প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

রাজআড়ম্বরে  মোড়া রাজা জনকরাজের সভাগৃহ। ধর্মকথার জোছনা ছেড়ে আজ যেন উজ্জ্বল রক্ত ঢেকে সন্তর্পণে থাবা দিচ্ছে রাজনীতি। বার বার গার্গীকে চুপ করতে নির্দেশ দিচ্ছেন যাজ্ঞবল্ক্য। বিদেহরাজ ঘোষণা করেছেন, এক হাজার গ্রাম এবং এক হাজার গাভী দান করবেন। গাভীদের  শিং হবে সোনায় মোড়া এবং সেই হিসাবে দক্ষিণা দান করবেন তিনি। কিন্তু,  শর্ত একটাই - তর্কে পরাজিত করতে পারলে, তবেই মহামূল্যবান দানসামগ্রী পাওয়া যাবে। দেশ বিদেশের বহু পণ্ডিত, বিদ্বান - দার্শনিকদের বিশাল আসর তখন।

রাজা সভায় ঘোষণা করলেন, "ব্রাহ্মণা ভগবন্তো যো বো ব্রহ্মিষ্ঠঃ স এতা উদহাতামিতি "। সকলের দৃষ্টি এবার সম্পদের দিকে। এ যেন প্রলোভনের বীর্য, অভিসারের মুখে দাপুটে চিরন্তনী কথা লিখে দিয়ে গেলো বজ্রকন্ঠ।  হ্যাঁ, এমন সাহস কার বা হয়!  যাজ্ঞবল্ক্য স্বয়ং উপস্থিত। বললেন" শিষ্যগণ!  আমার আশ্রমে নিয়ে যাও এই গোরুগুলি। " শ্রবণমাত্র সবাই ক্ষিপ্ত।  শব্দ কবুল করে স্বস্তিকাচিহ্ন এঁকে যেন স্থবিরের মতো স্মিত হাসছেন যাজ্ঞবল্ক্য। প্রথমে ঋষি অশ্বল প্রশ্ন করলেন, " হে যাজ্ঞবল্ক্য সমস্ত কিছুই যখন মৃত্যুর অধীন,  তাহলে মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির উপায় কী?  " যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর করলেন, " অগ্নি ই বাক্য দ্বারা, কারণ বাক্যই যজ্ঞের হোতা, বাক্যই অগ্নি, বাক্যই মুক্তির উপায়। প্রশ্নকর্তাদের  এমন বিজ্ঞ প্রশ্ন উত্থাপনে অনড় যাজ্ঞবল্ক্য। এবার দাঁড়ালেন শান্ত, স্নিগ্ধ চাহনি, মুক্তোর মতো দন্তরাজি, চাঁদের মতো গাত্রবর্ণের এক উজ্জ্বল দীর্ঘাঙ্গী নারী। হ্যাঁ, সপ্তম স্থান তাঁর। এবার হাসলেন যাজ্ঞবল্ক্য। ও!  এ তো নারী!  বচক্লুর কন্যা গার্গী বাচক্লবী৷ অসামান্য দৃঢ়চেতা নারী,  সময় গুনছিলেন, প্রস্তুতি নিলেন, প্রশ্ন করলেন,
"হে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য!  " উত্তর এলো, " ভদ্রে বিদূষী গার্গী!  "
প্রশ্ন করলেন সারা বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে!  জলের উপাদানের একক কি!  যা একত্র হয়ে সৃষ্টি হয়েছে জল? 
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, জলের উপাদান বাতাস।
গার্গী বললেন,  বাতাস কী দিয়ে তৈরি? 
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন,  বাতাসের একক আকাশ
গার্গী বললেন,  আকাশের উপকরণ কি? 
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন,  স্বয়ং সূর্য।
গার্গী বললেন - তাহলে সূর্যের উপাদান কি?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - চন্দ্র
গার্গী বললেন - চন্দ্র কি দিয়ে তৈরি?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - চন্দ্রের উপাদান নক্ষত্র।
গার্গী বললেন - নক্ষত্রের উপকরণ কি?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - দেবতারা।
গার্গী বললেন - দেবতাদের একক কি?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - তাঁদের উপাদান ইন্দ্র
গার্গী বললেন - তাহলে ইন্দ্রের উপাদান কী?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - তাঁর একক প্রজাপতি
গার্গী বললেন - প্রজাপতির একক কী?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - পরম ব্রহ্ম।
গার্গী বললেন - তবে এই পরম ব্রহ্মের একক কী!  আমার বলুন!
যাজ্ঞবল্ক্য হোঁচট খেলেন। না, এ তো তাঁর জানা নেই। কিন্তু এক নারীর কাছে পরাজয়৷ হা হা হা!  এটা তো পুরুষত্বে বাঁধে। পরিয়ারী পাখির মতো, যাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে বলে মনে হয়েছিল, সে কিনা আকাশচুম্বী প্রশ্নে আঘাত করলো যাজ্ঞবল্ক্য কে। না!  না! এটা হতে পারে না!  অস্ত্র সংবরণ করলে তো চলবে না৷ ঘর্মাক্ত দেহ যেন পাতা ছিঁড়ে রক্তাক্ত অবয়ব কেঁদে উঠল যন্ত্রণায়। যাজ্ঞবল্ক্য বলে উঠলেন," দেবতাদের  ব্যাপারে অতি প্রশ করো না গার্গী। দেবতাদের বিষয়ে বেশি প্রশ্ন করা অনুচিত।
পতনের মুখে ভয় দেখানো অবিবেকের যুক্তি ছাড়া আছেই বা কি ব্রাহ্মণের। শুধু ভয় দেখিয়ে পরিপাটি শব্দে বেঁধে দাও। বেদকে অতিক্রম করে যাবে, ঋষিশ্রেষ্ঠের কাছে, এ আবার হয় নাকি! নারী বলে কথা ; দৈব শাপে মুণ্ডু কেটে যাবে অবলিলায়। স্তব্ধ হও!  মৌন হও!  এটাই তো মুহুর্তের খাদানের ধস। কথা বললে হয়!! 
" গার্গি মাতিপ্রাক্ষীর্মা তে মূর্ধা ব্যাপপ্তদনতিপ্রশ্ন্যাং
বৈ দেবতামতিপুচ্ছসি গার্গি মাতিপ্রাক্ষীরিতি।। "
বুঝে গেলেন গার্গী। এখানে তো অপমান করতে আসেন নি, শুধু এইটুকু প্রমাণ করতে এসেছিলেন, আরে!  নারীও জ্ঞানী হতে পারে৷ তাই চুপ করলেন গার্গী। নিশ্চিন্তের ছাপ এলো  যাজ্ঞবল্ক্যের মুখে। এরপরই উদ্দালক এলেন। তাঁদের প্রশ্ন পর্ব চলছে কিন্তু গার্গীর এমন ভাবে তর্ক সভা থেকে বিদায় নিতে ইচ্ছা করলো না৷ বললেন " দ্বৌ প্রশ্নৌ প্রক্ষ্যামি তৌ চেন্মে বক্ষ্যতি, ন জাতু যুষ্মাকং কশ্চিদ ব্রহ্মোদ্যং জেতেতি ", এরপরই নাকি যাজ্ঞবল্ক্যকে ব্রহ্মবিদ হিসাবে মেনে নিতে হবে৷ যাজ্ঞবল্ক্য ভাবলেন, অভিশাপের ভয়ে অবলা নারী চুপ হয়ে গেছে। অতর্কিতে গার্গী বলে উঠলেন," দ্যুলোক ও ভূলোকের মধ্যে, যা অতীত, যা বর্তমান, যা ভবিষ্যৎরূপে বিদ্যমান, "তার উপকরণ কী "। যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, "আকাশ" ; এই আকাশ জুড়ে আছে কোন উপকরণ?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, " যাঁকে কেউ দেখতে পান না, কিন্তু তিনি সব কিছু দেখতে পান, যাঁকে কেউ শুনতে পান না, কিন্তু তিনি সবই শুনতে পান, যাঁকে কেউ জানতে পারেন না কিন্তু তিনি সবই জানতে পারেন, সেই অক্ষয়ই আকাশের ভিত্তি, আর এই অক্ষয়ই হল পরম ব্রহ্ম। যার কোনো বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ, অবয়ব নেই, তিনি চির শাশ্বত। দীর্ঘ তপস্যার  পরেও যদি সেই পরম ব্রহ্মকে উপলব্ধি না করা যায়, তাহলে সেই তপস্যা বৃথা। এখানেই জ্ঞানের শেষ। "

এবার হাসির পালা গার্গীর। কথার ফাঁদে জড়িয়ে গেলেন যাজ্ঞবল্ক্য। যে ব্রহ্মার কথা নিয়ে অভিসম্পাতের ভয় দেখিয়ে চুপ করালেন গার্গীকে, সেই ব্রহ্মার স্বরূপকে নিজেই উদঘাটন করলেন।  বুঝিয়ে দিলেন কোনো অভিসম্পাত তাঁকে বিব্রত করেনি, সে বিতর্কের ঝড় তুলতে পেরেছে। কেবল সম্মান করেন তাই চুপ করে গেলেন। এটা তাঁর কমজোরি নয়। জিতিয়ে দিলেন যাজ্ঞবল্ক্যকে। সহ্য হলো না যাজ্ঞবল্ক্যের।  নারী কিনা তাঁকে জিতিয়ে দিলো গৌরবে, যাজ্ঞবল্ক্য আর রাজার দান নিলেন না।

সে যুগে অনেক ব্রহ্মবাদিনী ছিলেন। তাঁরা সমতালে সভায় তর্ক করতে পারতেন। খ্রীস্টের ৭০০ বছর আগে জ্ঞান সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন এই আজীবন অবিবাহিতা নারী। বেদের বহু শ্লোক তাঁরই রচনা৷ ইতিহাস হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই নীরব;  নারীর প্রগলভতা দেখেই যাজ্ঞবল্ক্য নিজেই ভয়ে বলেছিলেন "স্তব্ধ হন"। ইতিহাস বলছে বৈদিক যুগ যত এগিয়েছে নারীরা স্তব্ধ হয়েছে৷ পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীরা এগিয়েছে কিন্তু অনেকটাই পরিসর আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়৷

চাকা ঘুরছে ; সময়ের পতন আর স্থিমিত নেই। খনা তো রীতিমতো বলি। স্বামী মিহির খনার নিজেই জিভ কেটে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করেছেন। আজও আছেন একালের খনা, গার্গীরা। কিন্তু অপেক্ষার জীবনগাথার আজও কাঁদে চোখের আড়ালে। স্তব্ধ করেছে যাজ্ঞবল্ক্য অনেককেই। অন্তর্জলি যাত্রায় মহাপ্রস্থানে সময় বলে যায়,  আজও আছেন সমকক্ষে গার্গী, খনারা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours