চন্দন ভৌমিক, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

বাঙালি হচ্ছে খাদ্য রসিক..সারা পৃথিবীতে বাঙালিদের মতো খাদ্য রসিক আর পাওয়া যাবে না ..তাদের মধ্যে আমি একজন..পেটুক বলে বেশ নাম ডাক আছে..কিন্তু অদৃষ্টের কি অদ্ভুত  পরিহাস..সেদিন একটা ফ্রি হেলথ চেক আপ ক্যাম্প হচ্ছিলো.. কি মনে করে ঢুকে পড়েছিলাম ওখানে..হেলথ চেক আপ করাবার পর সুগার, প্রেসার ধরা পড়লো..বাস হয়ে গেলো..গিন্নির কড়া নির্দেশ বাংলা মেনুর ভালো ভালো স্বাদ নেওয়া বন্ধ..মানব জীবনের সবচেয়ে বড় কথা..রসগোল্লা,পান্তুয়া, জিলাপি, বোঁদে সাথে লুচি,খাসির মাংস, সব বন্ধ ..আর আমার সাথে লুচির প্রেম সেই শৈশব থেকে..প্রথমে মায়ের হাতের লুচি..তারপ পাড়ার কাকিমাদের হাতের..তারপর বোনের হাতে..তা ছাড়া আর কত হাতের যে লুচি খেয়েছি তা আর বলে শেষ করা যাবে না .. লুচি দু অক্ষর এর ছোট্ট একটা নাম..নামটা শুনলেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা হয়..আহা সাদা প্লেট এর উপরে সাদা সাদা ফুলকো লুচি আর পাশে হলুদ রং এর ছোলার ডাল আর পাশে ধবধোবে দুটো রসগোল্লা ...স্বয়ং রামকৃষ্ণ দেব গিরিশ ঘোষকে বলেছিলেন.."অমন ফুলকো ফুলকো লুচি গুলো খেতে দিলি নে".. আর লুচির যে কি মাহাত্ত্ব সেটা যারা লুচি খায় না তারা বুঝবে না..আপনারা বলতেই পারেন লুচি আবার কে খায় না..সবাই তো লুচি খায়..আমি বলবো না..কারণ রবিবার সকাল বাদে যে লুচি খাই আমি সেটা কে লুচি বলি না...ওটা কে আমি পুরি বলি..যেকোনো অবাঙালি দোকানে যাবেন..জিজ্ঞাসা করবে..কি আছে খাবার..বলবে পুরি..আর রবিবারে সকালে বাড়ির বৌকে জিজ্ঞাস করবেন..আজ সকালে টিফিন কি হবে..উত্তর পাবেন লুচি...
লুচি কিন্তু সবাই খেতে পারে না ..লুচি খাওয়ার একটা পদ্ধতি আছে...লুচি হচ্ছে ভীষণ লাজুক, নরম..ঠিক যেন আপনার যৌবনের লাজুক প্রেমিক, ঠিক যেন আপনার সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া সন্তান.. মুঠো করে ধরে কোনোদিন লুচি খাবেন না..যখন তখন লুচি খাবেন না..যদি খান তাহলে আপনি লুচির প্রেমিক নন..লুচি খাওয়ার শুভদিন..আপনার ছুটির রবিবারের সকাল.. তাই বলে রবিবার সকাল ১১ টার সময় লুচি খাবেন নাকি? ..না কখনোই না...লুচি প্রেমীদের মতে লুচি খাবার শুভক্ষণ রবিবার সকাল আটটা ত্রিশ মিনিট থেকে সকাল নয়টা ত্রিশ মিনিট এর মধ্যে...কারণ এর পর হলে দুপুরের খাসির মাংসের সাথে ক্ল্যাশ হতে পারে...তখন তো আবার আপনারা লুচির নামে বদনাম করবেন...আর লুচির বদনাম আমি একদম সহ্য করবো না... তা এবার লুচি খাবার আগে লুচি খাবার জন্য আপনাকে তৈরী হতে হবে..পুজো করতে বসার আগে আপনি যেমন স্নানটান করেন আর কি..রবিবার সকাল বেলায় একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠুন..সকাল ৭টা নাগাদ..ভালো করে ব্রাশ করে নিন..বাসি মুখে ভুলেও লুচি খাবেন না.. তারপর নিজের বড় বাগান টাগান থাকলে বাগানে চলে যান..আর না থাকলে ঘরের মধ্যে পায়চারি করুন...দেখতে দেখতে ৮ টা ১৫ - ২০ বেজেই যাবে..ঠিক তখনই আপনি শুনতে পাবেন রান্না ঘর থেকে লুচি ভাজার আওয়াজ..আপনার প্রেমিকার গন্ধ..মনটা আপনার আনচান করে উঠবে..এ তো হলো.. এবার খাবেন কি দিয়ে ? এটা নিয়ে নানা মুনির নানা মত..কেউ বলে ছোলার ডাল...কেউ বলে আলুরদম...আবার কেউ বলে না না বেগুন ভাজা..আমার মতে ছোলার ডাল..একটু মিষ্টি মিষ্টি হবে..নারকোল তো অবশই থাকা চাই..সাথে দুটো মিষ্টি সেটা রসগোল্লা হোক বা পান্তুয়া..আর যাই যা কিছু হয়ে যাক লুচির সাথে ওমলেট কখনোই নয়..এটা জামিন অযোগ্য অপরাধ ..লুচি খাবেন কি করে.. আসলে লুচি খুব লাজুক নরম..কখনোই লুচি মুঠো করে একসাথে মুখে পুড়ে দেবেন না আর কখনোই একসাথে লুচি ভেজে রেখে খাবেন না..রবিবার বাজার যাবার আগে পায়জামা আর পাঞ্জাবিটা পরে নিন...ঘড়ির দিকে চোখ রাখুন..চেয়ার এ বসে  টিভিটা চালান...চোখ টিভির দিকে রাখুন আর কান আর মনটাকে রান্নাঘরের দিকে..কিছুক্ষন পরে দেখবেন আপনার গিন্নি সাদা একটা প্লেটে চার পিস লুচি আর ছোলার ডাল এনে আপনাকে দেবে...এইবারে শুরু হবে আপনার লুচির সাথে প্রেমপর্ব.. প্লেটটা হাতে নিয়ে যে কোনো ছুতোয় চলে যান রান্না ঘরে বৌয়ের পাশে। দাঁড়িয়ে পড়ুন আর বৌয়ের সাথে গল্প শুরু করুন। তাহলে দু চার পিস এক্সট্রা পেতে পারেন...এটি মধ্যে শুরু হয়ে গেছে আপনার সাথে লুচির প্রেম পর্ব ...প্রথমে আপনি খুঁজে বার করুন সব থেকে ফোলা লুচিটাকে...তারপরে আপনার তর্জনীর আলতো টোকায় উপরের পাতলা চামড়াটা ফুটো করে দিন, না না না , মুখ টা সরিয়ে নেবেন না, পুরো ধোঁয়াটা নিজের মুখে মাখিয়ে নিন...ঠিক যেমন আপনার প্রেমিকার গায়ের সুগন্ধ নেন ...খাবার সময় মনে রাখবেন আপনি কিন্তু লুচি খাচ্ছেন, পুরী নয়, সুতরাং একবারে গোটা লুচিটা তরকারিতে মাখিয়ে খাবেন না, এতে লুচির অপমান করা হয়...ছোট্ট ছোট্ট টুকরো করে ডাল বা তরকারি মাখিয়ে মুখে চালান করে দিন...দাঁতের কামড় লুচির উপর যেন বেশি না পরে , সেই খেয়াল টাও কিন্তু রাখতে হবে, দাঁত ব্যবহার  হবে শুধু মাত্র তরকারির জন্যে...যাইহোক আপনি যদি ছটা লুচি খেয়ে ফেলেছেন , তো বেশ করেছেন, তবে আর না , মনে রাখবেন দুফুরে ক্ল্যাশ হতে পারে...এখানেই আপনার লুচি খাওয়া শেষ নয় ...আপনি ওই যে পাতলা চামড়া গুলো ভাঙলেন, ওই গুঁড়ো গুলো কি করবেন....সেটা ও আপনাকে জানতে হবে...না হলে পাড়ার বেহারীর দোকানে পুরি খান গিয়ে...জেনে নিন কি করবেন...লুচির গুঁড়ো গুলো একজায়গায় করুন...মিষ্টির রসের মধ্যে ফেলে দিন..চেটে পুটে খেয়ে নিন...আপনার লুচির সাথে প্রেম পর্ব শেষ ...বেসিনের দিকে যেতে যেতে বেশ জমিদারি কণ্ঠে গিন্নিকে বলুন..." গিন্নি আমি বাজার চললুম "। গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ুন মাংসের দোকানে লাইনে... একটা কথা সব সময় মনে রাখবেন..লুচি খাবেন ময়দা দিয়ে..আটা দিয়ে কখনোই নয়..

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours