প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

সত্য সুন্দরের নেশায় ইতিহাস ছুঁয়েছিল নারীদেহ, নাম - মুহম্মদি খানুম।তিনি ১৮২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সাধারণের খেলাঘরে ব্রাত্য নারী, একটু বড়ো হতেই বিক্রি হয়ে যায়। ক্রেতা যে হারেমের ঘোর অন্ধকারে নরক দেবে এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না৷ মানুষের বিচিত্র কামনা পূর্তির এক লেলিহান শিখায় এতো দেহ ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এমন মুহম্মাদি কতো গেলো এলো নবাবের শয্যায়, কে খবর রাখে তাঁর। মনের ভার কাঁধে নিয়েই বয়ে চলা জীবনে মুহম্মদি খানুম হয়তো ভেবেছিল এমন করেই নবাবের শয্যাসঙ্গিনী হয়েই কাটিয়ে দিতে হবে জীবন। কিন্তু ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলো জীবনে। দীর্ঘায়িত ফিরতি পথে আর দুঃখ নয়, দেহসুখ আসুক, কিন্তু পরিচিতি পাক খানুম। নবাব নিকা করলেন খানুমকে, নাম দিলেন আদুরে গাল ভরা প্রেমে "ম্যহক পরী"। শরীরের সুগন্ধে মাতালেন ওয়াজিদ আলি শাহকে, সুন্দরী পরী।কুঁড়ি সমেত ফুলে ভ্রমরের দেহ লুটোপুটি খাবে এ কি আর বলতে হয়!!  কিন্তু এই যে উপাধিপ্রাপ্তি, এমন কি ইতিহাসে নজির আছে!! আছে তো নূজাহানকে৷ বর্ধমানের জায়গিরদার শের আফগানের পত্নী মেহেরউন্নিসাকে লুঠ করে দিল্লি নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন মুঘল বাদশা জাহাঙ্গীর। সেদিন থেকে নাম বদল হয়ে গেলো " নূর - ই- মহল"।কিন্তু প্রাসাদের আলো মানে তো সহজ সংক্ষিপ্ত সীমা, তাই বিশ্ব আলোকে নাম হলো, "নূর - ই- জাহান"।

খানুমের ম্যহক পরী নাম, এবার আর টিকে রইল না। যোনিতে বংশ এলো বিরজিশ কাদের৷ ফুলেল হাসিতে পরিবর্তনের ঝড় এলো খানুমের বুকে, নাম " হজরতমহল। ইতিহাস মনে করতে পারে নি নবাবের প্রথম স্ত্রীর নাম, স্মরণীয় হলেন হজরতমহল। সুখ কেড়ে স্বপ্নে এঁকে দিলেন ১৮৫৭ এর সিপাহী বিদ্রোহের বুকে৷ শেষপর্যন্ত এঁটে উঠতে পারেননি, কিন্তু ভুললে হবে কি করে যে, তাঁরই সহায়তায় মুক্ত করেছিলেন তামাম লক্ষ্মৌ।

ইতিহাস বলছে তখন যথেচ্ছাচারে চলছে মন্দির ভাঙ্গার পালা। ১৮৫৬ সালে নবাব ওয়াজিদ আলি কলকাতায় নির্বাসিত হলেন। লিখলেন কবিতা, যেন অশ্রু অনুভব ছুঁয়ে গেলো শব্দে। গাইলেন সায়েরি, যা আজও অমর হয়ে আছে৷ ডালহৌসি তাঁকে অধঃচ্যুত করেও শান্তি পেলো না। নিলাম হলো নবাবের সমস্ত সম্পদ৷ নিলামে বিক্রি হলো ৭০০ পশু, ২০০ হাতি, ২০০০ ঘোড়া, ২০০০০০ দুর্লভ জাতের পায়রা, ১০৭ টি উট, সমসংখ্যক সিংহ। শুধু এখানেই স্পর্ধার সীমারেখা ক্ষান্ত হয় নি,  ইংরেজ সৈন্যদের অভ্যাসে পরিণত হলো নবাব সহ আত্মীয় দের বাড়ীতে ঢুকে লুঠপাট।
একে একে দখল হলো ছত্তরমহল, খুরশিদমহল, কাইজারবাগ। গৃহহারা হলো আশ্রিতরা। সেখানে ৩২নং রেজিমেন্টে বসবাসের জায়গা। সেই বছরই ২১ শে মার্চ ইংরেজদের হুকুম অমান্য দিবস হিসাবে চিহ্নিত হলো৷ মানুষ ক্ষুব্ধ হলে একই দিনে হোলি ও নওরোজ উৎসব বন্ধ হয়৷ কিন্তু আঁধার নিয়ে যারা খেলে তাদের আর চেতনা আসে কৈ!!  কবি মীর তকির বাসভবন মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হলো। রেললাইন এলো ; মহম্মদের পদচিহ্ন ধরে রাখার স্থানটি বারুদের গুদামে পরিণত হলো। নবাবের তিন লক্ষ বই মার্টিন কোঠিতে চলে গেলো। তালুকদারদের ৫৭৪ টি প্রাসাদ দখল করা হলো। এরপর সিপাহী বিদ্রোহে টোটা দাঁতে নিতেই বিদ্রেহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। মিরাটের আগুনে অওধের বিদ্রোহের ফুল ফোটাতে চাইলেন নানা সাহেব৷

বেগম এবার বিরজিশকে সিংহাসন দিলেন। নানাসাহেব এবার ম্যহক পরীকে চিনলেন। নবাব ওয়াজিদ আলি শা ততোদিনে অওধ ছেড়ে দিয়েছেন। বেগম এবার প্রতিজ্ঞা করলেন লড়াই করে অওধ থেকে ইংরেজদের অধীনতা থেকে সারা হিন্দুস্থান কে মুক্ত করবেন তিনি। নারীবাহিনী তৈরি হলো আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল, উদাদেবী। এলেন সরাফদৌল্লা, মহারাজা বালকৃষ্ণ,  রাজা জয়লাল, মামন খানেদের মতো বীরেরা। অবরুদ্ধ হলো রেসিডেন্সি। শপথ একজন ইংরেজও জানো বেঁচে না থাকে৷ ইংরেজ প্রস্তাব দিলো "আপনি আওধ ছেড়ে দিন। কোম্পানি আপনাকে আজীবন মাসোহারা দেবে "।  বেগম ঘৃণ্য ভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। পরীর সঙ্গে যোগ হলো যুদ্ধবেশ। ফৈজাবাদের মৌলভীরে সাথে যুক্ত হয়ে চলল সাহাজানপুর আক্রমণ ও দখল।

এবার সময় এলো ; ১৮৫৮ সালে ইংরেজরা কচু কাটা করে কেটে ফেলল হাজারো প্রাণ। কিন্তু বেগম কই।!  সিপাহী বিদ্রোহ তো সফল হয় নি। বেগম পালিয়ে গেলেন কাঠমান্ডুতে ।  না, আপশোস নেই জীবন আলেখ্যে৷ আর তো অওধ পুনর্দখল সম্ভব নয়। কিন্ত নেপালের রাণাদের প্রধানমন্ত্রী জঙ্গবাহাদুর চাইলেন না বেগম থাকুন৷ শুধু নিজের ব্যক্তিত্বে বশীভূত করেন জঙ্গবাহাদুরকে।  বেগম নিজের নামে টাকা থাপালেন৷সেই টাকায় চলতে থাকে নেপাল; তৈরি হয় ইমামবারা। ১৮৭৯ সালের ৭ ই এপ্রিল অবশেষে হজরতমহল মারা যায়। কাঠমান্ডু ঘুরে এসে " দ্য মিলি গেজেট"  পত্রিকার সাংবাদিক কাজিম রিজভি লিখেছেন, এই মজরতমহলটির কবরটি খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হয়৷ তবে অনেক কষ্টের পর কবরটি খুঁজে পেতেই ইতিহাসের স্তূপীকৃত কবরটির গায়ে লেখাটি মানুষকে স্তম্ভিত করে, " এ্যয় বেদ - এ - শাবা আহিস্তা চল / ইঁহা শোয়ি হুই হ্যায় ম্যহক পরী। বর্তমানে নেপালের ভয়ংকর ভূমিকম্পে কবরটি ধূলিস্মাৎ হলেও আজও বাতাসে ভাসে..." বাতাস তুমি ধীরে বইতে থাকো / এখানে সুগন্ধী পরী রয়েছে তন্দ্রায়৷ "

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours