কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ভূত হলে ভগবান কেন নয় ?
এ কেমনতরো একচোখামি যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্কদের ?
ভূতকে ফাঁসিকাঠে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। অভিযোগ ভূত অলৌকিক। কুসংস্কার। তাহলে ভগবান কী? লৌকিক আর সংস্কার। কোন যুক্তিতে?
ভগবান দেবতা হয়ে গৃহস্থের ভদ্রাসনে ঢুকে পড়েছেন। তাই লৌকিক। আর ভূত শেওড়া গাছে দোল খায় বলে অলৌকিক। গৃহস্থের বাড়িতে, পাড়ায়, এমনকি গলি মহল্লাতেও ভূতের প্রবেশানিষেধ। তাহলে শনিদেব মহাদেব ? এমন আরও অনেক দেবদেবী আছে যাদের ঘরে ঢোকার পাসপোর্ট মঞ্জুর করেনি গৃহস্থ। তাহলে কি এই দেবতারাও ভূতদের সমগোত্রীয়?
দশ চক্রে ভগবান ভূত।

অনেকের কাছে আবার ভূতের নাম মুখে আনাও মানা। তাদের কাছে ভূতের নাম অপদেবতা। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, ভারতীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে ভূতের মিল কতটা নিবিড়। ব্রহ্মদত্যির পৈতে আর শাঁকচুন্নির শাঁখা ছাড়া, ভূতকূলে আর কারুর শরীরে কোনও ধার্মিক পরিচয় নেই। ভূত পাড়ায় কখনও দাঙ্গা হাঙ্গামার কল্পনা ভুতুড়ে লেখকরাও করেননি। মানুষের ধর্ম, সম্প্রদায় দেখে ভূতেরা দুষ্টুমি করে না। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নির্ভেজাল দেশজ ভুতুড়ে সমাজব্যবস্থা। একেবারে খাঁটি সেকুলার।
অন্যদিকে দেখুন, ভগবান মানেই ধর্ম। ধর্ম থেকে সম্প্রদায়। আর সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িয়ে সুদীর্ঘ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নৃশংস ইতিহাস।

ভূত নিয়ে যা খুশি বলা যায়। পাবলিক 'ধন্য ধন্য' করবে। বেশ কলার উঁচিয়ে নিজেকে হিরো জাহির করা যাবে। কিন্তু দেবতাদের নিয়ে মুখ খুলতে গেলেই বিপদ। পাবলিক পিটিয়ে পাট পাট করে দেবে। এরকম কোনও চিন্তাভাবনা থেকেই নিশ্চয়, যুক্তিবাদীরা ভগবানকে ছোঁয়ার সাহস দেখাননি।

ভূত ভগবান। বাস্তবে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের কেস। দু'পক্ষকে নিয়ে আমাদের যতোই লড়াই থাক, একে ছাড়া আরেকজন অসম্পূর্ণ। দুষ্টজনেরা আবার অন্য কথা বলেন। "ভূত আছে বলেই ভগবান আছে। অশরীরীর ভয়ের হাত থেকে বাঁচতে ভগবানই ভরসা। ভয়ে ভক্তি। ভূতের ভয় না থাকলে, কজনাই বা ভগবানকে পুছতো কে জানে!"

ভূতের ভয় রোলার কোস্টারে চড়ার মতো। রোমাঞ্চ আর ভয়ে মাখামাখি। বারবার ওই ভয় পেতে চেয়েছে মানুষ। তাই সেই আদিকাল থেকে আজও সমান প্রতাপে বেঁচে আছে ভূত, ভগবান। সেঁধিয়ে গেছে মানুষের মনে। বিশ্বাসে। কথাতেই আছে মানলে ঈশ্বর। শালগ্রাম শিলা। না মানলে নুড়িপাথর।  ঠিক যেমন মানলে জলোভূত। না মানলে আলেয়া। ভূতবিশ্বাসীদের ভূত। বিজ্ঞানমনস্কদের মিথেন বা মার্স গ্যাস।

নবরসের অন্যতম 'অদ্ভুত রস'। আর সেই রসেই জায়গা ভূতের।
মানুষ যেদিন পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে শিখে ফেললো, সেদিন থেকেই ভূতমহিমা কমলো। তারপর এলেন এডিসন সাহেব। তিনি লাইট জ্বালিয়ে দফারফা করে দিলেন ভূত বাবাজির।  মানবসভ্যতার চাপে দেওয়ালে পিঠ ভূতগোষ্ঠির। এমনিতেই খোনা গলায় যেটুকু কথা বলা। ভূতদের চেঁচিয়ে শব্দদূষণ নেই। মিটিং নেই মিছিল নেই। নেই ডিজি চালিয়ে নাচন কোদন। আর যেটুকুও আছে, তা সত্যজিত রায় মহাশয় সেই কবেই 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'- এ দেখিয়েছিলেন।

বেচারা ভূত! নিজেদের কথা কোথায় বলবে? তাদের কোনও এমএলএ, এমপি, নিদেনপক্ষে কাউন্সিলরও নেই। তাদের হয়ে কথা বলার লোকও কমে আসছে। একসময় ছিলেন পরশুরাম। রবীন্দ্রনাথের কৃপাদৃষ্টি থেকেও বাদ যায়নি ভূতেরা। তারপর দীনেন্দ্রনাথ রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, উপেন্দ্রকিশোর রায়রাও ভূতের মনের কথা বুঝতেন। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুলেরও ভূতপ্রীতি ছিলো বলে শোনা যায়।


একালের শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়রাও ভূতের কথা শুনিয়েছেন। আবার অলৌকিক ঘটনার কথা শোনাতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদাররা ঠারেঠোরে ভূতকেও টেনে এনেছিলেন। আর হুমায়ুন আহমেদতো ছিলেন ভূতবিলাসী। ভূতের মতোই এই ভূতপ্রেমীদের সংখ্যাও গেছে কমে।

সত্যজিত রায়কে ভূতে ধরেছিলো উত্তরাধিকার সূত্রে।
মামুলি ভূত নয়। 'গুগাবাবা'তে তিনি হাজির করেছিলেন, তাঁর দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়ের গল্পের খোদ ভূতের রাজাকে। সেই ভূতের কেত আবার ভগবানের মতো। শরণার্থীদের বর দিতো। ভূতের খপ্পর থেকে রেহাই পাননি সত্যজিতপুত্র সন্দীপ। তিনিও দেখালেন 'যেখানে ভূতের ভয়'।

তবে পেতনি শাকচুন্নিরাও যে কতো গ্ল্যামারাস হতে পারে তা দেখালেন অনীক দত্ত। খোনা গলা হলে কী হবে, তাদের গলায় 'আমরা চৌধুরি প্যালেসের ভূত' শুনতে বেশ লেগেছিলো। অনীকবাবুর ভূতরা আবার কোনও এক অসতর্ক মুহূর্তে, এমনই ভয়াবহ রূপ ধরে যে তাদের দেখে চোখ কপালে উঠেছিলো রাজশক্তির। 'ভবিষ্যতের ভূত'- এর সঙ্গে নিজেদের ভবিষ্যত গুলিয়ে ফেলেছিলেন মন্ত্রী- যন্ত্রীরা।

খুব রাগ ধরে এই যুক্তিবাদীদের ওপর। তাদের ঠাম্মারা কি বেহ্মদত্যির কথা শোনায়নি? গলায় সাদা ধবধবে উপবীত। পরণে শুভ্র ধুতি। বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণভূত। এই ভূতেদের ধম্মে কতখানি মতি তা ভাবুন। দেহ চিতার আগুনে জ্বলেপুড়ে পঞ্চভূতে বিলীন। গলার পৈতেখানি কিন্তু অব্যাহত। এই ব্রহ্মদৈত্যরা কোনদিন কারোর পেছনে কাঠি নেড়েছে বলে শুনিনি।

সন্দেহ নেই ভূতের বাঙালিয়ানা নিয়েও।
মেছোভূত। নিবাস জলা বা পুকুর পাড়ে। মানুষ দেখলেই গা ঢাকা দেয় বাঁশঝাড়ে। তারপর সুযোগ বুঝে ছিনতাই করে গৃহস্থের হাতে ঝোলানো মাছের থলে। মাছ ছাড়া তাদের ভাত রোচে না। এই মেছোভূতরা যে নিপাট বাঙালি, তা নিয়ে বাংলার নিউজ চ্যানেলে 'ঘণ্টাখানেক' ডিবেট বসতেই পারে।

আবার শাকচুন্নির থেকে বাঙালিয়ানার পাঠ নিতে পারেন, আধুনিক বাঙালি বউরাও। মানুষজন্মে স্বামীর দেওয়া হাতের শাখা, ভূতজন্মেও ছাড়ে না।
তারপরেই আছে পেতনিরা। মন্দজনের সন্দেহ, বাঙালি খাণ্ডারনি টাইপ মহিলা মরার পর, পুনর্জন্মে পেতনি হয়। ভীষণ বদমেজাজি। ভূত গবেষকরাই বলতে পারবেন, সিঁথিতে সিঁদুর ওঠার আগেই এদের গঙ্গাযাত্রা হয় বলেই কি মেজাজ সবসময় সপ্তমে? সেই ছোট্টবেলা থেকেই তো মায়েরা শেখান- "বর আসবে এক্ষুণই, নিয়ে যাবে তক্ষুণিই !" তা সেই আশাভঙ্গ হলে, মেজাজ তো সপ্তমে চড়বেই।
ভূতেরাও বাঙালিদের মতোই আড্ডাবাজ। রসিক আর সঙ্গীতপ্রিয়। গাছের মগডালে দোল খাওয়া। ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে থাকা। রাতদুপুরে অট্টহাস্য। অনেকে আবার পেতনিদের গানও শুনেছেন।
- "আঁগে কী সোঁদর দিঁন কাঁটাইতাঁম!

কখনও- সখনও গৃহস্থের ঘাড়ে চেপে বসার রসিকতা করতো ভূতরা। তবে তা কোনভাবেই চৌত্রিশ বছরের জন্য চেপে বসে থাকতো না। বড়জোর চৌত্রিশ ঘণ্টা। এই অনুপ্রবেশকারী ভূতেদের দৌলতেই বেশকিছু রোজগার করে নিতো গুনীনরা। তারপর দু চারটে ঝাঁটার বাড়ি মারলেই ওস্তাদ ভূতও হাওয়া। যাওয়ার আগে ভেঙে দিয়ে যেত একটা মাটির কলসি অথবা বাড়ির পেয়ারা, নিমগাছের ডাল। কিন্তু ভূতে কারুর ঘাড় মটকে পালিয়েছে, এমনটা শোনা যেত নাকি?

থাকুক না ভূতেরা মানুষের সঙ্গেই মিলেমিশে। যুক্তি তর্ক দিয়ে মগজের ভূত ঝাড়া যায়। কিন্তু ভূত, ভগবান, দুয়ের জায়গাই মানুষের মনে। আবেগে। আর উন্নয়নের ঠেলায় ভূত তো ইতিমধ্যেই নিরুদ্দেশ। শহর হাত- পা ছড়িয়েছে। পোড়োবাড়িও আর পড়ে নেই। বনজঙ্গল কেটে সাফ। ভরাট নয়নজুলি, জলাশয়। উন্নয়নকে জায়গা ছেড়ে দিতে কতশত বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ, পোকামাকড় জীবজন্তুর প্রজাতির মতো কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে চলেছে ভূত।

ভূতের এই দুর্দিনে হঠাতই 'বাংলার মহারাজ'- এর মুখে শোনা গেল ভূতের নানা কীর্তির কথা। এখনও ভূতের ওপর বিশ্বাস হারাননি 'বাংলার মহারাজ'। ভূতেরাও একথা জেনে, নিশ্চয়ই আনন্দে দলবেঁধে তুর্কি নাচন নেচেছিল। ভূতের বাজারে এই রমরমা দেখেই খাপ্পা যুক্তিবাদী বাবুরা। এবার ভূতের কথা মানুষের মুখে আনাও বন্ধ করতে চাইছেন বিজ্ঞানপ্রেমীরা।

সংখ্যালঘু তোষন করে, ভারতীয় গণতন্ত্রে কেউ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। আর ভূতেরা তো প্রকৃত অর্থেই সংখ্যালঘু। দেব- দেবতারা বরাবরই সংখ্যাগুরু। একমাত্র হিন্দুদেরই আছে তেত্রিশ কোটি। তাই বোধহয় যুক্তিবাদীরা দেবদেবীদের ঘাটাতে সাহস পান না। তার ওপর ভক্তরা তো আছেনই। টলিগঞ্জে কেলিয়েই বেন্দাবন দেখিয়ে দেবে। তাই টিকে থাকতে গেলে সংখ্যাগুরুকে না ঘাটানোই নিরাপদ। বরং সংখ্যালঘুর পেছনে লেগেই যদি নিজেদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত করা যায়, মন্দ কী?

ভূত আছে কী নেই, এটা খুব জরুরি কোনও প্রশ্ন না। পরি থাকুক, দত্যিদানো থাকুক, তেপান্তর ভুবনডাঙা থাকুক, সাতভাই চম্পা তাদের পারুল বোনও নিরাপদ থাকুক। থাকুক মামদো, ব্রহ্মদত্যি, পেতনিরাও। শিশুমনের কল্পনার জগতটাও থাকুক। এরাই তো শৈশবজুড়ে।
ভূত মানেই তো অতীত। বয়সের সঙ্গে সব ঝাপসা হয়ে আসে। উধাও নিষ্পাপ কল্পজগত। মাঝবয়সে গেড়ে বসে রাহু কেতু নামের দুই ভূত। তাদের ঠেকাতে তাবিজ কবজ মাদুলি নীলা গোমেদ। এই গ্রহরূপী ভূতের প্রবক্তারাও কি কুসংস্কার ছড়াচ্ছেন না?
দাদাগিরির ভূতধরা মেয়ে, সৌরভের ভূতাভিজ্ঞতা নিয়ে খিল্লি ওড়ানো সহজ। কিন্তু জ্যোতিষব্যবসা নিয়ে মুখ খোলার সাহস দেখাবেন নাকি যুক্তিবাদীরা?
আর ভূত আটকাতে আদালতে মামলা ঠোকা? এও কি কম ভুতুড়ে ব্যাপার নাকি!
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours