কাজল ভট্টাচার্য্য, সিনিয়ার জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ

বাঘ গরু একঘাটে জল খায় শুনেছিলাম। এবার যোগ দিলো শেয়ালও।
শিবসেনা। নামেই পরিচয় দলের। চরম হিন্দুত্ববাদী এক দল। বেশ নামডাক আছে প্রাদেশিকতাবাদের জন্যও। স্বভাবে বাঘমামার মতোই জঙ্গী। দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের পরিচিও ছিল মহারাষ্ট্র রাজনীতির 'ফায়ার ব্র্যান্ড' হিসেবে। বালাসাহেবের সঙ্গে তাঁর ছেলের অমিল অনেকখানি। উদ্ধবের বরাবরই বেশ ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। আরও এক ফারাক দেখা গেল এবার। প্রয়াত বালাসাহেব যতোই চুটিয়ে রাজনীতি করুন না কেন,  নিজে কখনও শাসকের দন্ড হাতে নেননি। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন 'কিং মেকার'।
ছেলে উদ্ধব সরাসরি ক্ষমতার স্বাদ পেতে চাইলেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শি ছিলো তাঁর টার্গেট। পুরনো জোটসঙ্গী বিজেপি'র সঙ্গে দরদাম করে সেই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হলো না। সুতরাং অন্য সঙ্গী খোঁজা।

গোটা পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে চলেছিলেন, মহারাষ্ট্র রাজনীতির আর এক হেভিওয়েট শরদ প্যাটেল। শিবসেনা বিজেপির তিন দশকের আঁতাতে চিড় ধরতেই নড়েচড়ে বসলেন এনসিপি সুপ্রিমো প্রবীণ শরদ। ওদিকে উদ্ধব ততক্ষণে বুঝে গেছেন, এই জটিল অবস্থায় তাঁর পরিত্রাতা হতে পারেন একমাত্র শরদ পাওয়ারই। কারণ বিজেপি'র সঙ্গে এনসিপি'র সম্পর্কও সাপে নেউলের। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। পাওয়ার ঠাকরের চার হাত এক হওয়ার পরেই আর একটুও কালবিলম্ব নয়। দিল্লি ছুটলেন পাওয়ার। উদ্দেশ্য দশ জনপথকে বাগে আনা।

কংগ্রেস সুপ্রিমো সনিয়া হয়ত বা একটু 'তানানা' অবশ্যই করে থাকবেন। জাতীয় দল বলে কথা। তার ওপর কংগ্রেসে সঙ্গে শরদের পুরনো সম্পর্কটাও খুব মিষ্টিমধুর নয় আদৌ। তবে খড়কুটো ধরে রাজনীতির আবর্তে ভেসে থাকা ছাড়া আর বিকল্পই বা কোথায় ? কংগ্রেসের ইতিহাসও সেই কথাই বলে। আঞ্চলিক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজনীতির পাকদন্ডি বেয়ে ক্ষমতার শিখরে পৌঁছনোর চেষ্টা। কখনও সফল, আবার কখনও বা মুখ থুবড়ে পড়া। কিন্তু পাওয়ারের এই প্রস্তাবিত জোটে, পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল শিবসেনার গায়ের হিন্দুত্ববাদের গন্ধ। আর যাই হোক, কংগ্রেস এখনও নিজেকে সেকুলার বলতেই ভালবাসে। তবু সবকিছু ভেবেচিন্তে, শেষ পর্যন্ত শরদ পাওয়ারের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরলেন সনিয়া।

ধুরন্ধর বর্ষীয়ান রাজনীতীবিদ শরদ প্যাটেল। শেয়ালের মতোই চতুর। সুযোগসন্ধানী। এক মুঠোয় শিবসেনা, অন্য মুঠোয় কংগ্রেস। আর তিনি নিজে সেতুবন্ধনের মধ্যমনি। রাজনীতির এই ত্রয়ীরা একজোট হতেই তিন দশকের শিবসেনা বিজেপি জোটের ছবি ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেল। খেল খতম গেরুয়া শিবিরের। মাত্র ছত্রিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই, ভেঙে চুরমার দেবেন্দ্র ফড়নবিশের মুখ্যমন্ত্রীর কুরশি। সেই সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে গেল উদ্ধবের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শিতে বসার রাস্তা। ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত হলো শিবসেনা-কংগ্রেস-এনসিপি জোট সরকারের। তবে সরকারের রিমোট থাকলো পাওয়ারের হাতেই।

এই প্রথম বালাসাহেব ঠাকরের নিজস্ব ঘরানার রাজনীতি হোঁচট খেলো। ক্ষমতার সিংহাসনে বসলেন তাঁরই ছেলে উনষাট বছরের উদ্ধব। সামনেই ষাট। সরকারি অবসরের বয়স? মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে উদ্ধবেরও অবসর নিতে হবে নাতো? ঠাকরে সরকারের জন্মলগ্ন থেকেই এরকমটা আঁচ করছেন রাজনীতির জ্যোতিষরা। কারণ বিজেপি নামক দুষ্ট গ্রহ রাহুর কোপ। শিবসেন বিজেপি জোট সরকার হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। মহারাষ্ট্রবাসী ইভিএমে সেরকমই রায় দিয়েছিলেন। এই দু'দলের গতিপ্রকৃতিতেও দারুণ মিল। গত তিরিশ বছরের দোস্তি। গত পাঁচ বছর জোট বেঁধে সরকারে থাকা। তবে উদ্ধব ফড়নবিসের সেই সংসারে যে শান্তি ছিলো না, তাও প্রকট হয়ে উঠেছে বারেবারে।

তবে যে গরু দুধ দেয়, তার লাথি তো খেতে হবেই।
বারেবারে শিবসেনার হামলা মুখে পড়তে হয়েছিল ফড়নবিস সরকারকে। শিবসেনার মুখপত্র সামনায় একের পর আরেক লেখা বেরিয়েছিল বিজেপিকে তুলোধোনা করে। শিবসেনার বাক্যবাণ বারবার ফুঁড়েছে বিজেপি সমেত, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিসকেও। মহারাষ্ট্রের ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে শিবসেনাই একমাত্র সহায়। এই সারকথাটি বুঝতে দেরি করেনি পদ্ম শিবির। তাই এবারেও ভোটের আগে, সবকিছু জেনেশুনেই, ফের জোট বেঁধেছিলেন উদ্ধব দেবেন্দ্র। প্রত্যাশা মতোই সরকার গড়ার মতো ভোটও এসেছিল।

ভোটে জেতার পরেই স্বরূপ ধরলেন শিবসেনাপ্রধান। অটল থাকলো গেরুয়া শিবিরও। মুখ্যমন্ত্রীর মেয়াদের ফিফটি- ফিফটি হিসেব কষতে গিয়েই সব শেষ। ক্ষমতা বাড়ানোর ছক কষেছিল শিবসেনা। ওদিকে বিজেপির ছক ছিলো স্থিতাবস্থা। পুরনো ফর্মুলার পুনরাবৃত্তি। ভেঙে গেলো জোট। তবে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মহলের মত, ভোটের আগে থেকেই দাবার ঘুঁটি সাজানোর কাজ শুরু করেছিলেন উদ্ধব। তলেতলে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন পাওয়ারের সঙ্গে।

আগামী পাঁচ বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে দেখা যাবে উদ্ধব ঠাকরেকে। আপাতত সেরকমই আয়োজন। তবে সেই সরকারের মরণকাঠি জিয়নকাঠি গচ্ছিত থাকলো এনসিপি চিফ শরদ পাওয়ারের হাতেই। যিনি ক্ষমতা হাতানোর রাজনীতিতে, দল ভাঙাগড়ায় সিদ্ধহস্ত। আজ তাঁকে দেখা গেল গড়ার ভূমিকায়। কাল শরদকে কোন ভূমিকায় দেখা যাবে, ইতিমধ্যেই তার হিসেব কষতে শুরু করেছে রাজনৈতিক মহল।

বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখাই উদ্দেশ্য শিবসেনা, এনসিপি, কংগ্রেসের। এছাড়া এই তিন দলের রাজনৈতিক মতাদর্শে কোথাও কোনভাবেই মিল নেই। বরং উল্টোটা। কংগ্রেস, এনসিপি বরাবরই শিবসেনা- বিজেপি জোটকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক বলে ঠাওরেছে। শুধু বিজেপি'র হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতেই আজকের এই আঁতাত। ওদিকে ভোটের ফলাফলে আসন দখলে বিজেপিই সেরা। সুতরাং বিরোধী বেঞ্চে বসলেও দলের দাপট কম থাকবে না। মহারাষ্ট্রবাসীই বা ঠিক কোন নজরে এই জোট সরকারকে দেখবে, প্রশ্ন সেটাও। একই আশঙ্কার কথা শুনিয়েছে রাজ্য রাজনীতির ঘনিষ্ঠজনেরও।

একই আশঙ্কায় ভুগছে নয়া জোট শরিকরাও। ইতিমধ্যেই সাফাই পেশ করতে শুরু করেছে এনসিপি। তাদের মত, বিজেপি'র অপপ্রচারে শিবসেনার গায়ে ছাপ লেগেছিলো হিন্দুত্ববাদী, প্রাদেশিক দলের। আসলে বর্তমান জোটের তিন শরিকদলের উদ্দেশ্যই এক ও অভিন্ন। মহারাষ্ট্রের উন্নয়ন। সেই লক্ষ্যেই তারা আগামী পাঁচ বছর এগোবেন।

কিন্তু নেতারা মুখে যাই বলুন, দলগুলির অন্দরমহলের অবস্থাটা কেমন? দলের বিধায়কদের মনের খবরটা কী ? কোন আশঙ্কা থেকে তাঁদের হোটেলবন্দি রাখা হয়েছিলো? কিই বা এমন দরকার পড়েছিলো, যার জন্য জমা রাখতে বলা হয়েছিলো মোবাইল ফোন? সরকার গড়ার পর এবার তো বিধায়করা খোলা আকাশের নীচে। আগামিদিনে নীল আরবের স্রোতে কে কোনদিকে ভাসে তারজন্যই অপেক্ষা। বিজেপির চোরাস্রোতকে কিন্তু বাস্তবে উপেক্ষা করতে পারছে না কোন দলই। তার পূর্বাভাসও মিলেছে।

কোন দলে ঠিক কজন অজিত পাওয়ার আছেন, আজ এ মুহূর্তে বলা শিবেরও অসাধ্য। সেই শিবেদের ওপরেই নজরদারি চালিয়ে যাবে বিজেপি। তারপর শুধুই সময়ের অপেক্ষা।
মুম্বই শহরটার নাম কিন্তু বলিউড। মায়ানগরী। জলে পদ্মের ছায়া দেখে মায়ায় পড়ে জোটছুট হবে নাতো বাঘ, গরু, শেয়ালের কেউ ?




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours