কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

আচ্ছা ছাতিম বল তো,
পথের শেষ কোথায়?

এই তো আবার ফুরিয়ে গেল একটা বছর। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের কাঁদা, হাসা, যোগ বিয়োগ সব। কত মানুষ, আর কতোই না তাদের স্মৃতি। সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে চলা। ক্যালেন্ডারের পাতায় অন্য আরেক নগ্নিকার ছবি। সেও নশ্বর। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মার্চ। তারপরেই 'মারকাটারি' নগ্নিকা ডাস্টবিনে। সবাইকে পেছনে ফেলে শুধুই নিজের এগিয়ে চলা।
এক পথ শেষ হলেই আর এক পথের শুরু। অন্য পথ অন্য জীবন। জীবনের পথ শেষ যেখানে, সেখানেই শুরু মৃত্যুর পথ। আর মৃত্যুর পথের শেষে? যুগ যুগান্তর ধরে নানা পুঁথিতে মাথাঠুকে চলেছে মানুষ। আদি অনন্তের এ এক চিরজিজ্ঞাসা- "পথের শেষ কোথায়/ কী আছে শেষে..."

"পথে এবার নামো সাথী," হাঁক দিলেন বিপ্লবীরা। "পথে হবে এপথ চেনা।"
পথ ঠেলতে ঠেলতেই সমুখ পানে এগিয়ে চলা। কিন্তু এই বীরপুরুষের দল পিছিয়ে পড়লো বলেই তো মনে হয়। পেছনদিকেও যে এগনো যায় তা শহরের বাসযাত্রীমাত্রই জানেন। বাসের পাদানি বেয়ে একবার ভেতরে পা রাখলেই হলো।
- "পেছন দিকে এগিয়ে যান দিদিরা দাদারা।" কন্ডাক্টরের হাঁকডাক।
ওই বিপ্লবীরাও সেই কন্ডাক্টরের কথা রেখে পেছনদিকে এগিয়ে গেছিলেন কিনা, তা তাঁরাই বলতে পারবেন।

মোটকথা এগিয়ে চলা।
দে ছুট দে ছুট। ঠিক যেন ডিসেম্বরের শীত। এবার যেন ঝুপ করেই শীত নেমেছিলো কলকাতার বুকে। শীতের দুরন্তপনা। শীতের শহর কাঁপে ঠকঠক। তবু চঞ্চল ময়দান, ভিক্টোরিয়া, প্রিন্সেপ ঘাট। চলেছে ব্যস্তসমস্ত উষ্ণতার খোঁজ। প্রতিবারের মতো এবারেও বিজ্ঞজনের মন্তব্য- এমন শীত বহুযুগ পর।
মধ্যবিত্তের উল্টো চরিত্র শহুরে শীতের। ঠিক যেন রায়বাহাদুরের সেই বাউন্ডুলে ছেলে। হিসেব কিতেবের ধার ধারে না। দুহাতে সঞ্চয় ওড়ায়। একেবারে চটজলদি নিজেকে উজাড় করে, দেউলিয়া হয়ে যাওয়া। তারপরেই উধাও।
নাকি শীত তরুনীর যৌবন? কুড়িতেই বুড়ি ! ক্ষণস্থায়ী।
চল ছাতিম, ময়দানের শিশিরভেজা ঘাসে বসে আবৃত্তি করি। তুইও গলা মেলাবি। দুজনে মিলে আরও একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে উচ্চারণ করবো শক্তিদার সেই আর্তি- "প্রভু নষ্ট হয়ে যাই।"

আচ্ছা ছাতিম বল তো, শীতের এই চরম দাপাদাপিতেও কাবু হয়না কেন শহরের বিয়েবাড়ির মামনিরা? কোথার থেকে আসে এতো উষ্ণতার ঝাঁজ? হাত পেট পিঠকাটা ব্লাউজ। গায়ে জমকালো শাড়ি। ব্যাস। শীতের সাধ্য কী যুবতীর গা ছোঁয়? কেস খেয়ে যাবে না?
দুষ্টুরা অবশ্য অন্যকথা বলে, যৌবনের গরম। সেই গরমের আঁচ পেতে ঘুরঘুর কতশত কুমারের। কুমারীরাও অপেক্ষা করে, উত্তেজনার সোহাগের সেই রেনু আদুল গায়ে মেখে নিতে।
তবে ছেলেরাও আজকাল পিছিয়ে নেই। ছ'প্যাক, আট প্যাকের শরীর দেখাতে তারাও যেন শীতকে তুড়ি মেরে ওড়ায়। ছেলেমেয়ে সবাই যেন নষ্ট হতে চায় প্রতিটা শীতসন্ধ্যায়।

পঁচিশে ডিসেম্বর থেকেই শহরে শীতোৎসবের হাট। বড়দিন পেরোলেই নববর্ষ। এরইমধ্যে সূর্যগ্রহণ। পিকনিক। টুকটাক ঘুরতে যাওয়া।
জোড়ায় জোড়ায় শহরের রাস্তা নরক গুলজার। ভিক্টোরিয়ায় ঢোকাতে বারণ নেই। নিষেধ চোখ ঘোরানোয়। তাতে আপনিই অস্বস্তিতে পড়তে পারেন। সর্বজনের আহ্বান মহারানির নন্দনকাননে। কিন্তু সেখানে এমন 'লাইভ পর্নো' যা দেখেই মনে পড়ে যায়- 'হমকো চাহিয়ে আজাদি।'
কিসের আজাদি?

তোর মনে পড়ে ছাতিম, চীনের বেজিং শহরে তিয়ানানমেন স্কোয়ারেও এরকম আওয়াজ তুলেছিলো মানুষ। তাদের বেশিভাগই ছিল কলেজ, ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া। সময়টা ছিলো ১৯৮৯ সালের বসন্ত। তারা সবাই রুখে দিতে চেয়েছিলো শাসকের বিলগ্নিকরণ নীতি। খানিকটা খোলা আকাশ চেয়েছিলো সেখানকার কমিউনিস্ট সরকারের কাছে। যেখানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে তাদের তীব্র উচ্ছ্বাস আর মুক্তচিন্তা- ভাবনাগুলি।
কামানের তোপ দেগে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো সেদিনের তারুণ্যের সেই স্পর্ধাকে। নির্বিচারে গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছিলেন দেং জিয়াওপিং। আজাদির সংজ্ঞা একতরফা শুনিয়েছিলেন কট্টর বামাদর্শে বিশ্বাসী শাসকরা।
সরকারি মতে, মারা গেছিলো দু-আড়াইশো জন। ঘটনার আঠাশ বছর পরে চীনের ব্রিটিশ দূতাবাস সূত্রে জানানো হয়, প্রাণ গেছিলো কমবেশি দশহাজার জনের।

শীতের শহর গরম মিটিংয়ে মিছিলে। রাজনীতি রাজনীতি আর রাজনীতি। তবে মহামান্যদের হাতযশে রাজনীতি আজ আর কতটা রাজার নীতি আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। বরং বলা ভালো, 'চালনীতি'। চালবাজি আজ নীতির রূপ নিয়েছে। সঠিক চালে কিস্তিমাত।

গোটা দেশটা নাকি ফের আড়াআড়ি ভাগ হতে চলেছে, জানিস ছাতিম? মোদি সরকারের নাগরিক বিল নাকি ঠিক এই কাজটা সুসম্পন্ন করতেই তৈরি। হতে পারে। এত জ্ঞানীগুণীজনরা যখন বলছেন, তা এড়িয়ে যাই বা কিভাবে? কেই বা জানে, কার পেটে কী আছে!
তবে জানিস ছাতিম, আমি ভাবি অন্য কথা। দেশটাতো তৈরি সমাজ নিয়ে। আর সমাজ তৈরি পরিবার নিয়ে। এই পরিবারগুলিই তো টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সব নিউক্লিয়াস ফ্যামিলি। আমি তুমি আর এক ছানা। মা বাবা, ভাই বোন সব বাদ। আত্মীয় স্বজন তো আজ ইতিহাস।
তবুও মা অথবা বাবার পেট চালানোর মতো যদি পর্যাপ্ত পেনশনের টাকা থাকে, তাহলে রক্ষা। পুত্র, পুত্রবধু মুখ ঝামটা দিলেও, দুবেলা দুমুঠো জুটে যাবে। শীতের রাতে গায়ের কম্বলটারও জোগাড় হয়ে যাবে। সেই বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে, মাস ঘুরলেই পেনশনের নগদ কড়ি। যার বেশ খানিকটা ছেলের সংসারেও লাগে। ছেলে, ছেলের বউ বদমাশি করলে, মেয়েবাড়িতেও সংস্থান হয়ে যেতে পারে। মোট কথা, ফেলো কড়ি মাখো তেল।
তবে মা-বাবার ঝামেলা আজকাল কেউই নিতে চায় না। ওই টাকার লোভে যদিও বা কেউ নেয়। অন্যথায় বৃদ্ধাশ্রম।

আবার বাবার ট্যাকের জোর থাকলে, দু'ছেলের জন্য দুটো ফ্ল্যাট কেনেন। কেন? দুই ভাই ঠাই ঠাই হওয়ার ভয়।
"এই বাড়ি ঘর সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ লাগুক আমি চাই না। তাই প্রথম থেকেই আলাদা ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলুম।" পিতার শ্রীমুখ বচন।

বিভাজনের শুরু ঘরেই।
ওই বই- পত্তরের ওপরেও আর ভরসা রইলো নারে ছাতিম। বইয়ে পড়তাম- চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। ঘরেই নাকি বদান্যতার শুরু। কিন্তু এ কোন বদান্যতা বলতো!
থিংক গ্লোবালি অ্যাক্ট লোকালি! কোনও এক মহামতি বলেছিলেন। হচ্ছে তো উল্টোটা। গ্লোবালি ইউনিফিকেশন, গোটা বিশ্ব এক, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের হাঁক দিচ্ছি। আর পিতা নিজের বাড়িতে বসেই ছক কষছেন তাঁর দুই সন্তান, দুই সহোদরের মধ্যে বিভাজন রেখা টানার।
নিজের সন্তানের রক্তে ঢুকিয়ে দিচ্ছি বিভাজনের বিষ। আর রাস্তায় মিটিং মিছিল করে শ্লোগান দিচ্ছি- দেশ বিভাজন মানছি না মানবো না।

হ্যাঁরে ছাতিম, ঠিক এতটাই ভণ্ড আমরা।
শেকড়টাকে উপড়ে ফেলে বলছি গাছটা দীর্ঘজীবী হোক। বাইরে বড়ো বড়ো বুকুনি না দিয়ে আমরা কেউ বলছি না, জীবনের শেষবেলায় আর একজন মা- বাবাকেও যেন ঘর থেকে না খেদানো হয়। তাদের জন্য যাতে তৈরি না হয় একটিও বৃদ্ধাশ্রমরূপী ডিটেনশন ক্যাম্প।

শহরে বরং তৈরি হোক আরও কয়েকটা ফুটবল খেলার মাঠ। পার্ক মানেই তো সেই যুগলদের দখলদারী।
আমাদের গণতান্ত্রিক দেশে বাক, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে শুনেছি। কিন্তু প্রকাশ্যে যৌনকর্ম সম্পাদনের অধিকার আছে কিনা জানা নেই। তবু যৌনতার আঁশটানি গন্ধ পার্ক জুড়ে। খোলাখুলিই রাসলীলা প্রদর্শন। আপনার অসুবিধে হলে নাকচাপা দিন। নইলে দর্শক হয়ে দেখতেও পারেন। শহরতলীতেও এই কালচার ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। পথপ্রদর্শক কলকাতা, সংস্কৃতির পিঠস্থান। সার্বজনীন হচ্ছে, শরীরের নষ্ট হয়ে যাওয়ার অধিকার।

শহরের চারদিক ঘিরে ভালবাসার হাট। একেবারে বেন্দাবন। ভালবাসা এখন যৌনতা। নাকি যৌনতাই এখন ভালবাসা? বয়ফ্রেন্ড এখন গার্লফ্রেন্ডের নিবিড় হলেই শরীর হাতড়ায়। মন থেকে শরীরে যেতে তর সয় না। আর শরীরের উষ্ণতা না পেলেই, মনের মিতালি ফিতালি সব ফালতু কথা।

কতোই না সম্পর্কের ক্ষোভ, অভিযোগ। মান অভিমান। কাছে আসা থেকে দূরে সরে যাওয়া। সব গাণিতিক সূত্রের মতোই। নিষ্প্রাণ আবেগহীন। কেউ চুপ কেউ মুখর।
"তুই এরকম করলে, আমিও তো ওরকম করবোই!" হাতের সামনেই সোশাল মেডিয়ার উদার অপশন, রিপ্লেসমেন্ট। কে কার ধার ধারে? আর কেই বা কাকে পাত্তা দেয়?
আজ ভিক্টোরিয়া গার্ডেনে মেয়েটা যে ছেলেটার কোলে বসে আদর খাচ্ছে, কাল সেই মেয়েটা ওই গাছতলায় আদর খেয়েছিল অন্য শরীরের। ঝালমুড়িও খেয়েছিলো। ছেলেটাও হজম করে ফেলেছে তার পুরনো গার্লফ্রেন্ডের শরীরটা।
এরা কেউ কাউকে ভালবাসে না। কেউ কারুর প্রেমে পড়ে না।
কেন জানিস তো ছাতিম?
সন্দেহ। সবার মনে শুধুই সন্দেহের বিষ। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই আর রক্ষে নেই। এক ছোবল। ভীষণ ভিতু প্রাণী সাপ। একটু ভয় পেলেই ফনা তোলে। সেই সাপকেই পুষেছি মনের ঘরে।
তাই আজ তুই একা। আমিও একা। শহরে এরকম একার সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে হু-হু করে। কেউ কাউকে চেনে না। মেসেঞ্জার, হোয়াপে শুধুই অনর্গল বকবক করে চলা।

আজ গুগল সার্চে সব অজানাকেই জানা যায়। শুধু সামনের মানুষটার কথাই জানা যায় না। মানুষটা যখন অনেক দূরের হয়ে যায়, তখন হয়ত ভুল ভাঙ্গে।
"তার চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ভাঙলো রে ঘুম অন্ধকারে...."

ভিক্টোরিয়ার মাথার পরিটাও বড্ড একা রে ছাতিম। শীতের অন্ধকারে জমে কাঠ। আর বনবন করে চক্কর মারে না। ঠায় দাঁড়িয়ে। তার শূন্য চোখের দৃষ্টি ইহজগত ছাড়িয়ে এক অলৌকিক পথের সন্ধানে।
যাবি নাকি ছাতিম ওই ছায়াপথ ধরে?
আয় হাতটা চেপে ধর আমার।
চল নিউ ইয়ারের রাতে নষ্ট হয়ে যাই তুই আর আমি। নষ্ট দুজনেই।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours