আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

বাঙালি জীবনে বারো মাসে তেরো পার্বণ এর মতই সিংহভাগ জুড়ে আছে পেটপুজো। খাওয়া-দাওয়া সে সাবেকী হোক বা আধুনিক, রসনা তৃপ্তির জন্য বাঙালি কোন কিছুরই তোয়াক্কা করে না।  এই পেট পুজোর মধ্যে কোন শৃঙ্খলা নেই, নেই কোন নিয়ম। রসনা তৃপ্ত হলে  মনে আসে অনাবিল আনন্দ যা চলে আসছে বংশপরম্পরায়। তাই বাঙালির ভুরিভোজের অজুহাত ও তালিকারও শেষ নেই। প্যারোডির ইতিহাস এর ব্যতিক্রম নয়, বাঙালির খাদ্য প্রীতি উঠে এসেছে বিভিন্ন প্যারোডির ছত্রে ছত্রে:-
ছন্দ সম্রাট সুকুমার রায় যখন রবি ঠাকুরের "মেঘ বলেছে যাব যাব" অনুসরণে লেখেন:-

কেউ বলেছে খাবো খাবো
কেউ বলেছে খাই
সবাই মিলে গোল তুলেছে
আমি তো আর নাই।
ছোটকু বলে "রইনু চুপে
ক'মাস ধরে কাহিল রূপে"
জংলি বলে "রাম ছাগলের
মাংস খেতে চাই।"
যতই বলি 'সবুর করো' কেউ শোনে না কালা
জীবন বলে কোমর বেঁধে "কোথায় লুচির থালা?"

তখন  সুরভিত লালায়িত লুচি- মাংসের‌ চিত্র সবারই চোখের সামনে এসে পড়ে।

উদর তৃপ্তির এই মায়া মোহ জাল বোধ করি কেউই কাটিয়ে উঠতে পারেননি ,স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখলেন:-

এত বড় রঙ্গ জাদু এত বড় রঙ্গ,
চার মিঠে দেখাতে পারো যাব তোমার সঙ্গ
বরফি মিঠে জিলাবি মিঠে মিঠে শোন পাপড়ি
তাহার অধিক মিঠে কন্যা কোমল হাতের চাপড়ি। 
(গোবিন্দ চন্দ্র অধিকারীর শুক সারি সংবাদ অনুসরন)

রবীন্দ্রনাথ পিঠে পুলি খেতে ভালোবাসতেন। এক ভদ্রমহিলা শান্তি নিকেতনে একদিন গুরুদেবকে পিঠে বানিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। কদিন পর সেদিনের পিঠে কেমন হয়েছিল  কবিকে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
কাক কালোর লোকবৃত্ত ছড়ার অনুসরণে রবি ঠাকুর প্যারোডি করে উত্তর দিয়েছিলেন:-

"লোহা কঠিন, পাথর কঠিন, আর কঠিন ইস্টক
তার অধিক কঠিন কন্যে তোমার হাতের পিষ্টক"।
পূজো পার্বণ বিবাহ ও অন্যান্য উৎসব ছাড়াও উপবাস ভঙ্গেও ভোজন রসিক বাঙালি আয়োজনের কসুর করে না। তাই  প্রচলিত কীর্তনের অনুসরণে নজরুল ইসলাম লিখলেন:--

আমার হরিনামে রুচি কারণ পরিনামে 'লুচি'
আমি ভোজনের লাগি করি ভজন
আমি মালপোর তল্পি বাঁধিয়া
এ কল্পলোকে এসেছি মন।
'রাধাবল্লভী'র লোভে পূজি রাধাবল্লভে
রসগোল্লার লাগি আমি রাস মোচ্ছবে।
অথবা মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের অনুকরণে ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখলেন মজা করে:--

অম্বলে সম্বরা যবে দিলা শম্ভু মালি
ওড্র কুলোদ্ভব মহামতি, বঙ্গ ধামে
নিম্বসিম্বি গ্রামে, মধ্যাহ্ন সময়ে আহা!
তিন্তিড়ী পলান্ডু লংকা সঙ্গে সযতনে
উচ্ছে আর ইক্ষুগুড় করি বিড়ম্বিত
অপূর্ব ব্যঞ্জন, মরি, রান্ধিয়া সুমতি
প্রপঞ্চ ফোড়ন দিলা মহা আড়ম্বরে
আম্বা করি পূনঃ ঢালিলা জাম্বাটি ভরি।

কিন্তু খেতে এসে যদি খাওয়া বাতিল হয় , সে যে স্বপ্নভঙ্গের থেকেও বেশি যন্ত্রণার।   কালিদাস রায় ওরফে বেতাল ভট্ট রজনীকান্ত সেনের বিখ্যাত গান "কেন বঞ্চিত হব চরণে" অনুকরনে লিখলেন প্যারোডি :-

কেন বঞ্চিত হব ভোজনে?
মোরা কত আশা করে নিজ বাসা ছেড়ে
খেতে এসেছি এখানে ক'জনে।
ওগো তাই যদি নাহি হবে গো,
এত কি গরজ তোমার বাড়িতে ছুটিয়া এসেছি কবে গো!
হয়ে ক্ষুধার জ্বালায় অন্ধ
এসে দেখিব কি খাওয়া বন্ধ?
তবে তাড়াতাড়ি 'পাত কর'বলে ডাক
তব আত্মীয়-স্বজনে।

আবার মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কবিতার অনুসরণে লিখলেন:--

সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন যেন আমি ভালো হয়ে চলি। যাহা পাই তাহা খাই সোনামুখ করি
মা'র দেওয়া খাবারের দোষ নাহি ধরি
বলিব না এটা কই ওটাই বা কই
কোথা চপ কাটলেট কোথা দুধ দই?
ডাল রুটি খাব না মা বলি নাকো যেন
ঝোলে শুধু কাঁচকলা মাছ নাই কেন?

আবার গলাধঃকরনের‌ এই উদ্দাম হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে রসজ্ঞ সরিৎ শেখর মজুমদার লিখলেন:-
"পেট বলেছে খাবো খাবো
হাত বলেছে খাই।" (রবি ঠাকুরের 'মেঘ বলেছে যাব যাব 'অনুসরণে)।

তাই বর্ষার দিন তাকে লেখাতে বাধ্য করে

এমন দিনে তেলে ভাজা খায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়
মাসের শেষ ঘরে পকেট ঝরঝরে
কপর্দকহীন তমসায়।
ধারেতে আহা যদি পাওয়া যায়।(রবীন্দ্রনাথের কবিতা তথা গান "এমন দিনে তারে বলা যায়"অনুসরণে।)

কিংবা

তুমি যে ক্ষুধার আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে
সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে সবখানে
যতসব চিকেন মটন থালে থালে
নাচের সব নিমন্ত্রিতের গালে গালে
খিদেতে হাই তুলি, চাই তাদের পানে।
(রবীন্দ্রনাথের "তুমি যে সুরের আগুন" গান অনুসরণে) 

এছাড়াও
ছাদা বেঁধে দিল রন্ধন পটু নন্দী।
ভিক্ষা ভোজন , ফোকটে খাওয়াই ফন্দি!
আঁশ নিরামিষ দুইয়েরই দালাল
রসনা ছড়ায় কষ বেয়ে লাল । (রবীন্দ্রনাথের 'পথের বাঁধন' কবিতা অনুসরণে) ইত্যাদি। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours