গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

একবার পরাক্রমশালী মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব শাহজাদী জাহানারার পোশাক দেখে অত্যন্ত অবাক ও বিরক্ত হয়ে, রাগত স্বরে তাকে বলেছিলেন:- "মোগল সাম্রাজ্যে কি কাপড়ের অভাব হয়েছে, এমন পোশাক পরেছো যে তোমার গা দেখা যাচ্ছে" ! আসলে শাহজাদী জাহানারার সেদিনের পোশাক ছিল আব-ই-রাওয়ান নামের এক মসলিন কাপড়ের তৈরী, যা ছিল অদ্ভুত রকমের সূক্ষ্ম আর এতটাই  মিহি যে হয়তো রক্ষণশীল মোগল সম্রাটের চোখে কাপড়ের আভরণ থাকা সত্তেও নিরাভরণ মনে হয়েছিল!   এসবই অবশ্য প্রচলিত গল্প, সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা করে লেখা! কিন্তু এখানেই শেষ নয় বহু গল্প আছে বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের প্রতীক এই মসলিন নিয়ে।  ছোটবেলায় অবাক হয়ে শুনতাম, মসলিনের কাপড় নাকি এতোটাই সূক্ষ্ম ছিল যে আস্ত একটা কাপড় একটি আংটির ভেতর দিয়ে গলে যেতো, কিম্বা দৈর্ঘ্য-প্রস্তে পূর্ণ মাপের একটা আস্ত শাড়ি ঢুকে যেত ছোট্ট একটি দেশলাইয়ের বাক্সে, চোখ বন্ধ করে ভাবতাম কি করে সম্ভব! বিভিন্ন বিদেশী পর্যটক এবং ঐতিহাসিকদের লেখা থেকেও মসলিন কাপড় সম্পর্কে নানান চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে।  'ইন্ডিয়া অফ এনসিয়েন্ট এন্ড মিড্ডিল্ এজ' বইটিতে পাওয়া যায়, বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দি খাঁর সব থেকে পছন্দের মসলিন ছিল আব-ই-রওয়ান জাতের এক অত্যন্ত সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়। ফরাসী ভাষায় আব-ই-রওয়ান কথার অর্থ হলো 'সকালের শিশির' , সকাল বেলার শিশির যে ভাবে আলতো ছোঁয়ায় ঘাসের গায়ে লেগে থাকে, পালকের মতো মসলিন কাপড়ও সেই ভাবে মানুষের শরীরে লেগে থাকে, হয়তো সেই করনেই  এই কথাটা চালু হয়েছে! এই ব্যাপারেও একটা প্রচলিত গল্প আছে, সম্রাট আলিবর্দি একবার তার ব্যবহারের সুদীর্ঘ একটি মসলিনের কাপড় ঘাসের ওপর বিছিয়ে শুকোতে দেন, কিন্তু সেই সূক্ষ্ম অথচ সুদীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে শিশির ভেজা ঘাস থেকে আলাদা করতে না পেরে একটা গরু ওই মসলিন কাপড়টি খেয়ে ফেলেছিল! এরপরের গল্পটা অবশ্যই খুবই দুঃখজনক, গরু এবং গরুর মালিক দুজনকেই এইজন্য শাস্তি পেতে হয়েছিল।  যাইহোক বলা যেতে পারে, মসলিন কাপড়কে নিয়ে প্রচলিত এতো সব গল্প তৈরী হওয়ার পেছনে ছিল অবশ্যই মসলিনের জগত-জোড়া খ্যাতি। জন ফোর্বস ওয়াটসনের লেখা বই 'দ্য টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অব ইন্ডিয়া' যেখানে বিস্তারিত ভাবে মসলিনের অনেক সুন্দর নমুনার কথা বলা হয়েছে, মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা, গ্রিক পর্যটক পিনটনি, টেইলর, উরে প্রমুখের লেখায় তাই বাংলার মসলিনের বর্ণনা উঠে এসেছে আলাদা আলাদা চমৎকার বৈশিষ্ট্য নিয়ে।  ইতিহাস থেকেই জানা যায়, এই মসলিন কাপড়ের ঐতিহ্য বহু বছরের পুরানো, মুঘল আমলে ঢাকা যখন বাংলার রাজধানী হয় তখন থেকেই এই মসলিনের সুখ্যাতি সর্বপ্রথম ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশ-বিদেশে।
দিল্লির ন্যাশনাল হ্যান্ডিক্র্যাফটস অ্যান্ড হ্যান্ডলুম মিউজিয়ামে মসলিনের অসাধারণ কিছু সংগ্রহ রাখা আছে, কলকাতা বা জয়পুরের অনেক বিখ্যাত মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহেও এই মূল্যবান মসলিন কাপড় সংরক্ষণ করে রাখা আছে, মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়িতেও শোনা যায় মসলিনের সুন্দর সব সূক্ষ্ম কাপড়ের সংগ্রহ রাখা আছে, যদিও এইসব প্রাচীনকালের কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া মসলিন কাপড় হাতে ধরে দেখার সুযোগ নেই। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে বহু যত্নে সাজানো আছে নানান কারুকাজে উজ্জ্বল হয়ে থাকা মসলিন, শুধু কাচের বাইরে থেকেই দেখে চোখের আরাম করে সন্তুষ্ট থাকতে হবে! আজ আর প্রচুর টাকা দিলেও সেই ধরণের মসলিন পাওয়া সম্ভব নয়!  'ঢাকাই মসলিন' হিসেবে বাংলার মসলিন কাপড় সারা পৃথিবীতে সমাদৃত হলেও, 'মসলিন’ শব্দটি কিন্তু খাঁটি বাংলা শব্দ নয়। কোন ভাষা থেকে কিভাবে মসলিন শব্দটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তা নির্ণয় করাও খুব দুরূহ কাজ, তবে কিছু ইংরেজ ভাষাবিদের দাবি অনুসারে ‘মসলিন’ শব্দটি এসেছে ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় ব্যবসাকেন্দ্র মসুলের নাম থেকে, মুসলমান শাসনকালে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ভারতের এক নিবিড় যোগাযোগ ছিল, তার প্রমাণ ভারতের অধিকাংশ স্থাপত্যকলায় খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক বা ইরানের স্থাপত্যের ছাপ তো খুঁজে পাওয়া যায় ই।  ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে তখন এই মসুলের বেশ খ্যাতি ছিল, শোনা যায় তখন মসুলেও এক ধরনের সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি হত, মসুল থেকে ঢাকায় কাপড়ের কারিগরদের আসা যাওয়া তাই অসম্ভব ছিল না, হয়তো এই ভাবেই মাসুল থেকে 'মসলিন' শব্দের সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে!  সে যাই হোক সে যুগে মসলিনের কাপড় তৈরির জন্য কিন্তু বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর, আর এই জঙ্গলবাড়ি থেকেই কিছু দূরে বাজিতপুরে জন্মাতো এক উচুঁমানের কার্পাস তুলা, যার নাম 'ফুটি কার্পাস', মেঘনা নদীর তীরেই মনে করা হয় সবথেকে ভালো 'ফুটি কার্পাস' তুলার গাছ দেখা যেতো।  কাপাসিয়া জায়গাটির নাম নাকি এসেছে এই কার্পাস শব্দ থেকেই। এই ধরনের কার্পাস গাছ অন্যান্য তুলোর গাছ থেকে ছিল কিছুটা স্বতন্ত্র, এই কার্পাস ফুল ফোটে অদ্ভুত ভাবে মাটির দিকে মুখ করে যা অন্যান্য তুলা ফুল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, তাই হয়তো প্রাকৃতিক সবরকম ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়ে এই তুলা ফুল তার অনন্য গুণ বজায় রাখতে পারত, এই ধরনের তুলোর চাষের পদ্ধতিও অনেক আলাদা ছিল, বছরে দুবার এই ফুটি কার্পাস তুলা চাষ করা যেতো। এই ফুটি কার্পাস তুলা থেকে প্রস্তুত অত্যন্ত মিহি আর সূক্ষ্ম সুতা দিয়েই তৈরি হতো মসলিন আর সেই যুগের অনবদ্য 700 থেকে 800 কাউন্টের সেই ঢাকাই মসলিন আজ ইতিহাস।  আজকের যুগে সাধারণত 60 থেকে 80 কাউন্টের সুতোর ব্যাবহার হয় শাড়ি বা বিভিন্ন সুতি বস্ত্র তৈরীতে তাই সহজেই অনুমান করা যায় যে, তাহলে কতো মসৃন সূক্ষ্ম আর হালকা ছিল এই মসলিনের কাপড়গুলো। মসলিন যেন এই পৃথিবীর জিনিসই নয়, স্বর্গীয় কোনো বস্ত্র।  মসলিন ছিল সেসময় বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের প্রতীক। জানা যায় ঢাকায় প্রায় সাতশ ঘরের মতো মসলিন কারিগর ছিলো, যারা দিনের পর দিন ধরে শৃষ্টি করতেন এক-একটি অনন্য সুন্দর মসলিন।  মসলিন কাপড় বুনতেন সাধারনত পুরুষরা আর মেয়েরা সুতা কাঁটা আর সেই সূক্ষ্ম সুতা তোলার কাজগুলো করতেন,  এমনকি পরিবারের শিশুরাও এই কাজে সাহায্য করতো।  এই সূক্ষ্ম সুতার কাজ করার জন্য আদর্শ আবহাওয়ার প্রয়োজন হতো, কম তাপমাত্রার ও আর্দ্রতায় একেবারে ভোর বেলা আর বিকালের পরে এই মসলিন তৈরীর কাজ করা হতো। কোন কোন মসলিনে ছুঁচের বা চিকনের সুন্দর সুন্দর কাজও ফুটিয়ে তুলতেন দক্ষ কারিগররা।  মসলিনের মূল্য নির্ধারিত হত সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর নকশার  বিচারে, সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি হালকা মসলিনের কদর ছিল সবথেকে বেশি, স্বাভাবিক ভাবেই তার দামও ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে! সূক্ষ্ম কাজ আর স্বচ্ছ মানের ওপর ভিত্তি করে মসলিনের নামকরণও হতো ভিন্ন ভিন্ন, যেমন নকশা করা এক ধরনের মসলিনকে তখন বলা হতো 'জামদানি', কিন্তু আজকের জামদানির সাথে সেই মসলিন জামদানির কোনো তুলনাই হয় না। একটা মসলিনের কাপড় তৈরি মানে একটা দীর্ঘ আর কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া, ফুটি কার্পাস তুলা থেকে পাওয়া সুতাকে ওজন করা হতো 'রতি'তে, তারপর সুতোর ওজন অনুযায়ী তাদের ভাগ করা হতো, এক রতি ওজনের সুতার দৈর্ঘ্য দাঁড়াত প্রায় একশো থেকে একশো পঞ্চাশ হাতের মতো, যে সুতা লম্বায় যত বেশি আর ওজনে যতো কম তার সূক্ষ্মতাও তত বেশী হতো, সুতা কাটার পর সেই সুতা থেকে হাতে চালানো তাঁতেই তৈরি হতো মসলিন কাপড়, একেকটি মসলিন তৈরিতে দীর্ঘদিন লেগে যেতো, সাধারণভাবে এক টুকরো ভালো মসলিন তৈরি করতে শোনা যায় একজন তাঁতির ছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতো। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ওই মসলিন কাপড়ে নানান নকশা, ফুলের কাজ করতে তারপর আরো কিছু সময় লেগে যেতো। রঙ আর বুননের উপর ভিত্তি করে মসলিনকে ডোরাকাটা, মসৃণ, চারকোণা বিশিষ্ট ছককাটা আর রঙ করা এইরকম বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হতো, আবার তাদের বিভিন্ন নবাবি নামও ছিল যেমন ‘আব-ই-রওয়ান’, ‘শবনম’, ‘সরবন্দ’ ইত্যাদি, শোনা যায় সোনার জরির কাজও করা হতো এই মসলিন কাপড়ে সম্রাট আর নবাবদের জন্য। মোগল সম্রাট এবং তার পরিবার পরিজনদের কাছে মসলিন ছিল তাদের কৌলিণ্য আর আভিজাত্যের প্রতীক। মোগল সম্রাট এবং তার পরিবার পরিজনের জন্য বিশেষভাবে তৈরী করা মসলিনের নাম ছিল ‘মলবুল খাস’, বাংলার সুবাদারদের জন্য আবার তৈরি করা হতো ‘সরকার-ই-আলা’ নামের মসলিন।  জানা যায় মুর্শিদকুলী খানের আমলে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় লক্ষ টাকার ‘মলবুল খাস’ মসলিন মোগল সম্রাটের দরবারে ভেট পাঠানো হতো।

শিল্প বিপ্লবের ফলে ম্যানচেস্টার যখন বস্ত্রশিল্পের জন্য পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ, তখনও কিন্তু সূক্ষ্মতা বা সৌন্দর্যে বিচারে ম্যানচেস্টারের বিদেশি কাপড় মসলিনের ধারেকাছেও আসতে পারে নি!  তবু বাজার দখলের লড়াইয়ে ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে কলের তৈরী কাপড় এই তাঁতে বোনা মসলিন কাপড়কে পেছনে ফেলে রেখে!
ঢাকা আর সোনারগাঁয়ের শ্রেষ্ঠ তাঁতিদের হাতেই বোনা হতো এইসব বিশেষ ধরনের শ্রেষ্ঠ মসলিন।ঢাকার সবচেয়ে দক্ষ তাঁতিদের নিযুক্ত করা হতো মোগল তাঁতখানায়, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সেই তাঁতখানায় তাঁতিদের মজুরি ছিল ভয়ংকর রকমের কম, আর তাদের সমস্যা আরও ছিল, মোগল তাঁতখানায় কাজে একবার নিযুক্ত হলে বাইরের কাজ করবার কোনো সুযোগ পাওয়া যেত না, বলা ভালো সামান্য মজুরিতে তাদের জবরদস্তি আটকে রেখে সারাদিন প্রচুর কাজ করিয়ে নেওয়া হতো অথচ এই তাঁতিদের বোনা মসলিন যখন বাংলা থেকে মোগল দরবারে পাঠানো হতো, আর সেই মসলিনের অভিনবত্বের প্রশংসা করে পুরষ্কার দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে, সেই পুরষ্কারের ছিটেফোঁটাও তাঁতিদের ভাগ্যে জুটতো না কখনো! এমনকি মোগলদের অত্যাচারী কর্মচারীরা তাঁতিদের ন্যায্য মজুরির টাকাও আত্মসাত করে দিত বেশিরভাগ সময়।  জন টেলরের লেখাতেও তাঁতিদের পরিশ্রমের ফসল ‘মলবুল খাস’ নামক মসলিনের মজুরির টাকা আত্মসাতের এই কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। মসলিন তৈরির এই পরিশ্রমসাধ্য কাজটি করতে তাঁতিদের দিনে আট থেকে দশ ঘণ্টা কাজ করতে হতো, ভোর থেকেই শুরু হয়ে যেত তাঁত বোনা। একজন ওস্তাদ তাঁতি একখণ্ড মসলিন তৈরির জন্য যা বেতন পেতো, তা দিয়ে বার্ষিক বড়জোর সর্বোচ্চ ষাট-সত্তর মণ চাল কেনা যেত! তার মানে এটাই প্রমাণ হয়, মসলিন তাঁতিদের তাঁত বুনে কোনোমতে শুধু দু-মুঠো অন্নই যোগাড় হতো!  এই আয়ও আবার দিনে দিনে বাড়ার বদলে ক্রমাগত কমেছে!  হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল মসলিনের সুফল কোনোদিনও ভোগ করতেই পারেনি কিন্তু হতভাগ্য এই মসলিন তাঁতিরা!
এই মসলিন বস্ত্রের প্রচলন বহু প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে থাকলেও ঢাকাই মসলিন কিন্তু মোগল আমলে এসেই সবথেকে বেশি প্রসিদ্ধ হয়। মোগল আমলেই ঢাকাই মসলিন বিদেশের বস্ত্র-বাজার প্রায় একচেটিয়া ভাবে দখল করে নেয়, 1798 এ প্রকাশিত জেমস টেলরের 'ট্রপোগ্রাফি অব ঢাকা' বইয়ে, ঢাকাই মসলিন রপ্তানির বিষয়টি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল,  সতেরো শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজরাও মসলিনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলো, ওই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা, যেমন ওলন্দাজ ও ফরাসি কোম্পানিগুলোও ঢাকা শহরে বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরী করে মসলিন কাপড়ের ব্যাবসা কেই মুলত কেন্দ্র করে, আর এইভাবেই বাংলাদেশের মসলিন রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছিল। এই মসলিন রপ্তানি হতো ইউরোপ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমনকি মিশর হয়ে রোমের সুন্দরী নারীর প্রিয় পোশাক হয়ে উঠেছিল এই ঢাকাই মসলিন একসময়। তবুও এটা অনস্বীকার্য যে সতেরো শতকে এসে মুঘলদের হাত ধরেই মসলিন শিল্প সবথেকে বিকাশ ও খ্যাতি লাভ করেছিল বাংলাদেশে।  একটি তথ্য থেকে পরিস্কার হয়, সেই কারণে 1757 তে পলাশীর যুদ্ধের বছরেও ইংরেজরা প্রায় আট লাখ টাকার মসলিন রপ্তানী করতে পেরেছিল বিদেশে, সেই সময়ে ফরাসিরাই নাকি কিনেছিলো প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। তাছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশী ব্যবসায়ীরাও রমরমিয়ে এই মসলিনের ব্যবসা করতেন। পরবর্তী সময়ে মসলিন রপ্তানী ব্যবসার প্রায় পুরোটাই জোর করে দখল করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি, তাদের সময় মসলিন রপ্তানী হতো মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে।  দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভারতবর্ষে  ইংরেজদের আগমন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেই কিন্তু শুরু হয় মসলিন শিল্পের চরম অবনতি। ভারতবর্ষে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের পর থেকে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকেরা বাধ্য হয়ে ভারত থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করে।  মসলিন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয় শুধু ইংরেজ বণিকদের একচেটিয়া আধিপত্য। এরপর অত্যাচারী ইংরেজ ব্যবসায়ীরা পাইক-পেয়াদা নিয়োগ করে, বল পূর্বক মসলিন সংগ্রহ শুরু করে। আরও মর্মান্তিক ঘটনা ছিল, মসলিন তৈরীর সুতা কিনতে সে সময় তাঁতিদের উচ্চ সুদে ধার দেওয়া হতো, তারপর সুতা কিনে দীর্ঘ সময় ধরে মসলিন তৈরী করার পর তাঁতিদের সুদের অর্থ আকাশ ছুঁয়ে ফেলত, তখন কষ্টের তৈরী সবটুকু মসলিন বুঝিয়ে দিয়েও প্রচুর দেনা থাকে যেতো, বাঁধা পড়ে থাকতে হতো তাঁতিদের আজীবন ইংরেজদের কাছে!সময়মতো মসলিন যোগান দিতে না পারলে আবার তাঁতিদের উপর অকথ্য অত্যাচারও করা হতো! এছাড়াও ইংরেজদের অন্যান্য অত্যাচার তো লেগেই ছিলই ! লোকশ্রুতি আছে ইংরেজরা দক্ষ মসলিন তাঁতিদের হাতের আঙ্গুল কেটে নিয়েছিল যাতে তারা আর মসলিন বানাতে না পারেন! ইউরোপের কারখানার তৈরী নিম্নমানের মসলিনের মতো কাপড়ের ব্যাবসা বা চাহিদা তৈরী করতেই নাকি এই জঘন্য অপরাধ করা হয়েছিল!  তবে এই তথ্যের ঐতিহাসিক কোনো দলিল বা সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি।  ম্যানচেস্টারের শিল্প বিপ্লবের পর ইংরেজদের যেমন ব্যবসার গতিপথে আমূল পরিবর্তন ঘটে বাংলাদেশের মসলিনের উপর নির্ভরতা অনেক কমে আসে আবার একইসঙ্গে মোগল শাসনের জৌলুস বা দাপট কমে যাওয়ার ফলে, মোগল তাঁতখানার অভিজ্ঞ তাঁতিরা কর্মহীন হয়ে দারিদ্র্যে আর অনাহারে পেশা পরিবর্তন করে ফেলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন স্থানীয় রাজা এবং মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতায়  চলা তাঁতখানা গুলো নীরব হয়ে যেতে শুরু করে, এর ফলে সেই অভিজ্ঞ আর দক্ষ তাঁতিদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান তাদের পরের প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরের সুযোগও কমে যায়, তাদের বংশধররাও ক্রমশ ভুলে যায় মসলিন তৈরীর সব সূক্ষ্ম কলা-কৌশল।  এরপর বাংলায় বিশেষ করে ঢাকার আশেপাশের মসলিনের তাঁতখানা গুলো বন্ধ হতে শুরু করায়, মসলিনের প্রধান কাঁচামাল ফুটি কার্পাসের চাহিদাও একদম কমে যায়, ফলে ওই সব জমিতে শুরু হয়ে যায় বিকল্প চাষাবাদ। এরপরও কিছুদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও একসময় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় একে একে মসলিন বোনার তাঁতঘর গুলো!  হারিয়ে যায় কিংবদন্তির সোনালী মসলিন, বলা ভালো ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই  করতে করতেই ধীরে ধীরে হঠাৎ এক সময় স্বর্গীয় মসলিন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায় বাংলার বুক থেকে!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours