নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

“ছুৎ অচ্ছুৎ প্রেম আলিঙ্গনে আবদ্ধ যুগলে
তথাকথিত ছ্যুৎমার্গ
সামাজিক চৌকিদারেরা চরথাপ্পরের
শিক্ষায় শেখালেন সমাজ রক্ষার মার্গ”

আমাদের সমাজে যারা এখনো ছুৎ মার্গ কে এখনো প্ৰশ্রয় দেয় তারাই সেকুলারিজম মানবতাবাদের বড়ো বড়ো ঠিকাদার হিসাবে নিজেদের ব্যক্ত করে থাকে।
স্বজাত্যবোধ বা স্বজাত্যকেন্দ্রিকতা (ইংরেজি: Ethnocentrism) নৃবিজ্ঞানে একটি বহুল ব্যবহৃত প্রত্যয়। প্রতিটি মানুষই স্বাভাবিকভাবেই স্বজাত্যকেন্দ্রিক হয়। একমাত্র মানুষই সমাজে আপন বা নিজের সংস্কৃতি বহন করে থাকে। এজন্য সে অন্যান্য জীব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জন্মের পর থেকে মানুষ তাঁর নিজস্ব গোষ্ঠী থেকে কথাবার্তা, চলাফেরা, সমাজের প্রচলিত মূল্যায়ন, রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি লালন-পালন করে।
স্বজাত্যকেন্দ্রিকতা বলতে সাধারণভাবে বোঝায় কোন ব্যক্তির আপন বা নিজের সংস্কৃতিকে যেমনঃ রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আইন, প্রথা, বিধি-নিষেধ ইত্যাদি অন্য যেকোন সমাজ ব্যবস্থা থেকে উৎকৃষ্ট মনে করা বা ধরে নেওয়া। অর্থাৎ তাঁর সংস্কৃতি বাদে পৃথিবীর অন্য সকল সংস্কৃতি নিকৃষ্ট। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সামজিক বা সাংস্কৃতিক গোষ্টী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে অন্য যে কোনও সংস্কৃতি থেকে উৎকৃষ্টতর বলে মনে করে এবং নিজস্ব সংস্কৃতির মূল্যবোধ ও ধারণাসমূহের প্রেক্ষিতেই নিজেদের সংস্কৃতির বিশিষ্টতা এবং একধরনের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে। এটাকেই মানববিজ্ঞানীরা বলেছেন স্বজাত্যবোধ। এই স্বজাত্যবোধে আমরা অনেক সময় অনেক কিছুকে ইগনোর করি, ভালো মন্দের বিভেদ ভুলে যাই , আপনার টাই বড় মনে করি।
এই চিন্তা গুলো এলো আমার সন্তানের সাথে কথোপকথনে , আমাদের মতো আমাদের বাচ্চারা নয় । ওদের পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। যখন বলি মা ভুত তো ধরতে  আসবে , বলে মা এগুলো নেই পৃথিবীতে ... সব বানানো , ভয় পায় না , সাপ বাঘ ভাল্লুকও না , বলে ওরা এনিমল লাইক করে , ওদের  যত্ন করা উচিত, ওরা ন্যাচার ।
এই হলো দশা । আগ ডোম, বাগ ডোম , ঘোড়া ডোম সাজে , গিটার শিখবো আন্টির কাছে
(আগা ডোম , বাগা ডোম , ঘোডা় ডোম সাজে, কড়া ঘাঘরা বাজে)। রোজ বেড টাইমে একটা রুটিন আছে আমার বাসায় , আমার ছানা দুটোকে স্টোরি বলতে হবে নতুবা ছড়া । কোনো টা যদি কারণ বসত বলা না হয় তবে একটা লম্বা টানের গান ছেড়ে দিলেই ব্যস কাজ হয়ে গেল , ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি চোখে এসে বসে পরে দ্রুত।
তো এই রোজ রুটিনের তালিকায় গত কাল হঠাৎ করে আমি একটা গান চালিয়ে দিলাম মোবাইলে, গানটি সিনেমার , সিনেমার নাম মনে নেই তবে আমার দেখা সিনেমা গুলোর মধ্যে একটা , সিনেমায় একটা বাবু কে দিদি গান শেখাচ্ছেন .. যার কথা গুলো এমন “আগ ডোম বাগ ডোম ঘোড়া ডোম সাজে গিটার শিখবো আন্টির কাছে  , গান টা শুনতে শুনতে আমার বড় কন্যা রায়া জিজ্ঞেস করলো মা আগ কি বাগ কি ডোম কি ? আমি একবারে চুপ হয়ে গেলাম ... ভাবছি তাই তো ! মনে মনে গানের আদি রূপ মনে করার চেষ্টা করছি , হুম মুহুর্তেই মনে হলো... ”আগা ডোম , বাগা ডোম, ঘোড়া ডোম সাজে , কড়া ঘাঘডা় বাজে “ মনে মনে ছড়াটাকে আওড়ে নিয়ে বললাম মা বুঝতে পারছি না তোমাকে কি করে এ গুলো বোঝাই , এমনিতেই তুমি দেশের বাইরে থাকো তারপর এমন শব্দ এই গানে এই আগা বাগা ডোম বোঝাতে হলে তো অনেক কিছু দেখাতে হতো তোমাকে দেশে গিয়ে , তবেই না বুঝতে।
সে নাছোড় বান্দা আমি হতাশ চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকিয় আছি!
বললাম আগ বাগ ঘোড়া এরা এক একটা গ্রুপের মানুষ  , ডোম ও মানুষ কিন্তু তাদের কাজ গুলো আলাদা আলাদা , কি কাজ মা ?, মেয়ের পরবর্তী প্রশ্ন । বললাম আমাদের দেশে অনেক মানুষ অনেক ধরনের কাজ করে এই কাজের কারনে তাদের কে উঁচু নিচু মর্যাদা দেওয়া হয় , ডোম সম্প্রদায়রা নিচু শ্রেনীর ট্রিটমেন্ট পায় সোসাইটিতে। তবে এই ছড়াটি শুনেছিলাম একজন কালু নামের ডোম ছিলেন যিনি যুদ্ধ করেছিলেন , তিনি একজন ঐতিহাসিক পুরুষ , তাকে নিয়েই এই ছড়াটি রচিত হয় ।
ডোমরা আর কি কাজ করে মা ? ডোমরা উম্ম ..... অনেক কাজই করে , যেমন শ্মশানে মরা পোডা়নোর কাজ করে শশ্মান ডোম , বাজনা বাজায় পূজোতে ,বিবাহ উৎসবে , তারপর পাল্কি বানায় , এমন অনেক কাজই করে মা । মা ওরা তো ভালো কাজই করে ওদের ভ্যালু নাই কেন মা?
এই প্রশ্নের উত্তরে বললাম জানি না সোনা এটা সমাজের নিয়ম ...সমাজ কি মা , সমাজ এত পচা রুলস কেন করছে ? আমি এমন সমাজ লাইক করি না।
আই লাইক ডোম পিপলস।
আমিও ওর সাথে ভাবছি
জল চল ,জল অচল ছুৎ অছ্যুৎ সমাজের নিয়ম নিয়ে!
এক সময় আমরা দেখেছি পড়েছি শুনেছি সনাতনী সমাজ যখন জাত পাত ছুৎ অচ্ছ্যুত মার্গে বহু জাতিতে বিভক্ত। কেউ কারো ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না। বিশেষত চিন্তা করুন, সমাজের বিচারে ধর্মীয় শাস্ত্র বিচারে নয়,নীচ জাতির অবস্থার কথা। ধর্মীয় অধিকারের কথা বাদই দিলাম, এদের ছিল নিজেকে মানুষ বলার অধিকার। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে হলে গলায় ঠিলে বেঁধে চলছে। কোন উচ্চবর্ণের লোকেরা যদি ভুল করেও নীচ বর্ণের মানুষের ছায়া মাড়িয়ে ফেলে তবে প্রায়শ্চিত্ত এই নীচু বর্ণের লোককেই করতে হয়েছে। দেবদেবীর পূজা তো দুরে থাক, মন্দির দর্শন করার অধিকার ছিল না। শিক্ষা কর্ম সব জায়গাতেই ছিল এই চরম বৈষম্য। ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা খুব দূরের বিষয়। কেউ যদি শুনত, তার কানে গরম শিষা ঢেলে দেওয়ার বিধান ছিল; কেউ যদি বেদ দেখত তবে চোখ উপড়ে ফেলার বিধান, কেউ যদি পড়ত তবে জিহ্বা কেটে নেওয়ার বিধান বলবৎ ছিল। সবাই সমাজের এই অবস্থার কথা একবার চিন্তা করে দেখুন। সেই সব কঠিনাই দিন পার করে এখন তো ছ্যুৎ মার্গ কিছুটা কি অনেকটাই শিথিল হয়েছে । আশা করি আসছে দিনে আরো ছুৎ মার্গের কবল থেকে রক্ষা পাবে সমাজের মানুষ।

(তথ্যসুত্র ... নেট এবং বাংলা লোক সংস্কৃতির বিভীন্ন বই থেকে পাওয়া)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours