গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:
কিছুদিন আগে অফিসের কাজ শেষে করে ফিরছিলাম মালদার ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে, গাজোল নামের একটি জায়গায় রাতের খাবার খেতে একটু ভদ্র গোছের একটা ধাবা তে দাঁড়ালাম, রাত তখন সবে নটা, রাতের খাবার খেতে খেতেই কানে এলো উচ্চস্বরে চটুল হিন্দি গান। ধাবার খোলা জানালা দিয়ে ধান ক্ষেত পেরিয়ে অন্ধকার ভেদ করে চোখ চলে গেল শব্দের উৎপত্তি স্থলের দিকে। সামান্য দুরে তিন-দিক খোলা এক আলো উদ্ভাসিত মঞ্চ, সেখানে স্বল্পবাস মেয়েদের উদ্দাম নাচ চলছে গানের তালে তালে, ভাবলাম হয়তো কোনো জলসা চলছে, দুরথেকে বেশ ভীড়ও দেখা যাচ্ছে, প্রায় সবাই দাঁড়িয়েই অনুষ্ঠান দেখছে, এসব অনুষ্ঠান এখন সব জায়গায়তেই হয় তাই অবাক না হয়ে আবার গরম রুটি আর কষা মাংসে মন দিলাম কিন্তু খাবার পরিবেশন করতে এসে ধাবার এক কর্মচারী জানালো ওখানে চারদিনের যাত্রা উৎসব চলছে! এবার আমার অবাক হওয়ার পালা! মুচকি হেসে সে আরও জানালো "ওই আর কি, বুঝতেই তো পারছেন, এখনে এরকমই হয়, এইসব না হলে ভীড় ই হবে না" , শুনে মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো, মনে পড়ে গেল অতীতের দিকপাল যাত্রাশিল্পী বীণা দাশগুপ্তা, গুরুদাস ধাড়া, শান্তিগোপাল, অশোক কুমার, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, স্বপন কুমারদের কথা, সেইসব যাত্রা জগতের কিংবদন্তি অভিনেতা অভিনেত্রীদের উজ্জ্বল উপস্থিতির কথা, যাদের নিয়ে একসময় রান্নাঘর থেকে শুরু করে কফি হাউসেও উঠতো আলোচনার ঝড়। এমনকি হাল আমলের রোম্যান্টিক জুটি অনল-কাকলির কথা, যাদের অভিনয় আর গল্পের জোরে পাঁচ-ছয় হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে যেতো দশ বছর আগেও, এইসব গ্রামাঞ্চলেই বেশ চলত খাঁটি যাত্রাপালার একের পর এক কল-সো। আজ এ কি অবস্থা হয়েছে বাংলার যাত্রার ! পুরো আধ ঘন্টা ওখানে ছিলাম, সংলাপের ছিটেফোঁটাও কানে আসেনি শুধু চটুল গান আর চিৎকার ছাড়া...
কেমন আছে এখন বাংলার আমজনতার একসময়ের অন্যতম বিনোদন যাত্রা পালা! কেমনই বা আছে বাংলার যাত্রা-তীর্থ কলকাতার চিৎপুরের যাত্রাপাড়া! অজস্র রঙিন ঝলমলে, গ্রাম থেকে শহর কাঁপানো একের পর এক কালজয়ী যাত্রা উপহার দেওয়া চিৎপুর যাত্রাপাড়া, সত্যিই কি ভালো আছে ! মনে হয় ভালো নেই! সোনালি অতীত পেরিয়ে নিভু নিভু আলোয় নীরবে শুধু বেঁচে আছে আজকের চিৎপুর আর বাংলার যাত্রা জগত ! জনপ্রিয়তার বিচারে কি সত্যিই অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতি ! এই সময়কালে বাংলার যাত্রার জন্মভিটে বা মুল উৎপত্তি স্থল চিৎপুরে চোখ রাখলে কিন্তু হতাশার এই খন্ড-খন্ড চিত্রই চোখে পড়বে! বাংলা সিনেমার পীঠস্থান যদি টালিগঞ্জ হয়, তাহলে চিৎপুর অবধারিত ভাবে বাংলা যাত্রা পালার পীঠস্থান, যাত্রা-পাড়া বলতে সবাই একডাকে চেনে এই চিৎপুরকে। বনেদি উত্তর কলকাতার চেনা ছবি এখানে সহজেই চোখে পড়ে যাবে। সুরু গলি, ঘিঞ্জি-রাস্তা, ট্রামলাইন, বাস, ট্যাক্সি, রিক্সা, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদির ভীড় সামলে রাস্তার দুপাশে ছোট্ট ছোট্ট কাউন্টার আছে। সেখানে রংবেরঙের পোস্টারের পসরা সাজিয়ে বসে আছে অসংখ্য যাত্রাপালার দল। এ আর এক কলকাতা, টুকরো টুকরো রঙিন ছবির কোলাজে সাজানো রঙিন একটা প্রাচীন পাড়া। সেই রং অনেকটাই ফিকে হয়ে নিজেদের বিনোদন সত্তাকে কোনো রকমে যেন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে আজকের চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। অনেকেই বলছে যাত্রার প্রধান ‘ভিলেন’ এখন যাত্রাধর্মী টেলিভিশনের মেগা সিরিয়াল গুলো! মনে হয় ঘরোয়া মানুষেরা বা গৃহবধূরা হয়তো বিনোদনের অন্য এক বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন এই 'মেগা সিরিয়ালে'! যাত্রার প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছেন তারা, আর আসছেন না মাঠ ভরাতে! যাত্রা নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে বাঙালিদের আর সেই উন্মাদনা চোখে পড়ে না আজকাল, বছর দশেক আগেও শীত পড়তে শুরু করলেই মফস্বল, গ্রাম তো বটেই, শহরতলিতেও ছেয়ে যেত যাত্রার রঙিন পোস্টার, খবরের কাগজে পাতা জুড়ে বের হতো যাত্রার রঙিন বিজ্ঞাপন, পথ চলতে কানে আসতো নাটকীয় ঢঙে মাইকে যাত্রার প্রচার। রথের দিন থেকেই উৎসব শুরু হয়ে যেত এই যাত্রাকে কেন্দ্র করে। কোন নায়ক-নায়িকা এবার কোন দলে যোগ দিয়েছেন, নতুন যাত্রার নাম গুলো ছড়িয়ে পড়তো মুখে মুখে, পুজোর পর-পরই যাত্রার আসর বসে যেত বিভিন্ন যায়গায়। চায়ের দোকান থেকে বাড়ীর অন্দরমহলে সর্বত্রই চলত যাত্রার অভিনয় বা গল্প নিয়ে কমবেশি আলোচনা৷ রীতিমতো আগে থেকে টিকিট কেটে যাত্রার আসরে ভীড় জমাতেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ, কখনও কখনও এমনও ঘটনা হয়েছে যে ভিড়ের চোটে যাত্রার প্যান্ডেলের গেট খুলে দিয়ে দর্শকদের ঢুকতে দিতে হয়েছে। তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল যাত্রার, কিন্তু আজ যাত্রা দেখার অভ্যেসটা মানুষ যেন কেমন হারিয়ে ফেলেছে! জমিয়ে শীত পড়লেও যাত্রার আসরগুলো সব ফাঁকাই পড়ে থাকছে! একটা সময়ে, ঘরে-ঘরে টেলিভিশন ছিল না, ছেলে বুড়ো সবার হাতে স্মার্টফোন ছিল না, সেই সময়ে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষের একঘেঁয়ে জীবন থেকে মুক্তির জন্য ছিল তিন দিক খোলা মঞ্চে লোকসংস্কৃতির এক অন্যতম বিনোদন ব্যবস্থা যাত্রা পালা। চড়া মেকআপ, হাই-ভোল্টেজ মেলো-ড্রামা, উচ্চ স্বরে অভিনয়, মানুষ মুগ্ধ হয়ে বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা। একসময়ে রমরমিয়ে চলা এই বিনোদন শিল্পের জনপ্রিয়তা হারানোর জন্য অনেকেই মুলত তাই টেলিভিশনকেই দায়ী করছেন! বিশেষত যাত্রা শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িয়ে আছেন এমন কলাকুশলীরা এমনটাই মনে করেন, অনেক কলাকুশলীরা আবার এই পরাজয়টা মানতেই পারছেন না, নানান তথ্য তুলে ধরে (অর্থনৈতিক মন্দা, নোটবন্দি) বলতে চাইছেন যাত্রা শিল্প ভালোই আছে, এখনও অনেক নতুন নতুন ছেলে মেয়েরা যাত্রায় অভিনয় করতে আসছে, আর ব্যবসাও নাকি নেহাত খারাপ হচ্ছে না। যাত্রার জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া নিয়ে যাত্রা জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের নানান মত উঠে আসলেও, একটা ব্যাপারে সকলেই একমত যে যাত্রার বাজার অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে মেগা সিরিয়াল। এখনকার গৃহবধূরা এমনকি পুরুষ মানুষদেরও অনেকে নিয়ম করে টিভি সিরিয়াল দেখেন, তাছাড়া বিনোদনের আরও অনেক মাধ্যম চলে এসেছে আজকের প্রজন্মের হাতের কাছে, তাই কিছুটা নয় অনেকটাই জনপ্রিয়তা কমেছে যাত্রার। ধৈর্য্য ধরে এখন আর কেউ যাত্রা দেখতে চান না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছেও আজ বিনোদনের অনেক মাধ্যম চলে এসেছে, যা যাত্রার জনপ্রিয়তা কেড়ে নিয়েছে অনেকটাই। যাত্রা শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন লোকের মতে, এখন বাড়ীতে বসেই বিভিন্ন সিনেমা বা সিরিয়ালে দর্শকরা বিভিন্ন ধরনের কাহিনী সহজেই দেখে ফেলছেন, আর যাত্রাতে সেই একই ধরনের কাহিনী দেখতে পয়সা খরচ করে তাই মাঠে কষ্ট করে আর যেতে চাইছেন না! যদিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে মানুষের চাহিদা, পাল্টে গেছে মানুষের রুচি, হয়তো বাংলার যাত্রাও তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে অনেকটাই নিজেদের পাল্টে নিয়েছে টিকিট বিক্রির আশায়! তাই হয়তো হাততালির ঝড় তোলা সংলাপের বদলে আমদানি হয়েছে, সিটি বাজানো, মঞ্চ কাঁপানো, স্বল্পবসনা মেয়েদের চটুল নাচ-গান, বেসুরো অর্কেস্ট্রা, যেখানে গল্প নেই, অভিনয় নেই, আছে শুধু যৌনতার হাতছানি! বাংলার পাঁচশ বছরের পুরনো এই লোকসংস্কৃতিকে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফেরাতে তাই শুধু যাত্রার কারিগরদের মানসিকতার বদল ঘটালেই চলবে না, একই সঙ্গে দর্শকদের মানসিকতার বদলেরও খুব প্রয়োজন ! তবুও একটা কথা বলতে হয়, শুধুই কি টিভির মেগা সিরিয়ালের সঙ্গে পাল্লা দিতেই যাত্রায় এতো অশ্লীলতা আমদানি করতে হয়েছে! তাই কি পাঁচ মিনিট অন্তর-অন্তর দক্ষিণী বা মুম্বই ঘরানার সিনেমার মতো সুযোগ বুঝে কাহিনির সঙ্গে মানানসই করে এইসব অশ্লীল নাচ গান যাত্রায় কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে! নাকি সোজা যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে, দর্শক টানার জন্যই স্বল্পবাস পরিহিতা, অভিনয়ের অক্ষর জ্ঞান শূন্য, সব নায়িকাদের হাজির করা হচ্ছে আজকাল যাত্রায়!! উত্তেজক ‘হট সিন’ দিয়ে যাত্রাকে সিনেমার সমতুল্য করে তোলার এই বৃথা চেষ্টা শুরু হয়েছে অবশ্যই, এতে কিন্তু আসলে হিতে বিপরীতই হচ্ছে !! আগে যেখানে সব বয়সের মানুষেরা বিশেষত গৃহবধূরাই ছিলেন যাত্রার দর্শক, আজকাল যাত্রার প্রচারের পোস্টার দেখে অনেকে সপরিবারে খোলা মঞ্চের দিকে পা বাড়াতেই লজ্জা পাচ্ছে! উঠতি বয়সের চ্যাংড়া ছেলেপুলেরা এসব গরম দৃশ্যের টানে আসছে বটে, কিন্তু এই অপসংস্কৃতির চোরা স্রোতে ডুবে যাওয়া যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কিন্তু ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে! চিৎপুরের আনাচেকানাচে এখন এই সমস্ত প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রখ্যাত পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন চিৎপুরের মুকুটহীন সম্রাট, একের পর এক সফল পালা তিনি রচনা করে গেছেন, যেমন নাচমহল, অশ্রু দিয়ে লেখা, মীনাবাজার, ক্ষুধিত হারেম, দেবী সুলতানার মতো অসংখ্য ঐতিহাসিক যাত্রাপালা, তেমনই রচনা করেছেন অচল পয়সা, বর্ণ পরিচয়, ময়লা কাগজের মতো অনেক সফল সামাজিক যাত্রাপালা। তাঁর 'মা মাটি মানুষ' যাত্রা পালার স্লোগান তো ইতিহাস রচনা করেছে! আজকের প্রজন্মের কতজন ছেলে-মেয়ে জানে এই প্রতিভাধর পালাকারের নাম! এক সময় কাটোয়া, পাটুলি, পূর্বস্থলী, কালনা, বর্ধমান, রানিগঞ্জ, আসানসোল, ইত্যাদি অনেক গ্রাম-গঞ্জে অসংখ্য ভালো ভালো যাত্রাদল ছিল, অনেক গ্রামেই তখন বসত অপেশাদার যাত্রাভিনয়ের প্রতিযোগিতার, সেরা অভিনেতাকে সোনার মেডেল উপহার দেওয়াও হত, এখন এসবই অতীত! যাত্রায় সে যুগে মুলত ব্যবহার হতো ডুগি-তবলা, হাত-ঢোল, ক্ল্যারিওনেট, খঞ্জনি, ফুলোট আর আড় বাঁশি, সুরে আর গানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দর্শকরা বসে থাকত সারারাত। সে সময় বড়ো বড়ো যাত্রা হতো সারারাত ধরে, এখন দৈর্ঘ্য কমতে কমতে বড়জোর দু-আড়াই ঘণ্টায় এসে দাঁড়িয়েছে, তবু দর্শকরা মাঝপথে উঠে চলে যাচ্ছে৷ জমিদারি আমলে ঝাড়বাতির আলোয় যাত্রাপালা অভিনীত হত, পরে আসে হ্যাজাকের আলো, বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে ডেলাইটের প্রচলন শুরু হয়, মঞ্চের চার কোণের চারটে ডেলাইটে আলোকিত হয়ে উঠত যাত্রার মুক্ত মঞ্চ৷ আটের দশকেও এই ডেলাইটের চল ছিল গ্রামের দিকে, তার পর থেকেই শুরু হয় বৈদুত্যিক রঙিন আলোর ব্যবহার৷ মঞ্চে ব্যবহার শুরু হয় স্টেজ মাইক ও মাইক্রোফোনের, আসে ইকো আর যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য ক্যাসিও, আর এখন তো বার ডান্সারদের নাচের পরিবেশ তৈরী করতে উপযোগী আলো আর ডিজিটাল ডলবি সাউন্ড এসে গেছে! যাত্রার প্রথম যুগে পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতে আসতেন, তাদের বেশ নামডাকও ছিল, ধীরেধীরে পেশাদারি অভিনেত্রীরা সেই স্থান দখল করে নেন ৷ তারপর শুরু হয় দর্শক টানতে নামীদামি ফিল্ম স্টারদের যাত্রায় নিয়ে আসার হিড়িক! তাতে সাময়িক চাহিদা বেড়ে ছিল ঠিকই কিন্তু সেটা আর যাত্রা হয়ে উঠেছিল না! নিছকই গ্ল্যামার প্রদর্শনী হয়ে উঠেছিল ! ফিল্মস্টাররা যাত্রা করায় যাত্রার মান বেড়েছে না কমেছে এটা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে কিন্তু যাত্রার কৌলিণ্য যে হারিয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়! এই দাবি অবশ্য উড়িয়ে দিতে চান বাংলার চলচ্চিত্র অভিনেতা অভিনেত্রীরা, তাদের মতে ফিল্মস্টার থাকলে, যাত্রার টিকিটের চাহিদা অনেকটাই বাড়ে, হয়তো অনেকাংশেই এটা সঠিকি, কারণ ফিল্মস্টারদের দেখার জন্য অনেক বেশি আকর্ষণ তৈরী হয়! তবে যাত্রা জগতের প্রবীণ শিল্পীদের মতে, ফিল্মস্টারদের নিয়ে যাত্রা বেশিদিন চলবে না! এটাও বাস্তব সত্য যে এই মুহূর্তে যাত্রায় সেরকম ভাল স্টার আর্টিস্ট নেই আগের মত, যাদের নাম শুনেই মানুষ ভীড় করবে যাত্রা দেখতে। এর যথেষ্ট কারণও আছে, যাত্রার জন্য সেরকম কোনও ওয়ার্কশপ হয় না, ভাল চিত্রনাট্যকারও সেরকম নেই আগের মতো। যাত্রা মানেই জানতাম একটু চড়া মেকআপ, উচ্চ স্বরে মেলোড্রামা, চমকে দেওয়া সংলাপ, সেরকম যাত্রাপালার নামগুলোও ছিল আলোড়ন সৃষ্টি করা, মানুষের মুখে মুখে ঘুরত । আর এখন নতুন কিছু ভাবার বা দেওয়ার মতো সময় কারও নেই, হয়তো কারও কোনও ইচ্ছেও নেই! অনেকের মতে, যাত্রার নিজস্ব ঘরানা ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টা করাটাই ভুল হয়েছিল ! একটা সময়ে যাত্রা ছিল অত্যন্ত চড়া ধাঁচের কিন্তু এখন আর সেরকম হয় না, যাত্রার পরিকাঠামো পালটে গেছে দর্শকসংখ্যা কমে গেছে, উপস্থিত পাঁচ-সাত হাজার দর্শক যাতে সংলাপ ঠিকঠাক শুনতে পান, সেজন্য উচ্চগ্রামে কথা বলা হতো, এখন দর্শক কমে গেছে, এসে গেছে ঝলমলে আলো, এসে গেছে স্টেজ মাইক তাই আর উচ্চ স্বরে অভিনয় করার প্রয়োজন হয় না। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভাল স্ক্রিপ্টেরও এখন খুব অভাব যাত্রায়। এক সময়ের টালিগেঞ্জর বাংলা ছবির মতো এখন যাত্রাতেও দক্ষিণী বা মুম্বই এর ছবির অনুকরণ চলছে। মারকাটারি মুম্বই মার্কা গল্প বানাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের যাত্রায় মুম্বইয়ের ডাকসাইটে অভিনেতা অভিনেত্রীদেরও দেখা গেছে মাঝে মাঝে, বেশ কয়েক বছর আগে জিনাতামন, রবীনা ট্যান্ডন, শক্তি কাপুর বা পদ্মিনী কোলাপুরীর মতো বলিউডের স্টার অভিনেতা অভিনেত্রীদের এনে পশ্চিমবঙ্গের যাত্রামঞ্চে দর্শক টানার চেষ্টাও করা হয়েছে! আজও চিৎপুরে প্রতিটা ব্যস্ত দিনে নিয়মমাফিক রংবেরঙের পোস্টার সাজিয়ে বসে থাকেন বিভিন্ন দলের ম্যানেজার বা কর্মকর্তারা কিন্তু দিনের শেষে তাদের মন বা পকেট কোনোটাই ভরছে না ! অধিকাংশ ম্যানেজারেরই বক্তব্য, 'লোকসানে চলছে চিৎপুর, কোনওরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে যাত্রাপাড়াকে' ! এমনকী এখন টিকিট বিক্রি করে যাত্রা শো নাকি খুব কমই হয়, অধিকাংশ যাত্রাই ফ্রি-তে আজকাল কল-সো করা হচ্ছে, যা আর্থিক এবং মানসিক দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতিকে।
অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের কিছু কর্মকর্তার মতে যাত্রাদলের সংখ্যা নাকি আগের থেকে সংখ্যায় অনেক বেড়েছে! কিন্তু যাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর পরিস্কার করে পাওয়া যায় নি! ফিল্মস্টারদের ভিড়ে কি 'যাত্রা' তার নিজস্ব যাত্রা-স্টারদের হারিয়ে ফেলেছে ! রুমা দাশগুপ্ত, স্বপন কুমার, শ্যামল চক্রবর্তী, অনল-কাকলির পর আর কোনো নাম সেই কারণেই হয়তো আর উঠে আসেনি। যাত্রা জগতে একটা শূন্যতা তৈরী অবশ্যই হয়েছে, তবে একটা ব্যাপারে সবাই একমত যে যাত্রার মৃত্যু হবে না কখনও। সম্প্রতি সরকারি ভাবে অনেক উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু যাত্রাপাড়ার পরিকাঠামো যতক্ষণ না উন্নত হচ্ছে, যতক্ষণ না গুণগত মান বাড়ছে, যাত্রা শিল্প যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজের পায়ে না দাঁড়াতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যাত্রা শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানো কিন্তু খুব কঠিন। রাজ্য সরকারের সাহায্য যাত্রাশিল্পকে অনেকখানি চাঙ্গা করেছে, পরিকাঠামো উন্নত করার চেষ্টাও চলছে, যাত্রার অনুমতি নেওয়া এখন তুলনামূলক অনেক সহজ করা হয়েছে, একশ টাকা অবধি টিকিট এখন সম্পূর্ণ করমুক্ত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি এখন প্রতি বছর যাত্রা উৎসবের আয়োজন করছে। যাত্রা শিল্পকে সগর্বে ফিরিয়ে আনতে একটা লড়াই অবশ্যই শুরু হয়েছে। বিভিন্ন অপেরার সঙ্গে যুক্ত প্রায় কুড়ি হাজারের বেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্য সরকারি তরফে বার্ষিক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এই ভাতার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় নয় হাজার টাকার মতো ৷ এছাড়াও চালু করা হয়েছে বিভিন্ন পুরস্কার, তপনকুমার পুরস্কার (এক লক্ষ টাকা), বীণা দাশগুপ্তা পুরস্কার (পঞ্চাশ হাজার টাকা)। দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য গঠন করা হয়েছে তহবিল। তবু চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় ঘুরলে কানে আসবে হতাশার এক করুন সুর! কানে আসবেই কয়েকটি লাইন... "আজীবন পরিশ্রম করে ভালোবেসে একটা শিল্প মাধ্যম্যকে আঁকড়ে পড়ে থেকে কি পেলাম! না টাকা-পয়সা না সম্মান"..... সত্যি এটাই বাস্তব, আমাদের সমাজও এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবে না, টালিগেঞ্জর সিনেমা আর্টিস্টদের কথা ছেড়েই দিলাম, সবার কথা বলছি না তবু টেলিভিশনের সেইসব নিম্নমানের সিরিয়ালের শিল্পীদের তুলনায় কিন্তু যাত্রা শিল্পীরা জনপ্রিয়তায় অদ্ভুত ভাবে সব সময়ই পিছিয়ে, তাই হয়তো তাদের ডাক পড়েনা কোনো অনুষ্ঠানের ফিতে কাটতে!! দেখা যায়না কোনো নেতা-মন্ত্রী সাথে এক মঞ্চে!
কিছুদিন আগে অফিসের কাজ শেষে করে ফিরছিলাম মালদার ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে, গাজোল নামের একটি জায়গায় রাতের খাবার খেতে একটু ভদ্র গোছের একটা ধাবা তে দাঁড়ালাম, রাত তখন সবে নটা, রাতের খাবার খেতে খেতেই কানে এলো উচ্চস্বরে চটুল হিন্দি গান। ধাবার খোলা জানালা দিয়ে ধান ক্ষেত পেরিয়ে অন্ধকার ভেদ করে চোখ চলে গেল শব্দের উৎপত্তি স্থলের দিকে। সামান্য দুরে তিন-দিক খোলা এক আলো উদ্ভাসিত মঞ্চ, সেখানে স্বল্পবাস মেয়েদের উদ্দাম নাচ চলছে গানের তালে তালে, ভাবলাম হয়তো কোনো জলসা চলছে, দুরথেকে বেশ ভীড়ও দেখা যাচ্ছে, প্রায় সবাই দাঁড়িয়েই অনুষ্ঠান দেখছে, এসব অনুষ্ঠান এখন সব জায়গায়তেই হয় তাই অবাক না হয়ে আবার গরম রুটি আর কষা মাংসে মন দিলাম কিন্তু খাবার পরিবেশন করতে এসে ধাবার এক কর্মচারী জানালো ওখানে চারদিনের যাত্রা উৎসব চলছে! এবার আমার অবাক হওয়ার পালা! মুচকি হেসে সে আরও জানালো "ওই আর কি, বুঝতেই তো পারছেন, এখনে এরকমই হয়, এইসব না হলে ভীড় ই হবে না" , শুনে মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো, মনে পড়ে গেল অতীতের দিকপাল যাত্রাশিল্পী বীণা দাশগুপ্তা, গুরুদাস ধাড়া, শান্তিগোপাল, অশোক কুমার, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, স্বপন কুমারদের কথা, সেইসব যাত্রা জগতের কিংবদন্তি অভিনেতা অভিনেত্রীদের উজ্জ্বল উপস্থিতির কথা, যাদের নিয়ে একসময় রান্নাঘর থেকে শুরু করে কফি হাউসেও উঠতো আলোচনার ঝড়। এমনকি হাল আমলের রোম্যান্টিক জুটি অনল-কাকলির কথা, যাদের অভিনয় আর গল্পের জোরে পাঁচ-ছয় হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে যেতো দশ বছর আগেও, এইসব গ্রামাঞ্চলেই বেশ চলত খাঁটি যাত্রাপালার একের পর এক কল-সো। আজ এ কি অবস্থা হয়েছে বাংলার যাত্রার ! পুরো আধ ঘন্টা ওখানে ছিলাম, সংলাপের ছিটেফোঁটাও কানে আসেনি শুধু চটুল গান আর চিৎকার ছাড়া...
কেমন আছে এখন বাংলার আমজনতার একসময়ের অন্যতম বিনোদন যাত্রা পালা! কেমনই বা আছে বাংলার যাত্রা-তীর্থ কলকাতার চিৎপুরের যাত্রাপাড়া! অজস্র রঙিন ঝলমলে, গ্রাম থেকে শহর কাঁপানো একের পর এক কালজয়ী যাত্রা উপহার দেওয়া চিৎপুর যাত্রাপাড়া, সত্যিই কি ভালো আছে ! মনে হয় ভালো নেই! সোনালি অতীত পেরিয়ে নিভু নিভু আলোয় নীরবে শুধু বেঁচে আছে আজকের চিৎপুর আর বাংলার যাত্রা জগত ! জনপ্রিয়তার বিচারে কি সত্যিই অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতি ! এই সময়কালে বাংলার যাত্রার জন্মভিটে বা মুল উৎপত্তি স্থল চিৎপুরে চোখ রাখলে কিন্তু হতাশার এই খন্ড-খন্ড চিত্রই চোখে পড়বে! বাংলা সিনেমার পীঠস্থান যদি টালিগঞ্জ হয়, তাহলে চিৎপুর অবধারিত ভাবে বাংলা যাত্রা পালার পীঠস্থান, যাত্রা-পাড়া বলতে সবাই একডাকে চেনে এই চিৎপুরকে। বনেদি উত্তর কলকাতার চেনা ছবি এখানে সহজেই চোখে পড়ে যাবে। সুরু গলি, ঘিঞ্জি-রাস্তা, ট্রামলাইন, বাস, ট্যাক্সি, রিক্সা, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদির ভীড় সামলে রাস্তার দুপাশে ছোট্ট ছোট্ট কাউন্টার আছে। সেখানে রংবেরঙের পোস্টারের পসরা সাজিয়ে বসে আছে অসংখ্য যাত্রাপালার দল। এ আর এক কলকাতা, টুকরো টুকরো রঙিন ছবির কোলাজে সাজানো রঙিন একটা প্রাচীন পাড়া। সেই রং অনেকটাই ফিকে হয়ে নিজেদের বিনোদন সত্তাকে কোনো রকমে যেন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে আজকের চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। অনেকেই বলছে যাত্রার প্রধান ‘ভিলেন’ এখন যাত্রাধর্মী টেলিভিশনের মেগা সিরিয়াল গুলো! মনে হয় ঘরোয়া মানুষেরা বা গৃহবধূরা হয়তো বিনোদনের অন্য এক বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন এই 'মেগা সিরিয়ালে'! যাত্রার প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছেন তারা, আর আসছেন না মাঠ ভরাতে! যাত্রা নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে বাঙালিদের আর সেই উন্মাদনা চোখে পড়ে না আজকাল, বছর দশেক আগেও শীত পড়তে শুরু করলেই মফস্বল, গ্রাম তো বটেই, শহরতলিতেও ছেয়ে যেত যাত্রার রঙিন পোস্টার, খবরের কাগজে পাতা জুড়ে বের হতো যাত্রার রঙিন বিজ্ঞাপন, পথ চলতে কানে আসতো নাটকীয় ঢঙে মাইকে যাত্রার প্রচার। রথের দিন থেকেই উৎসব শুরু হয়ে যেত এই যাত্রাকে কেন্দ্র করে। কোন নায়ক-নায়িকা এবার কোন দলে যোগ দিয়েছেন, নতুন যাত্রার নাম গুলো ছড়িয়ে পড়তো মুখে মুখে, পুজোর পর-পরই যাত্রার আসর বসে যেত বিভিন্ন যায়গায়। চায়ের দোকান থেকে বাড়ীর অন্দরমহলে সর্বত্রই চলত যাত্রার অভিনয় বা গল্প নিয়ে কমবেশি আলোচনা৷ রীতিমতো আগে থেকে টিকিট কেটে যাত্রার আসরে ভীড় জমাতেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ, কখনও কখনও এমনও ঘটনা হয়েছে যে ভিড়ের চোটে যাত্রার প্যান্ডেলের গেট খুলে দিয়ে দর্শকদের ঢুকতে দিতে হয়েছে। তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল যাত্রার, কিন্তু আজ যাত্রা দেখার অভ্যেসটা মানুষ যেন কেমন হারিয়ে ফেলেছে! জমিয়ে শীত পড়লেও যাত্রার আসরগুলো সব ফাঁকাই পড়ে থাকছে! একটা সময়ে, ঘরে-ঘরে টেলিভিশন ছিল না, ছেলে বুড়ো সবার হাতে স্মার্টফোন ছিল না, সেই সময়ে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষের একঘেঁয়ে জীবন থেকে মুক্তির জন্য ছিল তিন দিক খোলা মঞ্চে লোকসংস্কৃতির এক অন্যতম বিনোদন ব্যবস্থা যাত্রা পালা। চড়া মেকআপ, হাই-ভোল্টেজ মেলো-ড্রামা, উচ্চ স্বরে অভিনয়, মানুষ মুগ্ধ হয়ে বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা। একসময়ে রমরমিয়ে চলা এই বিনোদন শিল্পের জনপ্রিয়তা হারানোর জন্য অনেকেই মুলত তাই টেলিভিশনকেই দায়ী করছেন! বিশেষত যাত্রা শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িয়ে আছেন এমন কলাকুশলীরা এমনটাই মনে করেন, অনেক কলাকুশলীরা আবার এই পরাজয়টা মানতেই পারছেন না, নানান তথ্য তুলে ধরে (অর্থনৈতিক মন্দা, নোটবন্দি) বলতে চাইছেন যাত্রা শিল্প ভালোই আছে, এখনও অনেক নতুন নতুন ছেলে মেয়েরা যাত্রায় অভিনয় করতে আসছে, আর ব্যবসাও নাকি নেহাত খারাপ হচ্ছে না। যাত্রার জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া নিয়ে যাত্রা জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের নানান মত উঠে আসলেও, একটা ব্যাপারে সকলেই একমত যে যাত্রার বাজার অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে মেগা সিরিয়াল। এখনকার গৃহবধূরা এমনকি পুরুষ মানুষদেরও অনেকে নিয়ম করে টিভি সিরিয়াল দেখেন, তাছাড়া বিনোদনের আরও অনেক মাধ্যম চলে এসেছে আজকের প্রজন্মের হাতের কাছে, তাই কিছুটা নয় অনেকটাই জনপ্রিয়তা কমেছে যাত্রার। ধৈর্য্য ধরে এখন আর কেউ যাত্রা দেখতে চান না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছেও আজ বিনোদনের অনেক মাধ্যম চলে এসেছে, যা যাত্রার জনপ্রিয়তা কেড়ে নিয়েছে অনেকটাই। যাত্রা শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন লোকের মতে, এখন বাড়ীতে বসেই বিভিন্ন সিনেমা বা সিরিয়ালে দর্শকরা বিভিন্ন ধরনের কাহিনী সহজেই দেখে ফেলছেন, আর যাত্রাতে সেই একই ধরনের কাহিনী দেখতে পয়সা খরচ করে তাই মাঠে কষ্ট করে আর যেতে চাইছেন না! যদিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে মানুষের চাহিদা, পাল্টে গেছে মানুষের রুচি, হয়তো বাংলার যাত্রাও তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে অনেকটাই নিজেদের পাল্টে নিয়েছে টিকিট বিক্রির আশায়! তাই হয়তো হাততালির ঝড় তোলা সংলাপের বদলে আমদানি হয়েছে, সিটি বাজানো, মঞ্চ কাঁপানো, স্বল্পবসনা মেয়েদের চটুল নাচ-গান, বেসুরো অর্কেস্ট্রা, যেখানে গল্প নেই, অভিনয় নেই, আছে শুধু যৌনতার হাতছানি! বাংলার পাঁচশ বছরের পুরনো এই লোকসংস্কৃতিকে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফেরাতে তাই শুধু যাত্রার কারিগরদের মানসিকতার বদল ঘটালেই চলবে না, একই সঙ্গে দর্শকদের মানসিকতার বদলেরও খুব প্রয়োজন ! তবুও একটা কথা বলতে হয়, শুধুই কি টিভির মেগা সিরিয়ালের সঙ্গে পাল্লা দিতেই যাত্রায় এতো অশ্লীলতা আমদানি করতে হয়েছে! তাই কি পাঁচ মিনিট অন্তর-অন্তর দক্ষিণী বা মুম্বই ঘরানার সিনেমার মতো সুযোগ বুঝে কাহিনির সঙ্গে মানানসই করে এইসব অশ্লীল নাচ গান যাত্রায় কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে! নাকি সোজা যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে, দর্শক টানার জন্যই স্বল্পবাস পরিহিতা, অভিনয়ের অক্ষর জ্ঞান শূন্য, সব নায়িকাদের হাজির করা হচ্ছে আজকাল যাত্রায়!! উত্তেজক ‘হট সিন’ দিয়ে যাত্রাকে সিনেমার সমতুল্য করে তোলার এই বৃথা চেষ্টা শুরু হয়েছে অবশ্যই, এতে কিন্তু আসলে হিতে বিপরীতই হচ্ছে !! আগে যেখানে সব বয়সের মানুষেরা বিশেষত গৃহবধূরাই ছিলেন যাত্রার দর্শক, আজকাল যাত্রার প্রচারের পোস্টার দেখে অনেকে সপরিবারে খোলা মঞ্চের দিকে পা বাড়াতেই লজ্জা পাচ্ছে! উঠতি বয়সের চ্যাংড়া ছেলেপুলেরা এসব গরম দৃশ্যের টানে আসছে বটে, কিন্তু এই অপসংস্কৃতির চোরা স্রোতে ডুবে যাওয়া যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কিন্তু ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে! চিৎপুরের আনাচেকানাচে এখন এই সমস্ত প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রখ্যাত পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন চিৎপুরের মুকুটহীন সম্রাট, একের পর এক সফল পালা তিনি রচনা করে গেছেন, যেমন নাচমহল, অশ্রু দিয়ে লেখা, মীনাবাজার, ক্ষুধিত হারেম, দেবী সুলতানার মতো অসংখ্য ঐতিহাসিক যাত্রাপালা, তেমনই রচনা করেছেন অচল পয়সা, বর্ণ পরিচয়, ময়লা কাগজের মতো অনেক সফল সামাজিক যাত্রাপালা। তাঁর 'মা মাটি মানুষ' যাত্রা পালার স্লোগান তো ইতিহাস রচনা করেছে! আজকের প্রজন্মের কতজন ছেলে-মেয়ে জানে এই প্রতিভাধর পালাকারের নাম! এক সময় কাটোয়া, পাটুলি, পূর্বস্থলী, কালনা, বর্ধমান, রানিগঞ্জ, আসানসোল, ইত্যাদি অনেক গ্রাম-গঞ্জে অসংখ্য ভালো ভালো যাত্রাদল ছিল, অনেক গ্রামেই তখন বসত অপেশাদার যাত্রাভিনয়ের প্রতিযোগিতার, সেরা অভিনেতাকে সোনার মেডেল উপহার দেওয়াও হত, এখন এসবই অতীত! যাত্রায় সে যুগে মুলত ব্যবহার হতো ডুগি-তবলা, হাত-ঢোল, ক্ল্যারিওনেট, খঞ্জনি, ফুলোট আর আড় বাঁশি, সুরে আর গানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দর্শকরা বসে থাকত সারারাত। সে সময় বড়ো বড়ো যাত্রা হতো সারারাত ধরে, এখন দৈর্ঘ্য কমতে কমতে বড়জোর দু-আড়াই ঘণ্টায় এসে দাঁড়িয়েছে, তবু দর্শকরা মাঝপথে উঠে চলে যাচ্ছে৷ জমিদারি আমলে ঝাড়বাতির আলোয় যাত্রাপালা অভিনীত হত, পরে আসে হ্যাজাকের আলো, বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে ডেলাইটের প্রচলন শুরু হয়, মঞ্চের চার কোণের চারটে ডেলাইটে আলোকিত হয়ে উঠত যাত্রার মুক্ত মঞ্চ৷ আটের দশকেও এই ডেলাইটের চল ছিল গ্রামের দিকে, তার পর থেকেই শুরু হয় বৈদুত্যিক রঙিন আলোর ব্যবহার৷ মঞ্চে ব্যবহার শুরু হয় স্টেজ মাইক ও মাইক্রোফোনের, আসে ইকো আর যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য ক্যাসিও, আর এখন তো বার ডান্সারদের নাচের পরিবেশ তৈরী করতে উপযোগী আলো আর ডিজিটাল ডলবি সাউন্ড এসে গেছে! যাত্রার প্রথম যুগে পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতে আসতেন, তাদের বেশ নামডাকও ছিল, ধীরেধীরে পেশাদারি অভিনেত্রীরা সেই স্থান দখল করে নেন ৷ তারপর শুরু হয় দর্শক টানতে নামীদামি ফিল্ম স্টারদের যাত্রায় নিয়ে আসার হিড়িক! তাতে সাময়িক চাহিদা বেড়ে ছিল ঠিকই কিন্তু সেটা আর যাত্রা হয়ে উঠেছিল না! নিছকই গ্ল্যামার প্রদর্শনী হয়ে উঠেছিল ! ফিল্মস্টাররা যাত্রা করায় যাত্রার মান বেড়েছে না কমেছে এটা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে কিন্তু যাত্রার কৌলিণ্য যে হারিয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়! এই দাবি অবশ্য উড়িয়ে দিতে চান বাংলার চলচ্চিত্র অভিনেতা অভিনেত্রীরা, তাদের মতে ফিল্মস্টার থাকলে, যাত্রার টিকিটের চাহিদা অনেকটাই বাড়ে, হয়তো অনেকাংশেই এটা সঠিকি, কারণ ফিল্মস্টারদের দেখার জন্য অনেক বেশি আকর্ষণ তৈরী হয়! তবে যাত্রা জগতের প্রবীণ শিল্পীদের মতে, ফিল্মস্টারদের নিয়ে যাত্রা বেশিদিন চলবে না! এটাও বাস্তব সত্য যে এই মুহূর্তে যাত্রায় সেরকম ভাল স্টার আর্টিস্ট নেই আগের মত, যাদের নাম শুনেই মানুষ ভীড় করবে যাত্রা দেখতে। এর যথেষ্ট কারণও আছে, যাত্রার জন্য সেরকম কোনও ওয়ার্কশপ হয় না, ভাল চিত্রনাট্যকারও সেরকম নেই আগের মতো। যাত্রা মানেই জানতাম একটু চড়া মেকআপ, উচ্চ স্বরে মেলোড্রামা, চমকে দেওয়া সংলাপ, সেরকম যাত্রাপালার নামগুলোও ছিল আলোড়ন সৃষ্টি করা, মানুষের মুখে মুখে ঘুরত । আর এখন নতুন কিছু ভাবার বা দেওয়ার মতো সময় কারও নেই, হয়তো কারও কোনও ইচ্ছেও নেই! অনেকের মতে, যাত্রার নিজস্ব ঘরানা ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টা করাটাই ভুল হয়েছিল ! একটা সময়ে যাত্রা ছিল অত্যন্ত চড়া ধাঁচের কিন্তু এখন আর সেরকম হয় না, যাত্রার পরিকাঠামো পালটে গেছে দর্শকসংখ্যা কমে গেছে, উপস্থিত পাঁচ-সাত হাজার দর্শক যাতে সংলাপ ঠিকঠাক শুনতে পান, সেজন্য উচ্চগ্রামে কথা বলা হতো, এখন দর্শক কমে গেছে, এসে গেছে ঝলমলে আলো, এসে গেছে স্টেজ মাইক তাই আর উচ্চ স্বরে অভিনয় করার প্রয়োজন হয় না। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভাল স্ক্রিপ্টেরও এখন খুব অভাব যাত্রায়। এক সময়ের টালিগেঞ্জর বাংলা ছবির মতো এখন যাত্রাতেও দক্ষিণী বা মুম্বই এর ছবির অনুকরণ চলছে। মারকাটারি মুম্বই মার্কা গল্প বানাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের যাত্রায় মুম্বইয়ের ডাকসাইটে অভিনেতা অভিনেত্রীদেরও দেখা গেছে মাঝে মাঝে, বেশ কয়েক বছর আগে জিনাতামন, রবীনা ট্যান্ডন, শক্তি কাপুর বা পদ্মিনী কোলাপুরীর মতো বলিউডের স্টার অভিনেতা অভিনেত্রীদের এনে পশ্চিমবঙ্গের যাত্রামঞ্চে দর্শক টানার চেষ্টাও করা হয়েছে! আজও চিৎপুরে প্রতিটা ব্যস্ত দিনে নিয়মমাফিক রংবেরঙের পোস্টার সাজিয়ে বসে থাকেন বিভিন্ন দলের ম্যানেজার বা কর্মকর্তারা কিন্তু দিনের শেষে তাদের মন বা পকেট কোনোটাই ভরছে না ! অধিকাংশ ম্যানেজারেরই বক্তব্য, 'লোকসানে চলছে চিৎপুর, কোনওরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে যাত্রাপাড়াকে' ! এমনকী এখন টিকিট বিক্রি করে যাত্রা শো নাকি খুব কমই হয়, অধিকাংশ যাত্রাই ফ্রি-তে আজকাল কল-সো করা হচ্ছে, যা আর্থিক এবং মানসিক দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতিকে।
অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের কিছু কর্মকর্তার মতে যাত্রাদলের সংখ্যা নাকি আগের থেকে সংখ্যায় অনেক বেড়েছে! কিন্তু যাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর পরিস্কার করে পাওয়া যায় নি! ফিল্মস্টারদের ভিড়ে কি 'যাত্রা' তার নিজস্ব যাত্রা-স্টারদের হারিয়ে ফেলেছে ! রুমা দাশগুপ্ত, স্বপন কুমার, শ্যামল চক্রবর্তী, অনল-কাকলির পর আর কোনো নাম সেই কারণেই হয়তো আর উঠে আসেনি। যাত্রা জগতে একটা শূন্যতা তৈরী অবশ্যই হয়েছে, তবে একটা ব্যাপারে সবাই একমত যে যাত্রার মৃত্যু হবে না কখনও। সম্প্রতি সরকারি ভাবে অনেক উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু যাত্রাপাড়ার পরিকাঠামো যতক্ষণ না উন্নত হচ্ছে, যতক্ষণ না গুণগত মান বাড়ছে, যাত্রা শিল্প যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজের পায়ে না দাঁড়াতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যাত্রা শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানো কিন্তু খুব কঠিন। রাজ্য সরকারের সাহায্য যাত্রাশিল্পকে অনেকখানি চাঙ্গা করেছে, পরিকাঠামো উন্নত করার চেষ্টাও চলছে, যাত্রার অনুমতি নেওয়া এখন তুলনামূলক অনেক সহজ করা হয়েছে, একশ টাকা অবধি টিকিট এখন সম্পূর্ণ করমুক্ত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি এখন প্রতি বছর যাত্রা উৎসবের আয়োজন করছে। যাত্রা শিল্পকে সগর্বে ফিরিয়ে আনতে একটা লড়াই অবশ্যই শুরু হয়েছে। বিভিন্ন অপেরার সঙ্গে যুক্ত প্রায় কুড়ি হাজারের বেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্য সরকারি তরফে বার্ষিক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এই ভাতার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় নয় হাজার টাকার মতো ৷ এছাড়াও চালু করা হয়েছে বিভিন্ন পুরস্কার, তপনকুমার পুরস্কার (এক লক্ষ টাকা), বীণা দাশগুপ্তা পুরস্কার (পঞ্চাশ হাজার টাকা)। দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য গঠন করা হয়েছে তহবিল। তবু চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় ঘুরলে কানে আসবে হতাশার এক করুন সুর! কানে আসবেই কয়েকটি লাইন... "আজীবন পরিশ্রম করে ভালোবেসে একটা শিল্প মাধ্যম্যকে আঁকড়ে পড়ে থেকে কি পেলাম! না টাকা-পয়সা না সম্মান"..... সত্যি এটাই বাস্তব, আমাদের সমাজও এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবে না, টালিগেঞ্জর সিনেমা আর্টিস্টদের কথা ছেড়েই দিলাম, সবার কথা বলছি না তবু টেলিভিশনের সেইসব নিম্নমানের সিরিয়ালের শিল্পীদের তুলনায় কিন্তু যাত্রা শিল্পীরা জনপ্রিয়তায় অদ্ভুত ভাবে সব সময়ই পিছিয়ে, তাই হয়তো তাদের ডাক পড়েনা কোনো অনুষ্ঠানের ফিতে কাটতে!! দেখা যায়না কোনো নেতা-মন্ত্রী সাথে এক মঞ্চে!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours