নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেট, অস্ট্রেলিয়া:

প্রতিটি কবির কবিতা ভাবনা কি এক? না মোটেও না, প্রতিটি কবির কবিতা ভাবনা ভিন্ন হতে পারে। কবিতা কি এবং কেন? কাব‍্য আলোচনাকে সংগৃহীত লেখা কোট করে আলোকপাত করা যাক। 
"কবিতা আসলে কি? কবিতার উৎস মূল কোথায়? কবিতা ভাবনা কি আমার দৈনন্দিন জীবনযাপনের অভিজ্ঞতালব্ধ থেকে আলাদা কিছু, তা কি জীবন থেকে আলাদা? কারণ যে সৃষ্টিতে আনন্দ আছে, তৃপ্তি আছে, আছে পারিপার্শ্বিকতা। ভাবনাকে এমনই ভাবি বাংলা কবিতা ভাবনা শুরু সেই চর্যাপদ থেকে! কেউ কেউ বলেছেন -“কবিতা তিনটি ধ্বনির সমষ্টি একটি শব্দ মাত্র। যার ভেতর থাকে উম্মাদনা-উত্তেজনা-ভাবনা-সাধনা।” আবার এটাও বলা যেতে পারে লক্ষ্য-অনুভব-অনুভূতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। লেখার আগের অনুভূতি, লেখার ভেতরের অনুভূতি, লেখার পরের অনুভূতি নিয়ে যে শব্দের মালা গাঁথা হয়, সেই অমোঘ সৃষ্টিই তো কবিতা“! কবিদের প্রত্যেকের কবিতার সঙ্গে একটা করে কবিতা ভাবনা আছে। চলুন পড়া যাক বরেণ্য কবিদের কবিতা ভাবনাগুলো খুব অল্প কথায় । কবিতা লিখতে হলে কি করতে হয়? এমন সব প্রশ্নের উত্তরে অনেক বাঘা বাঘা কবি উত্তর বলেছেন অনেক কিছু। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন -“প্রেমে পড়ো, পড়ে ব্যর্থ হও, সেই ব্যর্থতা আর বেদনার থেকে সৃষ্টি হতে পারে কবিতার। অনেকেই বলে থাকেন কবিতার উৎস মুলে আছে বেদনা বোধ। বেদনা বোধই জন্ম দেয় কবিতার। 

ইংরেজ কবি কিটস- শেলি- মিলটন তাদের প্রেয়সীর বিরহে লিখেছেন অনেক কবিতা।  
নজরুলও লিখেছেন, কালিদাস মেঘদুত লিখেছিলেন, প্রিয়া বিরহের বেদনা থেকেই কথিত আছে বাল্মিকি ক্রোঞ্চমিথুন বিয়োগজনিত শোকই শ্লোক রূপে উৎসারিত হয়েছিল । কেউ কেউ মনে করেন কবিতার জন্ম জঠর হচ্ছে কল্পনা ও সাধনা। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরতো বলেই ফেলেছেন কবিতা কল্পনা লতা, সাধনার ধন। এ প্রসঙ্গে কন্সিনোস আসেন্সের কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেভিলে, কিন্তু থাকতেন মাদ্রিদে। সমুদ্র নিয়ে তিনি একটি অনুপম কবিতা লিখেছিলেন। এ জন্য বোর্হেস তাকে অভিনন্দন জানালে তিনি বলেন হ্যাঁ সমুদ্র নিয়ে কবিতাটি সুন্দরই। কোন একদিন হয়তো সমুদ্র দেখার সৌভাগ্য হবে। তিনি আসলে কখনো সমুদ্র দেখেননি। "
অর্থাৎ কবিতাটি কাল্পনিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও বলেছেন -“লেখা পড়ে যেমন ভাবো, লেখক তেমন নয় গো।“


কবিতার উৎস মুলে রয়েছে সৌন্দর্য। অনেকে আবার এ ধারনাও করেন। ফুল, পাখি, নদী, চাঁদ, ঝর্ণা ও প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং রমণীর রূপ লাবণ্য মণ্ডিত শরীর- বক্ষ, কেশ, আঁখি, মুখাবয়ব ভাবুক মনকে নাড়া দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিচ্ছে বারবার। 

যুগের পরিবর্তনে কবিতার ধরণ ও কাঠামো বা গঠনের ক্ষেত্রেও ঘটছে ব্যাপক পরিবর্তন। আধুনিক গীতি কবিতা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইদানিং আধুনিকতার পোস্ট মডার্নিজমকে কেন্দ্র করে কবিতার বক্তব্য বিচারবস্তুতে এসেছে নানা রকম পরিবর্তন। দিনে দিনে কবিতা হয়ে উঠছে একটি শক্তিশালী শিল্প মাধ্যম।"

কাদিকাম বলেছেন -“নব্বই মিনিটের একটি চলচ্চিত্র যা প্রকাশ করতে না পারে, তিন মিনিটের একটি ট্যাংগো (দক্ষিণ আমেরিকার নৃত্য) কবিতা তা সফল ভাবে উপস্থাপন করতে পারে।     
“বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী, যেতে নাহি দেবো, নিরঝরের স্বপ্নভঙ্গ, নজরুলের বিদ্রোহী, জসীমউদ্দিনের কবর, জীবনানন্দের বনলতা সেন, আট বছর আগের একদিন, মীর্জা গালিব কিংবা হাফিজের অসংখ্য ফার্সি ও আরবী কবিতা, কাদিকামর উক্তির সার্থকতা প্রমাণ করে। জাপানি হাইকু উর্দু শের ইংরেজি অনেক কবিতা।"

পোলিশ কবি শিম্বরস্কা এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্নকারীকে বলেছিলেন -“একজন চিত্রশিল্পীকে আমি এই প্রশ্ন করতে পারিনা যে কেন তিনি এভাবে আঁকেন আর কেনই বা অন্যভাবে নয়। একজন সুরকারের কাছে আমি জানতে চাইতে পারিনা কিভাবে হঠাৎ করে জীবনে সংগীত আসে । আমি জানি তারা আসলেই এটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। আমিও পারিনা। এই নিয়েই আমি হয়তো জন্মেছি। তবে এই নিয়ে পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে কবিতা সৃষ্টি সম্ভব। 
বিশেষ মূহুর্তে বা পরিস্থিতি হতে পারে কবিতার উৎস বিন্দু। 

মধুসূদন দত্তের কথা যদি আমরা বলি। একবার তাকে টেনে নিল বিদেশী ভাষা। ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এলেন মাতৃভাষার কোলে। উপহার দিলেন কালজয়ী কাব্য সম্ভার । নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা, সুকান্তের কবিতার জন্মও বিশেষ মুহূর্তেও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে। তবুও তা কালোত্তীর্ণ। এ প্রসঙ্গে রুশ কবি ভজনেসেন্সকীর কবিতার সৃষ্টি রহস্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন যে কখনোই কলম দিয়ে কবিতা লিখি না। আমি রাস্তায় হেঁটে বেড়াই, তবে বনেই হাঁটতে পছন্দ করি বেশী। এবং যদি ঘণ্টা দুই একের মতো হাঁটি, তিনটি কবিতা পেয়ে যাই। একটা দীর্ঘ কবিতা আমার আয়ত্তে চলে আসে। অনেকের ধারণা নির্জনতার পথ ধরেই আত্মপ্রকাশ ঘটে কবিতার। 

কবিতা ভাবনাকে সারাজীবন এভাবেই ভেবেছেন কেউ “যা এখনও অদৃশ্য থেকে গেল, এখনও উপলব্দি করিনি, যা এখনও লেখা হয়নি, ভাবিনি, স্পর্শ করিনি, স্মৃতিপটে হাঁটেনি, জলপথে নামেনি, আকাশপথে উড়েনি, ঘুমের মধ্যে জাগেনি, কাজের ফাঁকে পালায়নি তাই হতে পারে কবিতা ভাবনা”। 

একজন কবির অনুভূতি যে মুহুর্তে সৃষ্টি হবে 
সেই মুহুর্তেই একজন সাধারণ কাব্যযশ প্রার্থী 
কবিতে রূপান্তরিত হবে।

আংশিক তথ্যসূত্র: ফেসবুক। 

(ছবিতে প্রিয় কবি উৎপল কুমার বসুর সঙ্গে লেখক কবি স্বয়ং)
[ফটো কারিগর- ডা: আবু আলী মর্তুজা রাসেল।]



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours