায়দা করে উঠতে পারেনি। বিয়ের পিঁড়িতে বসার সময় ছাড়া, ধুতি বাস্তবে ত্যাজ্য।

পুজোপার্বন বলতে বাঙালির আজও যা আছে, তারমধ্যে পুজো কম। শিল্প বেশি। বারোমাসে তেরো পার্বন মানেও ওই একই। পার্বন মানেই 'ধম্মচচ্চার' মোড়কে নির্ভেজাল উৎসব। যারজন্য অবাঙালি হিন্দুদের চোখে বাঙালির 'হিঁদুয়ানা' বেশ খানিকটা খাটো। শুনতে অপ্রিয় হলেও ধারনাটা সঠিক।
আর তাই দাঙ্গা- হাঙ্গামায় বাঙালি 'না ঘর কা না ঘাট কা'। পড়ে পড়ে মার খায়।

'জয় শ্রীরাম' বলে চেঁচাতে গেলে তার গলার নলিতে চিড় ধরে। সে অনায়াস রবি নজরুলের কবিতায় গানে। আবার বাঙালির ভালবাসার মানুষ বিবেকানন্দকেও সরাসরি উপেক্ষা করার ইতিহাসও এই বাঙালির। স্বামীজির শরীরচর্চা, হাতের পেশি সবল করার কথায় কান দেয়নি সে। মজেছিল আল্লারাখার সানাই, রবিশঙ্করের সেতারে।

বাংলা বাঙালি মানেই দুর্গাপূজা। আর দুর্গাপূজা মানেই আগমনি গান, বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহালয়া। আর পুজো সংখ্যার সাহিত্য, গান। বাঙালির দুর্গাপূজা মানে থিম পূজা। শিল্পীর কেরামতির টক্কর শ্যামবাজার থেকে ভবানীপুরে। শিল্পাঞ্চল থেকে রাঢ়বঙ্গে। দেবীমূর্তিকে নিয়েও কতই না এক্সপেরিমেন্ট। ভিড় ভেঙে পড়ে সেই শিল্পকীর্তি অন্তত একবার চাক্ষুষ করতে। শিল্পীর দুচোখে তৃপ্তির জল করে টলমল।
দেবী সরস্বতীর তেমন কর্পোরেট ইমেজ নেই। তিনি যেন মিলেমিশে একাকার প্রাণশক্তিতে ভরপুর, উদ্দাম ছেলেমেয়েদের ভিড়ে।
যে কোনও জাতির প্রাণভোমরা তার যুবশক্তি। আর এই উঠতি যুবাদের আরাধ্যা দেবী সরস্বতী। তন্বী সুদর্শনা দেবী। সুন্দরী কলেজ ছাত্রীদের ভিড়ে মিশে থাকলে দেবী বলে চেনা মুশকিল। ফারাক একটাই, আলাদা করে চোখে পড়বেন সেই তিনি। এমনই তাঁর রূপের ছটা।

সানি লিয়নও এই জায়গায় টলাতে পারেনি বঙ্গসুন্দরীদের। অন্যদিনগুলিতে বংসুন্দরীরা যতোই খোলামেলা পোশাক পড়ুক না কেন, পুজোআচ্চার দিনে শাড়ি 'মাস্ট'। আর নিজের সেই শাড়ি পরা রূপ দেখে ছোট বড় মেজো সুন্দরীরা নিজেদের রূপে নিজেরাই মুগ্ধ। তাই শত হাড়কাঁপানো ঠান্ডাতেও গায়ে গরম জামাকাপড়ের বালাই নেই।
সেজেগুজে দল বেঁধে ঠাকুর দেখতে বেরনো দশ বারোর বালিকাদের। বংবালিকাদের শাড়ির সঙ্গে প্রথম মিতালি বসন্ত পঞ্চমীর দিনেই। শাড়িগায়ে বালিকার, রাতারাতি মেয়ে হয়ে ওঠা। বেসামাল শাড়ির কুঁচি বাগে আনতে ব্যস্ত। দেবীদর্শনের এরকম সুন্দর দৃশ্য স্বর্গের দেবদেবীরাও দেখেছেন কি?

যুগের বিবর্তনে সুন্দরী দেবী সরস্বতী আর বিদ্যাদেবীর ইমেজে আটকে থাকেনি। পুরাণের তকমা ঝেড়ে সে আজ প্রেমেরও দেবী। বাঙালির 'দেবী ভ্যালেন্টাইন'। আর হবে নাই বা কেন? সরস্বতীর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা। সেই ব্রহ্মা নিজেই তাঁর সৃষ্টির প্রেমে নাকানিচোবানি খেয়েছিলেন। ঘায়েল হয়েছিলেন সরস্বতীর রূপে। সেই ঐতিহ্যই চলছে। জ্যান্ত সরস্বতীদের রূপের ছটায় অমৃতের সন্তানরা তো পাগল হবেই। পুজো নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের হাতেখড়িও এই সরস্বতী পুজোতেই।

বাঙালির এই স্বভাবদোষেই(গুণ!) তার একূল ওকূল দুইই গেলো। না সে কট্টর হিন্দুদের পছন্দের, আবার না অহিন্দুদের। তবু বাঙালি বলতে শিখলো না "বাংলা খতরে মে হ্যায়"। "বাঙালি খতরে মে হ্যায়"। পড়ে পড়ে মার খেয়েছে, তবুও হুঁশ হয়নি। শিল্পচর্চা ছেড়ে শরীরচর্চায় মন বসেনি বাঙালির।
আবহমানকাল ধরে এভাবেই অভ্যস্ত বাঙালিরা।
তা সে বঙ্গভঙ্গ থেকে আজকের রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপট হোক। ধারাবাহিকতা একইরকম। বাঙালি মনেপ্রাণে ভীষনরকম আন্তর্জাতিক। তাই রবি বঙ্কিমের পাশাপাশি ব্রেখট চর্চা।

বাঙালীর শিল্পচর্চার শেকড় যে আজও কত গভীরে তার নজির খোদ আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে মানুষটা যেহেতু রাজনীতির তাই তাঁর শিল্পচর্চা নিয়েও রাজনীতি হয়। তবে মোটের ওপর একটা জিনিস পরিষ্কার, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ মেটেনি। নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে আরও কিছু চাই। গান ছড়া ছবি শিল্প, সবেতেই তিনি।
বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও শিল্পপ্রেমী ছিলেন। তাঁর দুর্বলতার জায়গায় ছিল আবৃত্তি, নাটক। তবে তা আবর্তিতো হতো 'পার্টি লাইন' মেনে।
কাঠখোট্টা রাজনীতির মানুষরাও শিল্পের ডাকে বারেবারে সাড়া দিয়েছেন। তাই দেবী সরস্বতীর ঠাঁই মন্দিরে না হয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে। এ বছরের মতো দেবীপূজা সাঙ্গ।
আসছে বছর আবার হবে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours