আহসান হাবিব, লেখক, বাংলাদেশ:

যখন আমি বলি ‘তোমাকে ভুলে গেছি’ মানে আমি আদৌ তোমাকে ভুলিনি, শুধু ভুলিনি নয়, মনে রেখেছি খুব যত্ন করে । ‘যত্ন’ কথাটা হয়তো ভুল হল, ঠিক করে বললে কথাটা হবে ‘অনেক যত্ন’ করে । যখন ভুলে যাওয়ার প্রশ্ন আসেনি তখন যত্নের কথাটাও মনে আসেনি, তখন সময় ছিল প্রবহমান নদীর মত, স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণময়, গতিশীল।

যখন আমাদের বিচ্ছেদ হল, তখন হাতে পড়ে রইল শুধু স্মৃতি, স্মৃতির পসরা । মানুষটি নেই, কিন্তু স্মৃতি আছে, সেই স্মৃতিগুলি এখন মগজে ঠোকর মেরে যেতে থাকে । একদিকে স্মৃতি, আবার স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষটি সামনে নেই কিংবা আর হয়তো দেখা হবে না, তখন জোর করে চেষ্টা চলে ‘ভুলে’ যেতে । যত জোর চলে তত সে সামনে আসে, তত স্মৃতিগুলি চোখের সামনে ঝুলতে থাকে । নাছোড়বান্দা শিশুর মত স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকে হাত!

এই স্মৃতিগুলি যা ছিল একদা আনন্দের উৎসারণ, এখন সেগুলি বেদনা জাগায় । হাসিগুলি করুণ হয়ে কানে বাজতে থাকে। একটা অবয়ব চোখের সামনে ভাসতে থাকে, অথচ তাকে আমি দেখছি না, ছুঁতে পারছি না, একদিন যা ছিল আমাদের প্রাত্যহিক ক্রিয়ার অংশ, আজ তা ধরাছোঁয়ার বাইরে ! একটি মুখশ্রী যা দেখে মনের ভেতর হাজার বাতি জ্বলে উঠত, একটি ছোঁয়া যা ইন্দ্রিয়ে বইয়ে দিত খুশির প্রস্রবণ, আজ সেসব শুধু উপলব্ধির জগতে চুপ করে বসে আছে!

তখন আমরা জোর করে বলি ‘তোমার সব স্মৃতি মুছে ফেললাম’ ! কিন্তু সত্যি হল এই যে আমরা স্মৃতিকে মুছতে পারি না, আরও বাঙময় হয়ে দেখা দেয় । যে ক্রিয়া আজ স্মৃতি, যখন এর সৃষ্টিকাল, তখন হয়তো এমন করে ভাবাই হয়নি, গড়ে উঠেছে এমনি এমনি, এখন সেসব খুঁটিনাটি ভেসে উঠছে; কোথায় বসেছিলাম, কি করছিলাম, কি কথা হয়েছিল ! অঙ্গভঙ্গির প্রতিটি সঞ্চালন এখন চোখের সামনে একে একে নিখুঁত ভাবে ভাসতে থাকে এবং প্রতিটি ক্ষণের জন্য ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে । স্মৃতি আনন্দ নয়, বেদনা হয়ে বেঁধে ফেলে তখন।

বিচ্ছেদ হলে আমরা যে শুধু বিমূর্ত স্মৃতির জন্য বেদনায় আর্ত হই, তা নয়, হই মূলত একটি রক্তমাংসের মানুষের জন্য । একটি দেহের জন্য যে দেহের বিন্যাস দেখে একদিন বিস্মিত হয়েছিলাম, মুগ্ধ হয়ে মুগ্ধতার কথা বলেছিলাম, জড়িয়ে পড়েছিলাম সবচেয়ে মানবিক একটি সম্পর্কে । সেই সম্পর্কে আমরা আমাদের দেহকে উপভোগ করেছিলাম, উদযাপন করেছিলাম আমাদের সমুহ আনন্দ । সেসব আজ কেবলি অতীত, পড়ে আছে শুধু দেহত্তোর স্মৃতি । দেহ নাই বলে স্মৃতিগুলি এতো বেদনা জাগিয়ে তুলছে । নেই বলে মনের ভেতর আশংকা জাগছে এই দেহটি অন্য কোথাও মেলে ধরছে না তো ? এই আশংকা, এই দৃশ্যকল্পনা বেদনাকে আরও জান্তব করে তোলে । মন এটা মেনে নিতে পারে না । সবকিছুইর অংশীদারিত্ব মেনে নেয়া যায়, সম্ভবত দেহের অংশদারীত্ব মেনে নেয়া যায় না।

যত সময় গড়িয়ে যায়, স্মৃতির উপর আবরণ পড়তে থাকে, দেহ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে । ততদিনে মন আবার হয়তো কোন নতুন মানুষের সন্ধান পেয়ে বসে আছে, একটি দেহের সঙ্গে আবার সে মেতে ওঠে ইন্দ্রিয়ানদে ! জীবন যেন এক বিশাল অট্টালিকা যার একটি ইট আনন্দের একটি ইট বেদনার!




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours