সীমন্তী দাস, লেখিকা, দুর্গাপুর:

নব্বইয়ের মাঝামাঝি। মফস্বলের সদ‍্য বারো ক্লাস পাশ করা একটা মেয়ে কলকাতার কলেজে পড়তে গেল। হোস্টেলে রেখে পড়াশোনা করার চাইতে আত্মীয়ের বাড়িই নিরাপদ, তাই লেকগার্ডেনস এ ঠিক রেল স্টেশনের ধারে এক বাড়িতে তার ঠাঁই হল। নিত‍্য সে  ট্রেনে বজবজ লাইনের ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ যেত । এমনই এক শীতের সকালে স্টেশনে প্রায়ান্ধকার কাউন্টারের সামনে সেই পাগলের দর্শন। একমুখ দাড়ি, ছয় ফুট লম্বা, তামাটে গড়নের একটা শতছিন্ন ঝোলা পাশে হাতে একটা ভাঙা ক‍্যালকুলেটর। বিড়বিড় করে অঙ্ক করছে। চোখ দুটো চকচক করছে।প্রথম দর্শনে পাগল?অষ্টাদশীর চোখে বিস্ময় সাথেই তীব্র আকর্ষণ ঐ চোখ।
মাস যায়। সকালের ঐ চোখাচোখি সাথে এক চিলতে হাসিও যোগ হয়।
হঠাৎই একরাতে স্টেশন চত্ত্বরে গোলাগুলির আওয়াজ। দুপক্ষের লড়াই চলছে।এনকাউন্টার। ড্রাগ পেডলার ছোটা খোকনের লাশ পাওয়া গেল রেল লাইনের ওপর।
সেই পাগল।ও কি স্টেশনে তখন ছিল?অষ্টাদশীর মনে আতঙ্ক।
পরের দিন জানা গেল পাগল সিআইডি।ঝোলা থেকে বেড়িয়েছিল বন্দুক। ক‍্যালকুলেটর ওয়াকিটকি। ওহ কি সাংঘাতিক। শেষের দিন কি বলেছিল, আর দেখা হবে না।
সত্যিই আর পাগলের সাথে দেখা হল না।
ফিরে এলো অষ্টাদশী, তখন কুড়ি বাইশ। মফস্বলের  ছোট্ট এক পাড়ার বৌ। নিয়মের জাঁতাকলে পেষাই হওয়া মাংস পিন্ড। কোলে তখন বছর  আড়াইয়ের আত্মজা।
মা পালল। পিঠে ঝোলা। সুঠাম চেহারা। একমুখ দাড়ি।
পালল বিকু খাবি,জন খাবি? স্থির চোখে তাকানো সেই মানুষের হাতে বিকু জল দিত আত্মজা। সেই দেখে মায়ের পুরানো গল্প মনে এসে হাসিই পেলো।
কদিনের নিত‍্য অভ‍্যাসে বিকু জলের ঘটনা সকলের নজরে পরতে ছেলেধরা থেকে সিআইডি সব জ্ঞান মাকে দেওয়া হল। মা বনুক আছে। একদিন ঘরের সামনের জমে থাকা জলে কাপড় কাচতে থাকলো সে। মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে মনে হয় সাবান চাইলো। একটুখানি সাবান দিয়ে কাচা ধোয়া চান সব দিব‍্যি হয়ে গেল।বিধিনিষেধের কড়াকড়ির কোপ পরলো পাললের ওপর আর মায়ের ওপর। সেও একদিন খুকির দেখা না পেয়ে আসা বন্ধ করলো। রাস্তায় হনহন করে হাঁটার মাঝেও খুকি আর তার মাকে দেখলে সে থেমে যেত।
প্রিয়জনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে তাকে খুব পেট ভরে খাইয়েছিল খুকির মা। লোকে বললো পুন্নি করলো খুকির মা। যে বললো সে কিন্তু একদিন গরমজল ছিটিয়ে ছিল "পাললের" গায়ে। দীর্ঘশ্বাসের দলা তখন খুকির মায়ের গলা দিয়ে নামছে না।
শীতের শুরুতে সকলকে লুকিয়ে একটা চাদর আর প‍্যান্ট দিয়েছিল খুকির মা।
দিন গড়িয়েছে। এদিকে খুকিদের বাসা ভেঙে গেছে। তাই অনেক দিন আর ঐ পাড়ায় তারা যায়না। বাস থেকে মাঝেমধ্যে তাকে চোখে পরে।না এখনো ঝোলা থেকে বন্দুক বেড় হয়নি।
কাল হঠাৎই বাসরাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে খুকির মা।সন্ধ্যা নেমেছে। হঠাৎ ই সেই মানুষ সামনে এসে হাজির। গায়ে খুকির মায়ের দেওয়া কমলা উলের চাদর। চোখে মুখে হাসি। প‍্যান্টটা এখন আছে? ইসারায় ঝোলাটা দেখালো সে।
তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আঁধারে।
হঠাৎ যেন এক স্বস্তির নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এল বুকের ভেতর থেকে।
আজ আর অষ্টাদশী চায়না পাগল সিআইডি হোক।
সে চায়না সাজানো এনকাউন্টার।
হায়দ্রাবাদের পুলিশের গলায় গোলাপ মালা পরলো, উন্নাহের ধর্ষিতার দোষী জামিন পেলো সেই কাশ্মীরের ব্রাহ্মণ তার খবরটি ,জানা গেল?আসানসোলের সেই  ছেলেটি বেঁচে থাকলে এবার উচ্চমাধ্যমিক দিত।
তাই পাগল পাগলই থাক। সিআইডি চাইনা।মানুষের একটু মনুষ্যত্ব থাক। সাজানো এনকাউন্টার চাইনা। স্মৃতি একটু জাগ্রত থাক।বিস্মৃতির বিস্ময় বিস্মরণ চাইনা।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours